কেউ অজ্ঞেয়বাদী হোক অথবা বিশ্বাসী- মানুষের পূর্বজন্মের স্মৃতি কয়েক দশক ধরে গবেষক, মনোবিজ্ঞানী, আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদ এবং আর সবার আগ্রহের কেন্দ্রে জায়গা করে আছে।
“বর্তমান জন্মের নয়, বরং একজন ব্যক্তির আগের জীবনের নির্দিষ্ট সময়ের ঘটনাই হচ্ছে সেই স্মৃতি। ২৪ থেকে ৬০ মাস বয়সী শিশুর বেলাতেও এই উপলব্ধি হতে পারে। এই অনুভূতি একেবারেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে”; পুরনো গবেষণায় এমন ব্যাখ্যা দেখা গেছে।
গবেষণার বরাতে পূর্বজন্মের স্মৃতি নিয়ে অনেকের কথা তুলে ধরেছে ফোর্বস।
এক্সপ্লোরে প্রকাশিত ২০২১ সালের এক গবেষণা বলছে, বিশ্বের বহু প্রান্তের বহু মানুষের পূর্বজন্মের স্মৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ছকে এসব জমা থাকে।
দুই বছর বয়সী শিশুরা পূর্বজন্মের স্মৃতি মনে করা শুরু করে। অনেকে কিছু ঘটনা, নাম, পরিবার ও জায়গার নাম বলতে পারে। কিন্তু নয় বছর হতে হতে অর্থাৎ স্কুল জীবনে পা রেখে আগের জীবনের কথা বলা বন্ধ করে দেয়।
আবার শিশুদের অনেকে পূর্বজন্মের ভয়ানক মৃত্যুর স্মৃতি মনে করতে পারে। ২০ শতাংশ আগের ও পরের জন্মের মাঝের সময় নিয়েও কথা বলেছে। দেখা গেছে, আগের জন্মে মৃত্যু এবং পুনর্জন্ম হওয়ার মাঝে গড়ে ১৬ মাসের ফারাক রয়েছে।
অনেকে ভয়ংকর মৃত্যুর কথা স্মৃতি থেকে বলতে পারে। কারো মনে থাকে আগের জীবনের ভয় অথবা পছন্দের কথা; যা কোনো না কোনোভাবে তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। দেখা গেছে, আগের জন্মে পানিতে ডুবে মৃত্যুর কথা মনে করতে পারা শিশুরা বর্তমান জন্মে সাঁতার কাটতে ভয় পায়।
গবেষণায় অংশ নেয়া অনেকে মনে করেন, শরীরে যে জন্মদাগ আছে তা পূর্বজন্মের কোনো আঘাতের চিহ্ন। শেখানো হয়নি এমন কোনো ভাষায় কথা বলতে দেখা যায় শিশুদের; যাকে ‘জেনোগ্লসি’ বলে। হয়তো পূর্বজন্মে ওই না জানা ভাষাতেই কথা বলত শিশুটি।
জার্নাল অব নিয়ার ডেথ স্টাডিসে প্রকাশিত গবেষণায় অনেকের অভিজ্ঞতার বিবরণ উঠে এসেছে।
লিম্ফোমা অসুখে অনিতা মুরজানি কোমায় চলে গিয়েছিলেন। ওই দশার স্মৃতি মনে করতে পারেন তিনি।
“তখন আমি সচেতন ও অচেতন অবস্থার দোলাচলে। আমি অনুভব করলাম আমার আত্মা শরীর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ওই অবস্থায় অনেক কিছু দেখতে পেতাম আমি। একবার দেখলাম, আমার ভাই প্লেনে বসে; আমি মৃত্যুপথযাত্রী শুনে দেখতে আসছে। যখন আমার জ্ঞান ফিরে আসে, আমি দেখলাম ভাই আমার সামনে, কিছুক্ষণ আগে সে প্লেন থেকে নেমে এসেছে”, বললেন মুরজানি।
“তারপর আমার ভাই আর আমাকে আবারও এক ঝলক দেখলাম আমি। আমার মনে হলো এ পূর্বজন্মের কোনো দৃশ্য। ওই জীবনে আমি ভাইয়ের চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিলাম; হয়তো মায়ের বয়সী। কিন্তু এই জীবনে সে আমার চেয়ে বয়সে বড়।”
নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ডেভিড মুকিন। তিনিও কোমায় চলে গিয়েছিলেন। আর এই অবস্থায় কয়েকবার পূর্বজন্মের ঘটনা দেখেছেন তিনি।
“কোমায় থাকা অবস্থায় অন্তত দুই বার আমি আগের জীবনের ঘটনা দেখতে পেয়েছিলাম। গত ২৪ বছর ধরে আমার মনে ভয় কাজ করতো যে আমি বুঝি প্লেন দুর্ঘটনায় মারা যাবো। অনেক বছর পর একজন মনোবিদ বলেছিলেন, এই ঘটনা আমার পূর্বজন্মের; আমি ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে কোনো এক বেজোড় তারিখে যুদ্ধবিমান অবতরণের সময় মারা গিয়েছিলাম। আমার পুনর্জন্ম হয় ১৯৪৪ সালে ২১ ডিসেম্বর।”
