Beta
মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৫

ছেলের গুলিবিদ্ধ লাশ মর্গে রেখে বাবাকে ঘুরতে হচ্ছিল থানায় থানায়

শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন সুহার্তো।
শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন সুহার্তো।
[publishpress_authors_box]

রূপক অর্থে বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু হলো বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ। আকস্মিক এই ভার চেপে বসেছিল আব্দুল মতিনের ওপর। গুলিবিদ্ধ ছেলের লাশ সেই ভার আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। কিন্তু সেখানেই কি শেষ? ছেলের লাশ পেতেও পুলিশি বিড়ম্বনার অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যেতে হয়েছে এই ব্যক্তিকে।

তারপরও নিজের সব কষ্ট চেপে রেখে ছেলের কষ্টের কথা ভেবেই হাহাকার ঝরে এই বাবার কণ্ঠে- “ছেলেটা গুলি খেয়ে মারা গেল, আমার ছেলেটার কত কষ্টই না হয়েছে। ছেলেটার ওই সময়ের কষ্টের কথা চিন্তা করলে আমার পৃথিবীটা দুলে ওঠে, আমি মাথা ঠিক রাখতে পারি না। আহারে…আমার এইটুকুন ছেলে না জানি কত কষ্ট পেয়ে মারা গেল।”

এই তরুণের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ‘গানশট ইনজুরি’র কথা লেখা। বলা হয়েছে, বুলেটটি মাথায় আঘাত করার কারণে সেকেন্ডারি ব্রেইন ইনজুরি হয়ে তার মৃত্যু ঘটে।

মতিনের সঙ্গে শনিবার (২৭ জুলাই) যখন কথা হয়, তখন তিনি ছেলে শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন সুহার্তোর কবরের পাশে, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায়। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার মধ্যে গত ১৯ জুলাই ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হন ১৯ বছরের সুহার্তো। দুদিন পর মারা যান হাসপাতালে। অনেক কষ্টের পর তারও দুদিন পর লাশ পেয়ে গ্রামে নিয়ে ছেলেকে দাফন করেন মতিন।

সুহার্তোকে হারিয়ে পরিবারের সবাই শোকে কাতর। আড়াই বছরের ছোট বোন, চাচাতো বোন ভাইয়ের কবর সাজাচ্ছিলেন ফুল দিয়ে। ৭০ বছরের দাদি রওশন আরা খাতুন বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। ঘুমের ঘোরেও ছেলের নাম ধরে ডেকে উঠছেন সুহার্তোর মা মমতাজ বেগম। এসবই জানালেন মতিন।

বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মতিন। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে তিনি থাকেন ঢাকার বিশ্বরোডের পাশে কুড়ালতলীতে। তবে সুহার্তো পড়তেন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজে। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন তিনি। পাঁচটি পরীক্ষা হয়েছে। এরপর আন্দোলনের কারণে স্থগিত হয়ে যাওয়ায় ঢাকায় এসেছিলেন বাবা-মার কাছে।

“ছেলেটা বোধহয় আমাদের শেষ দেখা দেখতে এসেছিল, আমরা বুঝতে পারিনি,” এখন মনে হচ্ছে মতিনের।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে এই জুলাই মাসের শুরুতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যানারে ঢাকায় শুরু হয় আন্দোলন। ধীরে ধীরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীরা আক্রান্ত হলে পরদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত বাধে। তাতে ছয়জন নিহত হয়।

এর প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা সর্বাত্মক অবরোধ ডাকলে ১৮ জুলাই সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। তাতে অর্ধ শতাদিক নিহত হয়। পরদিনও সংঘাত অব্যাহত থাকলে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করতে হয় সরকারকে। এরমধ্যে কয়েকদিনে নিহতের সংখ্যা দুইশ ছাড়ায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় বিকাল ৫টার দিকে কোটা বিরোধীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
গত ১৫ জুলাই সংঘাতে গড়িয়েছিল আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় সেদিন বিকালে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

সুহার্তো গুলিবিদ্ধ হন ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকার মিরপুরে। সেদিন ঢাকা ছিল উত্তাল, মিরপুর, মহাখালী, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, মোহাম্মদপুরে ব্যাপক সংঘাত হয়েছিল।

মতিন জানান, মিরপুরে খালার বাসায় গিয়েছিলেন সুহার্তো। সেখানেই খালাত ভাই এবং তার বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন। বিকালে গুলিবিদ্ধ হন সুহার্তো।

