বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচির সমাবেশ শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই সমাবেশ শুরু হয়। এর আগেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় শহীদ মিনার ও আশপাশের এলাকা।
দুদিনের নাটকীয়তার পর সোমবার গভীর রাতে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা থেকে সরে এসে মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ সমাবেশের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এর আগে সোমবার রাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেই ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার কথা জানালে গভীর রাতে জরুরি বৈঠক করে এই কর্মসূচি ঠিক করে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া প্ল্যাটফর্মটি।
‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে মঙ্গলবার ভোর থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্র-জনতা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকে। তাদের হাতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন।
আয়োজকরা জানিয়েছেন, সারাদেশ থেকে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র, পেশাজীবী, জনতা এই সমাবেশে আসছেন। তারা বলছেন, আজকের সমাবেশ থেকে দ্রুত ঘোষণাপত্র জারি, দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম, অপরাধীদের বিচারসহ নানা দাবি জানানো হবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য মার্চ ফর ইউনিটি সমাবেশের সংগঠক মোল্লা ফারুক এহেসান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সমাবেশে আসার পথে বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বাসে হামলা হয়েছে।
মঙ্গলবার ভোর থেকে শহীদ মিনারে মঞ্চ তৈরির কার্যক্রম শুরু করেন আয়োজকরা। সকাল থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে জড়ো হতে দেখা যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির বিভিন্ন এলাকার নেতাকর্মীদের।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, দুপুর পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বাস দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে ঢাকায় ছাত্র-নাগরিকেরা এসেছেন। বাসগুলো পুরাতন বাণিজ্যমেলার মাঠে রাখা হয়েছে।
এ সমাবেশকে কেন্দ্র করে শহীদ মিনার এলাকায় দুপুর থেকেই চলছে জুলাই বিপ্লবের স্লোগান, ডকুমেন্টারি প্রদর্শন ও গান। ‘খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই’, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা’, ‘ক্ষমতা না জনতা, জনতা জনতা’- প্রভৃতি স্লোগানে মুখর রয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের বিজয়ের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পছন্দে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও এই অভ্যুত্থানের কোনও ঘোষণাপত্র ছিল না।
পাঁচ মাস পর গত শনিবার জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা ফেইসবুকে ৩১ ডিসেম্বর কিছু করার ইঙ্গিত দিয়ে একের পর এক পোস্ট দিলে তা নিয়ে দেখা দেয় ব্যাপক কৌতূহল।
পরদিন জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, ৩১ জানুয়ারি অর্থাৎ মঙ্গলবার ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে তারা ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ উপস্থাপন করবে।
তাতে দেশে ‘মুজিববাদী সংবিধানের কবর’ রচিত হবে এবং আওয়ামী লীগ দল হিসেবে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।
পাঁচ মাস পর ঘোষণাপত্র দেওয়ার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “এই ঘোষণাপত্র ৫ই আগস্টেই হওয়া উচিৎ ছিল, না হওয়ার ফলে ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তিগুলো ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। যে গণ অভ্যুত্থানটি হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে মানুষ মুজিববাদী সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তার একটি লিগ্যাল ডকুমেন্টেশন থাকা উচিৎ।”
এরপর সেদিনই সাংবাদিকদের প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল বলেন, “আমরা এটিকে প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ (বেসরকারি উদ্যোগ) হিসেবেই দেখছি। সরকারের সঙ্গে এর কোনও সম্পৃক্ততা নেই।”
এই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকারের কিছু জানা নেই বলে জানান সহকারী প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার।
তার মধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শহীদ মিনারের কর্মসূচি নিয়ে এগোতে থাকে। সোমবার আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে সাংবাদিকদের বলেন, “মঙ্গলবারের ঘোষণাপত্রে এমন একটা সীমারেখা আগামী দিনের সরকারকে দিয়ে যাওয়া হবে, তার বাইরে যেন কোনও সরকার যেতে সাহস না করে।”
এর ঘণ্টা খানেক পরেই সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রেস সচিব শফিকুল বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
“জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই ঘোষণাপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানোর পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এনিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলার ওপর জোর দিয়েছিলেন।
সেই প্রেক্ষাপটে সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রেস সচিব বলেন, “গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করা হবে। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিত, ঐক্যের ভিত্তি ও জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত হবে।
“আমরা আশা করছি, সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে এবং জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।”
সরকারের এই সিদ্ধান্ত জানার পর রাতেই ঢাকার বাংলামটরে রূপায়ন টাওয়ারে নিজেদের কার্যালয়ে জরুরি বৈঠকে বসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এরপর মধ্যরাতে সংবাদ সম্মেলনে এসে তাদের মুখ্য সমন্বয়ক হান্নান মাসউদ বলেন, সরকারই ঘোষণাপত্র দেবে।
“সরকার আমাদের প্রক্লেমেশনের ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে, আমাদের বিজয় হয়েছে। আমরা অবশ্যই শহীদ মিনারে একত্রিত হব। যে কর্মসূচি আমরা দিয়েছি, আমরা একত্রিত হব। সরকার প্রক্লেমেশনের পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছে, আমরা শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে তাতে সমর্থন জানাব। প্রক্লেমেশন কীভাবে হবে কালকে আমরা সেখানে বলে দেব।”
এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কর্মসূচি পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় বলা হয়, “নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার পক্ষে এই ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রের প্রণয়ন ও ঘোষণার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম।
“আমাদের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের আপামর ছাত্র-জনতার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ও ইতিবাচক সাড়া সঞ্চারিত হয়েছে। এমতাবস্থায় ছাত্র-জনতার আহবানে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতা এই সময়পোযোগী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছে।”
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মঙ্গলবার বিকালের এই সমাবেশে দেড় থেকে আড়াই লাখ মানুষের সমাগম আশা করছে আয়োজকরা। বিকাল ৩টায় সমাবেশ শুরু হলেও সকাল থেকেই শহীদ মিনারে চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এই সমাবেশে সারাদেশ থেকে আসা গাড়ি রাখার বিষয়ে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
গাবতলী হয়ে ঢাকায় আসা যানবাহনগুলো মানিক মিয়া এভিনিউ ও আগারগাঁও এলাকার পুরাতন বাণিজ্য মেলা মাঠে রাখতে হবে। সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী দিয়ে আসা গাড়িগুলো থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ ও ক্যাম্পাস এলাকায়। আব্দুল্লাহপুর দিয়ে আসা যানবাহনগুলো ৩০০ ফিট এলাকায় রাখা হবে।