Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

এক ছাত্রের গ্রেপ্তার ও হেফাজতে মৃত্যু এবং একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের ইতিবৃত্ত

মঈদুল ইসলাম। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

দেশে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে কয়েকজন ছাত্রসহ বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু এবং সারাদেশে ছাত্রসহ অনেক মানুষকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় অনেকেই এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন চাইছেন। এই প্রেক্ষাপটে ফিরে দেখা যেতে পারে দুই যুগেরও বেশি আগের একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের কথা। ১৯৯৮-এর ২৩ জুলাই ডিবি পুলিশের হেফাজতে বিবিএ-এর ছাত্র শামীম রেজা রুবেলের মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন, সরকারের জবাব এবং আদালতের সুপারিশ সমূহে উঠে এসেছিল কাউকে কখন কিভাবে গ্রেপ্তার করা যাবে, গ্রেপ্তারের সময় ও গ্রেপ্তারের পরে কি কি করতে হবে, কিভাবে আদালতে তোলা হবে এবং এসব ক্ষেত্রে পুলিশ ও জজ-ম্যাজিস্ট্রেটরা কী করবেন সেসব বিষয়। সেই বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের ইতিবৃত্ত সবিস্তারে তুলে ধরছেন মঈদুল ইসলাম।  

১. কমিশন গঠন, কমিশনের সুপারিশ ও হাইকোর্টে রিট

বিনা পরোয়ানায় [‘সিআরপিসি’-র ৫৪ ধারায়] গ্রেপ্তার কখন করতে পারে, গ্রেপ্তার করতে (পরোয়ানা পেয়ে বা পরোয়ানা ছাড়াই) কেমনভাবে যাবে, গিয়ে কী কী সব করবে, গ্রেপ্তার করে আনার পরেই-বা কী কী করবে, গ্রেপ্তারকৃতকে আদালতে তোলা হলে আমল গ্রহণকারী জজ-ম্যাজিস্ট্রেটই-বা কী কী আমল করবে ইত্যাদি সব ঠিক করে দিয়ে পুলিশের (এবং র‌্যাব ও আইন প্রয়োগকারী অন্য সব সংস্থার) জন্য ১০ দফা আর, আমল গ্রহণকারী জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য ৯ দফা দিকনির্দেশনা (গাইডলাইনস) দিয়েছিলেন আমাদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, আজ থেকে আট বছরেরও বেশি আগে ২০১৬-র মে মাসে Bangladesh vs. BLAST কেসে [8 SCOB AD 1 = 69 DLR AD 63]।

আপিল বিভাগের ওসব নির্দেশনার বেশিরভাগই প্রথম এসেছিল সুপারিশ আকারে সেই ১৯৯৮ সালে, বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের এক সদস্যের বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে। কমিশনটা করেছিল তখনকার সরকার (১৯৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রথম সরকার)। ১৯৯৮-এর ২৩ জুলাই ডিবি পুলিশের হেফাজতে হতভাগ্য বিবিএ ছাত্র শামীম রেজা রুবেলের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত এবং এরকম হেফাজতে মৃত্যু নিবারণে সরকারের কোনো হাত (কিছু করার) আছে কিনা তার সুপারিশ করতে। সেই মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বিএনপিসহ তখনকার বিরোধী দলগুলো আর ব্লাস্টসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো হাত লাগায় গণ্ডগোল (সব আন্দোলনই সব সরকারের চোখে গণ্ডগোলই ঠেকে কিনা!) পাকাতে। সরকার তো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না! তাই, করেছিল ওই কমিশন। আর বসে ছিল কমিশনের ১১ দফা সুপারিশ পাবার পরে।

কী ছিল সেই সুপারিশে!  