“এসব জেনে আমার মেয়ে গুগল করে দেখেছিল ক্যাপ্টেন ফ্রাইয়ার একমাত্র পাইলট যিনি নভেম্বরে বেজোড় দিনে মারা গিয়েছিলেন। তিনি পি-৫১ মুসটাঙ্গ অবতরণের চেষ্টা করতে গিয়ে মারা যান। এই জন্মে আমার প্রিয় প্লেন হলো পি-৫১। এই প্লেন আমার টেবিলে রাখা আছে। আমার মেয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিল আমাকে। দেখা গেল আমি আমার উইং কমান্ডার, স্কোয়াড্রন কমান্ডার, মা এবং বাবার নাম জানি।”
এক্সপ্লোরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে গবেষকরা বলছেন, “পূর্বজন্মের স্মৃতি মনে করতে পারছেন এমন অনেকের তথ্য পাওয়া গেলেও এর অর্থ নিয়ে বিতর্ক রয়েই যাচ্ছে।
“কেউ বলেন শিশুতোষ কল্পনা, কারো ধারণা এসব প্রতারণা, পুনর্জন্মে বিশ্বাসী পরিবারের সামাজিক প্রতিষ্ঠা খোঁজার চেষ্টা, জেনেটিক বা বংশগতভাবে পাওয়া স্মৃতি, ষষ্ঠইন্দ্রিয় দিয়ে চালিত হওয়া, কোথাও পড়া বা শোনা ঘটনাকে নিজের মত করে বলা, কোনো অশরীরী শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া।”
শিশুদের পূর্বজন্মের স্মৃতি নিয়ে গবেষণা প্রকাশ করেছে সাইকোলজি অ্যান্ড সাইকোথেরাপি। এতে শিশুরা দিবাস্বপ্ন দেখা, মনোযোগ আকর্ষণ এবং বিচ্ছিন্ন থাকায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে পূর্বজন্মের স্মৃতি না থাকা শিশুদের চেয়ে।
তবে এই পরিস্থিতি এতোটা উদ্বেগজনক নয় বলেও জানাচ্ছেন গবেষকরা।
৪২ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি অংশ নিয়েছিলেন আরেকটি গবেষণায়, যা প্রকাশ করেছে জার্নাল অব সায়েন্টিফিক এক্সপ্লোরেশন।
এই গবেষণা অবশ্য বলছে, পূর্বজন্মের স্মৃতি থাকার পরও এই জন্মে তারা স্বাভাবিক, সুখী এবং স্বাস্থ্যকর জীবন কাটাচ্ছেন। পূর্বজন্মের স্মৃতি এদের জীবনে হয় ইতিবাচক হয়ে দেখা দিয়েছে অথবা কোনো প্রভাবই ফেলেনি।
অংশ নেয়া ব্যক্তিদের অর্ধেক মনে করেন, পূর্বজন্মের স্মৃতির কারণে পুনর্জন্মে বিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন তারা এবং এ কারণে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের মাত্রাও বেড়েছে।
কেউ কেউ অবশ্য বিপত্তির মুখে পড়েছেন। যেমন অন্যেরা এসে বারবার পূর্বজন্মের গল্প জানতে চায়। কেউ কেউ পূর্বজন্মের স্মৃতি নিয়ে বলায় শৈশবে হাসাহাসির শিকার হয়েছেন। কারো আবার এখনকার জীবনে অনেক ভয় বয়ে বেড়াতে হচ্ছে যা আসলে তাদের পূর্বজন্ম থেকেই এসেছে।
তবে এদের বেশির ভাগ বর্তমান জীবনকেই ভালো মনে করছেন, আগের জীবনের চেয়ে।
ফোর্বস বলছে, পুনর্জন্মে বিশ্বাস রাখার মধ্যে দিয়ে মৃত্যু নিয়ে ভয় কমে আসে।
“শিশু বয়সে আমি আমার গ্রেট গ্র্যান্ডপ্যারেন্টকে হারিয়েছিলাম। তাদের মৃত্যুশোকের ধাক্কা কমে আসে যখন আমি বুঝতে শুরু করি তারা আবার ফিরে আসবে। তাদের জন্য একটি নতুন সূচনা হতে চলেছে”; ২৬ বছর বয়সী একজন গবেষণায় অংশ নিয়ে এভাবেই বলেছিল, যা নভেম্বরে প্রকাশিত হয়।
আগের জন্মের স্মৃতি বলতে পারা মানে হলো কারো পুনর্জন্ম ঘটেছে। এ নিয়ে এক ঘোরের মধ্যে বর্তমান সময় কাটতে পারে। আবার এই উপলব্ধি থেকে ওই ব্যক্তি বর্তমান সময়কে ঢেলে সাজাতেও পারে।
এখনও পর্যন্ত আগের জন্মের টুকরো স্মৃতি এক ধাঁধার মতো, যা স্মৃতির ধরন, চেতন-অবচেতন জগত এবং মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে অনেক অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে চলেছে।
(ফোর্বস অবলম্বনে)