সুহার্তোকে প্রথমে মিরপুরের আলোক হাসপাতালসহ আরেকটি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। পরে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে লাইফ সাপোর্টে দুদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। গত ২০ জুলাই শনিবার বেলা ২টার কিছু সময় পরে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।

ছেলের ডান চোখের ওপরে ভ্রুর ভেতরে দিয়ে গুলি ঢুকে মস্তিষ্কে আঘাত করেছিল বলে জানান মতিন।

বৃহস্পতি থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত ছেলের আইসিইউর সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিলেন মতিন। আশা ছিল, ছেলে যেমন ময়মনসিংহ থেকে এসে তাদের চমকে দিতেন, ঠিক তেমনি আইসিইউ থেকেও ফিরে আসবে।

“কিন্তু ছেলেটা আমার ফেরেনি,” একরাশ বেদনা নিয়ে বলেন তিনি।

ছেলের মৃত্যুর পর লাশ পেতে শুরু হয় মতিনের আরেক যুদ্ধ। কেননা পুলিশের ছাড়পত্র ছাড়া লাশ দিতে চাইছিল না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতাল থেকে মতিনকে বলা হয়, যেখানকার ঘটনা সেখানকার ‘পুলিশের সার্টিফিকেট’ ছাড়া লাশ দেওয়া যাবে না।

“ছেলের লাশ রেখে এলাম মিরপুর মডেল থানায়। সেখানে এসে সবার হাতে-পায়ে ধরি, কিন্তু তারা কথাই শুনতে চান না। একজন তো বলেই বসেন, ঢাকায় এত গণ্ডগোল হচ্ছে, আপনার ছেলে যে মিরপুরেই মারা গেছেন, তার প্রমাণ কী?”

অসহায় অবস্থায় মতিন আবার ফিরে আসেন হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্মকর্তাদের বলেন, মিরপুর থানা পুলিশ তো সার্টিফিকেট দিচ্ছে না।

তখন সেখানে থাকা কেউ একজন শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে আসার পরামর্শ দেন। মতিনও ছোটেন সেখানে।

“শাহবাগ থানা জিডি নেয়। সেই কাগজ নিয়ে মর্গে এলাম (শনিবার) রাত ১০টার দিকে।”

কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। মতিন বলেন, “কিন্তু মর্গে থাকা পুলিশরা বলল, ‘রাত হয়ে গেছে, এখন আর কোনও কাজ হবে না। আমরা এখন চলে যাব, থানায় আসেন’। থানায় গেলাম, রাত সাড়ে ১০টার মতো বাজে…বলল, ‘রবিবার সকালে আসেন’।”

“ছেলেটার লাশ মর্গে, আর ঘুরছি থানায় থানায় .…এমন ভাগ্য যেন কোনও বাবার না হয় পৃথিবীতে,” বলতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখেতে পারছিলেন না মতিন।

লাশ বুঝে যাওয়ার পরও সব সমস্যার অবসান হয়নি। ট্রলি পাচ্ছিলেন না তিনি।

“আসলে টাকা ছাড়া ট্রলি দেবে না। লাশ প্রতি তারা হাজার টাকা করে নিচ্ছে, পরে বুঝতে পেরেছি যখন অন্য পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা হয়েছে।”

এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচিত এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার সহায়তায় রবিবার ছেলের লাশটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে পারেন মতিন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাড়ির দিকে রওনা হন তারা, পৌঁছান রাত সাড়ে ১২টার দিকে। পরদিন সোমবার সুহার্তোর দাফন হয়।

“কিন্তু মনে হচ্ছে, আমাদের পুরো পরিবারের দাফন হয়েছে, হয়তো আমরা বেঁচে আছি, কিন্তু একে আসলে বেঁচে থাকা বলে না,” বলেন মতিন।

কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যে সুহার্তোকে গুলি করে মারার জন্য কে দায়ী- সেই উত্তর কি পাবেন মতিন?

আন্দোলনকারীরা বলছে, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সরকার সমর্থকরা গুলি চালিয়েছে তাদের ওপর। সরকার ও পুলিশ বলছে, এই আন্দোলনের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত ঢুকে নাশকতা চালিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে হতাহতের তথ্য দিতেও গড়িমসি চলছে।

এই অবস্থায় ছেলে হারানো মতিন বলেন, “আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বিচারটা কার কাছে চাইব? সে জায়গাটাই খুঁজে পাচ্ছি না।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত