অলিম্পিক ও বিশ্বকাপে বাংলাদেশি খেলোয়াড়রা পদকের ধারেকাছেই থাকেন না। কিন্তু এ দেশের তৈরি ক্রীড়া সরঞ্জামের সদর্প উপস্থিতি থাকে ওসব ক্রীড়া মহাযজ্ঞে। দেখা যায়, এখানকার তৈরি আর্চারি তীর, গলফ শ্যাফট বা জার্সি পরে পদক জিতছেন বিশ্ব তারকারা। অথচ দেশে তৈরি ওসব উন্নত ক্রীড়া সরঞ্জামের খবরই জানেন না দেশি তারকারা। এ নিয়েই সকাল সন্ধ্যার রাহেনুর ইসলাম – এর চার পর্বের ধারবাহিক। আজ প্রথম পর্বে থাকছে আর্চারি।
উচ্ছ্বাসে ভাসছিলেন সাগর ইসলাম। রাজশাহীর চায়ের দোকানির ছেলে সরাসরি টোকিও অলিম্পিকের আর্চারিতে জায়গা করে নেওয়ার পর থেকে পাচ্ছিলেন স্পন্সরের নানা উপহার। হঠাৎ একদিন আর্চারির বিখ্যাত কোম্পানি ‘রামরোডস’ থেকে আসে উপহারের প্যাকেট।
প্যাকেট খুলে সাগর দেখেন সবই ধনুকের স্ট্যাবলাইজার। স্ট্যাবলাইজার জিনিসটা হলো লম্বা লাঠির মতো যা ধনুকের সঙ্গে লাগানো থাকে। এটা ধনুকের কম্পন কমানোর পাশাপাশি তীরের ভারসাম্য রক্ষাসহ নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ছুঁড়তে সাহায্য করে। এগুলো দেখেই সেদিন খুশিতে জলও এসে পড়েছিল সাগর ইসলামের চোখে। এত দামি উপহার আসবে, সেটা ভাবতেই পারেননি তিনি। এই বাংলাদেশি আর্চার প্যারিস অলিম্পিক শেষ হওয়ার এতদিন পরও জানতেন না ওই স্ট্যাবলাইজারগুলো বাংলাদেশের চট্টগ্রামে তৈরি।
‘সকাল সন্ধ্যা’র এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে তথ্যটা জেনে আকাশ থেকে পড়লেন সাগর ইসলাম, ‘‘বলেন কি! বাংলাদেশের তৈরি স্ট্যাবলাইজার দিয়ে অলিম্পিক খেলে এলাম, আর এক বছর পরও ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।”
শুধু আর্চারির স্ট্যাবলাইজারই না, তীরও তৈরি হয় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ইপিজেডে। সেই তীর দিয়ে খেলা হয়েছে পুরো টোকিও অলিম্পিক। সেই তথ্যও অজানা ছিল সাগর ইসলামের, ‘‘গর্ব করার মতোই ব্যাপার ভাই। আমাদের দেশের তৈরি তীর দিয়ে অলিম্পিক হয়েছে। বিশ্বের নামি সব তারকা চট্টগ্রামের তীর দিয়ে খেলছে-ভাবতেই ভালো লাগছে।”
তৈরি করে চট্টগ্রাম ইপিজেডের মামিয়া-ওপি
১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম ইপিজেডে প্রতিষ্ঠিত হয় জাপানি প্রতিষ্ঠান মামিয়া-ওপি। প্রায় ৩৫ বছর ধরে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র গলফ শ্যাফট কারখানা। অর্থাৎ গলফের শ্যাফট বানায় তারা। একইসঙ্গে আর্চারি অ্যারো বা তীর তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে নতুন পরিচিতি।
মামিয়া-ওপি’র ব্যবস্থাপক (কারখানা) মাকোতা শিবুতা তাদের চট্টগ্রামের অফিসে বসেই টোকিও অলিম্পিকের জন্য তীর তৈরির গল্প বলেছেন। জানিয়েছেন তীর রপ্তানির অঙ্কও, ‘‘প্রতিমাসে ৮০ হাজার তীর তৈরির সক্ষমতা আছে আমাদের। ২০২১ সালে আমরা আড়াই লাখ তীর রপ্তানি করেছি। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ১০ লাখ ৮৯ হাজার ডলার বা ১১ কোটি টাকার বেশি। ২০২২ সালে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪০ শতাংশ। টোকিও অলিম্পিকের তীর তৈরি করেছি আমরা। মামিয়া-ওপি জাপানি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় টোকিও অলিম্পিকের তীরের জন্য আমাদেরকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। অলিম্পিকে আমাদের তীর দিয়ে খেলা হওয়াটা নিশ্চিতভাবে গর্ব বাড়িয়েছে বাংলাদেশের।”
২০২৩ ও ২০২৪ সালের রপ্তানির প্রকৃত হিসেবটা দেননি মাকোতা শিবুতা। তবে তার অনুমান, গত দুই বছরে রপ্তানি হয়েছে অন্তত ২২ লাখ ডলারের তীর। জনপ্রিয়তা বাড়ায় আগামীতে আরও প্রবৃদ্ধিতে আশাবাদী তিনি।
তৈরি হচ্ছে স্ট্যাবলাইজার
বিশ্বখ্যাত আর্চারি স্ট্যাবলাইজার কোম্পানি ‘রামরোডস’ চুক্তি করেছে মামিয়া-ওপির সঙ্গে। তাদের চাহিদার একটা অংশ তৈরি হয় চট্টগ্রামের এই প্রতিষ্ঠানে। আর্চারির তীর ও স্ট্যাবলাইজার গত আট বছর ধরে রপ্তানি করছে তারা।
এ নিয়ে মামিয়া-ওপির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবুল হাসনাত হেলাল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ‘‘বাতাসের গতি, ওজন, দৈর্ঘ্য—এর কোনোটি চুল পরিমাণ এদিক-সেদিক হলেই আর্চার নিশানা খুঁজে পাবেন না। তাই প্রতিটা তীর একেবারে নিখুঁত হতে হয়। কম্পিউটারে মান যাচাইসহ তিন স্তরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমরা গত আট বছর ধরে সফলভাবে আন্তর্জাতিক মান যাচাইয়ে উত্তীর্ণ তীর ও স্ট্যাবলাইজার রপ্তানি করে আসছি। বিশ্বসেরা আর্চারদের কাছে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে বলেই টোকিও অলিম্পিকে এখানকার তীরে খেলা হয়েছে।”
পরিদর্শনে গিয়েছিলেন রোমান সানা
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রীড়াসামগ্রী প্রতিষ্ঠান ইস্টন অ্যারো আর্চারির তীরের দুনিয়ায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানিও চুক্তি করেছে মামিয়া-ওপির সঙ্গে। শুরুতে নিজেদের ভেক্টর ব্র্যান্ডের তীর চট্টগ্রাম থেকে তৈরি করে নিয়ে যেত তারা।
ভেক্টর তীরে সাধারণত খেলা হয় ১৮ মিটারের ইনডোর আর্চারি। অলিম্পিক ও এশিয়ান গেমসের মতো মর্যাদার টুর্নামেন্টে খেলা হয় ৭০ মিটারে। এসবের জন্য ইস্টন অ্যারোরই রয়েছে ৫.০, এক্সিস, এক্স ১০সহ নানা ব্র্যান্ডের তীর। মামিয়া-ওপিতেও আসে এসব তৈরির আদেশ।
২০২১ সালে মামিয়া-ওপি পরিদর্শনে নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ আর্চারির সেরা তারকা রোমান সানাকে। বাংলাদেশের প্রথম আর্চার হিসেবে সরাসরি অলিম্পিকের যোগ্যতা অর্জন করা রোমানকে এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই বিস্মিত হয়েছিলেন কিছুটা, ‘‘ফেডারেশনের কয়েকজন কর্তাসহ আমি গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে। এটা তো ব্যবসায়িক কারণে গোপন রাখার কথা। আপনি জানলেন কী করে?’’
মামিয়া-ওপি থেকে কথা বলার অনুমতি নেওয়া হয়েছে এবং তারাই রোমান সানার ওই কারখানা সফরের তথ্য ফাঁস করেছে। এটা জানানোর পরই রোমান মন খুলে কথা বলেছেন, ‘‘অবশ্যই বাংলাদেশের একটা প্রতিষ্ঠানে বিশ্বমানের তীর আর স্ট্যাবলাইজার উৎপাদন হওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার। ২০১৮ সাল থেকে আমার স্পন্সর ছিল রামরোডস (মামিয়া-ওপিতে উৎপাদন হয় তাদের স্ট্যাবলাইজারের একটা অংশ)। আমি সাধারণত ইস্টন অ্যারো দিয়েই খেলি। মামিয়া-ওপির ভেক্টর তীরটা ইনডোর আর্চারির জন্য খুব ভালো। আমরা যখন গিয়েছিলাম, তখন ওরা যে অলিম্পিকর জন্য তীর তৈরি করছিল, সেটা জানায়নি। তাহলে তো টোকিওতে আমিও খেলেছি দেশের তৈরি তীরে! যাই হোক, এখানেই আর্চারির সরঞ্জাম তৈরি হচ্ছে, এটা দেশের জন্য গর্বের।’’