ইংরেজিতে লেখা কমিশনের সুপারিশগুলোর বাংলা কথা হলো:

(ক) গ্রেপ্তার করতে যাওয়া প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে নিজ নিজ নাম-পদবীসহ সঠিক পরিচয়সম্বলিত ব্যাজ দৃশ্যমানভাবে ধারণ করতে হবে এবং গ্রেপ্তারকৃতকে জিজ্ঞাসাবাদে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের নাম-পরিচয় রেজিস্টারভুক্ত করতে হবে;

(খ) গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেপ্তারের সময় সেখানেই গ্রেপ্তারের স্থান, তারিখ ও সময় উল্লেখ করে এবং গ্রেপ্তারকৃতের পরিবারের সদস্য বা স্থানীয় সম্মানিত একজনের প্রত্যয়ন ও গ্রেপ্তারকৃতের প্রতিস্বাক্ষর নিয়ে একটি গ্রেপ্তার-মেমো তৈরি করবেন;

(গ) গ্রেপ্তার বা আটক করে থানা হাজতে বা জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে বা অন্য কোনো হাজতখানায় নেওয়া ব্যক্তির খবর যত দ্রুত সম্ভব তার হিতাকাঙ্ক্ষী আত্মীয় বা বন্ধুকে জানাতে হবে, যদি না তারা কেউ গ্রেপ্তার-মেমোতে প্রত্যয়নকারী সাক্ষী হয়ে থাকেন;

(ঘ) সেই আত্মীয় বা বন্ধু গ্রেপ্তারস্থান বা আটকস্থানের শহর বা জেলার বাইরে বাস করলে পুলিশ তাদেরকে জেলার লিগ্যাল এইড সংগঠনের মাধ্যমে গ্রেপ্তারের স্থান ও সময় এবং আটক রাখার স্থান জানাবে, আর ৮-১২ ঘন্টার মধ্যে টেলিগ্রাফ মাধ্যমে সেই আত্মীয়-বন্ধুদের সংশ্লিষ্ট থানায় জানাবে;

(ঙ) গ্রেপ্তার বা আটকের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেপ্তারকৃতের কাছ থেকে তার হিতাকাঙ্ক্ষী আত্মীয় বা বন্ধু যাদেরকে খবর জানাতে হবে তাদের নাম ঠিকানা জেনে নিতে হবে; 

(চ) কাকে কিভাবে জানানো হলো, আর গ্রেপ্তারকৃতকে পুলিশের কোন সদস্যের হেফাজতে কোথায় রাখা হলো সেসব অবশ্যই ডায়েরিতে লিখতে হবে;

(ছ) গ্রেপ্তারকৃত চাইলে গ্রেপ্তারের সময়েই তাকে ডাক্তার দেখাতে এবং তার শরীরে কোনো রকম জখম দেখা গেলে তারও উল্লেখ রাখতে হবে এবং পরিদর্শন মেমোতে গ্রেপ্তারকারী ও গ্রেপ্তারকৃতের স্বাক্ষর দিতে-নিতে হবে এবং তার কপি গ্রেপ্তারকৃতকেও দিতে হবে;

(জ) গ্রেপ্তারকৃতকে হাজতে রাখাকালে প্রতি ৪৮ ঘন্টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের অনুমোদিত প্যানেলের একজন ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে;

(ঝ) গ্রেপ্তার-মেমোসহ উপরে বর্ণিত সব কাগজপত্র স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের রেকর্ড রাখার জন্য পাঠাতে হবে;

(ঞ) জিজ্ঞাসাবাদকালে, পুরো সময়জুড়ে যদিও নয়, গ্রেপ্তারকৃতকে তার আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে;

(ট) সব জেলা সদরের পুলিশ কন্ট্রোলরুমে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে গ্রেপ্তারকারী কর্মকর্তা কাউকে গ্রেপ্তারের ১২ ঘন্টার মধ্যে ওই গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ও আটক রাখার স্থান সংক্রান্ত তথ্য পুলিশ কন্ট্রোলরুমে জানাতে পারে এবং সেসব তথ্য পুলিশ কন্ট্রোলরুমে সবার দৃষ্টিগোচর নোটিশ বোর্ডে প্রদর্শিত হতে হবে।

ওরে বাবা! হাতে তো শুধু নয়, একেবারে হাতেপায়ে বেড়ি দেখি এ যে! থামুন জনাব, এরকম বলছেন কী দেখে? ভালো করে দেখুন, ধরতে কি নিষেধ আছে সুপারিশে? বেপরোয়া গ্রেপ্তার-আটকে মানুষের রক্তের দাগ যেন না লাগে পুলিশের কারো হাতে, মানুষের জান যেন না যায় তাদের কারো হেফাজতে, এইটুকু শুধু মন দিয়ে কেয়ার (care) করার, পরোয়া করার রাস্তাটুকু বাতলিয়েছে। ‘Due care and attention’ না থাকলে শুধু শুধু ‘সরল বিশ্বাস’ (‘Good Faith’) থাকে না কোনো কাজে, বলা আছে ব্রিটিশের (১৮৬০ সালের) পেনাল কোডের ৫২ ধারাতে। সে-আলোচনা করা আছে আমার ‘গরল বিশ্বাস সরল দুর্নীতি’ প্রবন্ধে [‘যেমতি বিচারি আমি’ গ্রন্থে]।  

পেটের দায়ে পশুর ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করে যারা তাদের বলে কসাই, বিকৃত মনের সুখ মেটাতে যারা মানুষের ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করে তাদের কী বলবেন মশাই? সন্দেহভাজন বলে যাকে পরোয়ানায় বা বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার-আটকে আনা হলো সে অমানুষ কিনা প্রমাণ হবে বিচার শেষে, তার আগেতক তাকেও তো মানুষই বলতে হবে। মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপার থাকে তারও। দোষী সাব্যস্ত হলেই বা কী? বিচারের সাজাটুকু শুধু ভোগ করবে, মানবাধিকার যাবে না ঘুঁচে। গ্রেপ্তার-আটকের কাজে পুলিশের এবং হাতকড়া নিয়ে ঘোরা অন্যসব আইনপ্রয়োগকারীদের বাড়াবড়িতে (বাড়াবাড়ির কথাটা কোর্টে গিয়ে বলেছে আইন ও বিচার দুই-ই রাখার ভার বওয়া আইন-বিচার মন্ত্রণালয়, দেখাচ্ছি ৩য় অংশে) মানবাধিকারের এইটুকু বেড়ি পড়লে সরকার অচল হবে নাকি? ধরপাকড়ের কাজে হাতকড়াওয়ালারা সবে এটুকু দায়িত্বশীল হলে প্রজাসাধারণের জান বাঁচে, নিজেরাও বাঁচে অপঘাতকের অপবাদ থেকে। আখেরে সরকারেরই কাজে দেয় তাতে। মানবাধিকারের বেড়িটা দিতে হাত লাগানো তো সরকারেরই দায়।

কিন্তু, সরকার ঠাঁই রইল গাঁট হয়ে বসে। সরকারের করা কমিশনের দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার হাত দিচ্ছে না বলে ব্লাস্ট (এবং আরও দুটি সংগঠন ও পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি) হাইকোর্টে গিয়ে জনস্বার্থে রিট ঠুকে দেয় ১৯৯৮ সালেই (রিট পিটিশন নম্বর-৩৬০৮/১৯৯৮, ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ)। শিকেয় উঠল সুপারিশ, সরকার নামল রিটের মামলা লড়তে।

সরকারের জবাব কী?

১৯৯৮ সালের সেই রিটের বিরোধিতায় তখনকার সরকারপক্ষে জবাব দিয়েছিল নিজ রাষ্ট্রের ভেতরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের রক্ষক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘এফিডেভিট-ইন-অপোজিশন’ দিয়ে। ইংরেজি সে-কথাগুলোর বাংলা সারকথা হলো:

(ক) পুলিশ কাজ করে সিআরপিসি, পিআরবি, পুলিশ অ্যাক্ট সব আইন মেনেই;

(খ) আইডি-কার্ড লুকিয়ে রেখে সাদা পোশাকে যায় অপরাধ ও নিরাপত্তার গোপন   সংবাদ সংগ্রহের আগ্রহে;

(গ) নিশি রাতে যায় থানা এলাকার বাসিন্দা নয় যারা তাদেরকে ধরতে;

(ঘ) নিশি রাতে সাক্ষী হওয়ার কাউকে আর না পাওয়ায় সাক্ষী রাখা যায় না; নিশি রাতের গ্রেপ্তারকৃতরা ভাসমান, ঠিকানাহীন বলে গ্রেপ্তারের খবর তাদের স্বজনদের জানানো যায় না; গ্রেপ্তার-আটকে আইনকানুন মেনে চলায় এইটুকু শুধু ব্যতিক্রম হয়ে থাকে;

(ঙ) তবে কিনা, গ্রেপ্তারের খবর সঙ্গে সঙ্গে স্বজনদের জানিয়ে দেওয়া হলে সব গুমর ফাঁক হয়ে পুলিশের সত্যানুসন্ধানের আসল কাজটাই যাবে ভেস্তে, আর উকিল সামনে রেখে জিজ্ঞসাবাদ করতে হলে তো তদন্তই হবে মাটি।

আহা, কী জবাব! লা’জবাব একেবারে! পুলিশও বুঝি লজ্জা পেত নিজ মুখে এতখানি সাফাই গাইতে! হেফাজতে মৃত্যু ঠেকাবার, মানবাধিকার রক্ষার কী হবে কার হাতে? সেসবের কোনো জবাব নেই তাতে। এই ছিল তবে সরকারের মনে! বিচারপতি দিয়ে কমিশনটা করা হয়েছিল বুঝি শুধু আন্দোলনের গণ্ডগোলটা মাঠে মেরে দিতে! বেধড়ক ধরপাকড়ে লাগাম ছেড়ে রাখা লাগে শুধু ক্ষমতার দাপট দেখাতে গেলে। দাপট না দেখাতে পারলে বুঝি সুখ আসে না ক্ষমতায় বসে! মানুষের জীবন, মানবাধিকার এসবের চেয়ে সরকারের কাছে বড়ো হলো দাপটের আবদার!

সন্দেহভাজন বলে কিছু লোকের যদি হেফাজতে মৃত্যু ঘটে তো “আল্লাহর মাল …”! [“আল্লাহই নিয়েছে” বলে সান্ত্বনা দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নিজে] বান্দা সরকারের আর হাত নেই তাতে! হেফাজতে মৃত্যু রইল আল্লাহর ওয়াস্তে! কমিশনের সুপারিশ আটকে রইল হাইকোর্টে। চলতে থাকল রিটের মোকদ্দমা খেলা!

২. হাইকোর্টের রায়

১৯৯৮ সালের সরকারের (আওয়ামী) আমলের রিট [উদ্ভবের প্রেক্ষাপট দেখুন এ-প্রবন্ধের ১ম অংশে] চলতে চলতে থামল শেষে পাঁচ-পাঁচটা বছর পার করে, নিষ্পত্তি হলো গিয়ে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল আরেক সরকারের (বিএনপির চারদলীয় জোটের) আমলে। হেরে যায় সরকার। জেতার কি কোনো জো রেখেছিল যে জিতবে? ছিল তো শুধু গ্রেপ্তার-আটকে বাড়াবাড়ির লাগাম ছেড়ে রাখার একগুঁয়ে গোঁ। [রিটের বিরোধিতায় সরকারের জবাব দেখুন এ-প্রবন্ধের ১ম অংশে] হাইকোর্ট সেই রায়ে [BLAST vs Bangladesh, 55 DLR 363] ব্রিটিশের আইনের ধারা বাঙালির যার যার মতলবমতো বোঝা আর প্রয়োগের খাসলত ছোটাতে কী করে কী করতে হবে সব একেবারে খোলাসা করে আইনেই বাতলে দিতে সুপারিশ করে সরকারেকে।

কী ছিল সেই সুপারিশে?

ইংরেজিতে লেখা সুপারিশগুলোর বাংলা মোদ্দা কথা হলো: 

(ক) বিনা পরওয়ানায় গ্রেপ্তারের ৫৪ ধারা (সিআরপিসির),

(খ) পুলিশ রিমান্ডের ১৬৭ ধারা (সিআরপিসির)

(গ) হেফাজতে মৃত্যুতে করণীয়ের ১৭৬ ধারা (সিআরপিসির),

(ঘ) জুডিসিয়াল ইনকোয়ারির ২০২ ধারা (সিআরপিসির), আর

(ঙ) পুলিশের জিডি এন্ট্রির ৪৪ ধারা (পুলিশ অ্যাক্টের)

জুতমতো সংশোধন করতে হবে (নির্দেশিত সংশোধনীর খসড়াটাও করে দেওয়া ছিল হাইকোর্টের রায়ে); তাতে সুপারিশ ছিল আরও:

(ক) স্বীকারেক্তি বা তথ্য আদায়ের উদ্দেশ্যে জখমে সাজার ৩৩০ ধারায় (পেনাল কোডের), আর স্বীকারেক্তি বা তথ্য আদায়ের উদ্দেশ্যে অন্যায় আটকে সাজার ৩৪৮ ধারায় (পেনাল কোডের) ক্ষতিপুরণের বিধান সংযোজনসহ কারাদণ্ডের মেয়াদ বাড়িয়ে (পুলিশ হেফাজতে জখম গুরুতর না হলে সর্বনিম্ন ৭ ও সর্বোচ্চ ১০ বছর, আর জখম গুরুতর হলে সর্বনিম্ন ১০ বছর এবং পুলিশের অন্যায় আটকে সর্বনিম্ন ৩ বছর কারাদণ্ডের প্রস্তাব ছিল রায়ে) সংশোধন করতে হবে; 

(খ) পুলিশ ও জেল হেফাজতে মৃত্যু ঘটাবার ক্ষতিপূরণসহ শাস্তি বিধানে পেনাল কোডে নতুন ধারা 302A বসাতে হবে।

হাইকোর্ট সেই রায়ে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটেদের হুঁশ করে কাজ চালিয়ে যাবার জন্য ১৫ দফা নির্দেশনাও বেঁধে দিয়েছিল এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন করতে যার যার কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিল। ইংরেজিতে লেখা নির্দেশনাগুলোর বাংলা দাঁড়ায় মোটোমোটি এরকমের:

(১) ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারায় নিবর্তনমূলক আটক (preventive detention) রাখার উদ্দেশ্যে পুলিশ কাউকে সিআরপিসির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না;

(২) গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তা অবশ্যই নিজের পরিচয় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি ও গ্রেপ্তারের সময় উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে প্রকাশ করবে এবং তারা চাইলে নিজের পরিচয়পত্রও দেখাবে;

(৩) গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তা অবশ্যই গ্রেপ্তারের কারণসহ অন্যান্য বিবরণ একটি ‍পৃথক রেজিস্টারে লিখে রাখবে;

(৪) গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোনো জখম দেখতে পেলে অবশ্যই তার কারণ নথিভুক্ত করবে এবং চিকিৎসার জন্য তাকে নিকস্থ হাসপাতালে বা সরকারি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে এবং চিকিৎসা দেওয়া ডাক্তারের সার্টিফিকেট নেবে;

(৫) গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তা অবশ্যই গ্রেপ্তারকৃতকে থানায় নিয়ে আসার তিন ঘন্টার মধ্যে তাকে গ্রেপ্তারের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবে;

(৬) নিজ বাড়ি বা কর্মস্থল ছাড়া অন্য কোথাও থেকে গ্রেপ্তার করা হলে থানায় আনার এক ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তা অবশ্যই সে-খবর টেলিফোন (যদি থাকে) বা পত্রবাহক মারফত গ্রেপ্তারকৃতের নিকটাত্মীয়কে জানাবে;

(৭) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি চাইলে গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তা অবশ্যই তাকে তার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের এবং নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেবে;

(৮) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে সিআরপিসির ৬১ ধারানুযায়ী নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার সময় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা সিআরপিসির ১৬৭(১) ধারানুযায়ী প্রদত্ত পুলিশ ফরোয়ার্ডিংয়ে অবশ্যই বর্ণনা করবেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেন তদন্ত সমাপ্ত হয়নি, কেন গ্রেপ্তারকৃতের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা তথ্যের যথেষ্ট ভিত্তি আছে বলে তার মনে হয় এবং তার সঙ্গে অবশ্যই কেস ডায়েরির সংশ্লিষ্ট অংশের কপিও দাখিল করবেন; 

(৯) সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ ফরোয়ার্ডিংয়ের বিবরণ বিবেচনায় গ্রেপ্তারকৃতের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা তথ্যের যথেষ্ট ভিত্তি আছে বলে এবং তাকে আটক রাখার যথেষ্ট উপাদান কেস ডায়েরিতে আছে বলে সন্তুষ্ট হলে তবেই তাকে জেল হাজতে আটক রাখার আদেশ দেবেন, তা না হলে তক্ষুনি তাকে মুক্তি দেবেন;

(১০) সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগ বা তথ্যের যথেষ্ট ভিত্তি না থাকা ও আটক রাখার কোনো উপাদান কেস ডায়েরিতে না থাকার কারণে গ্রেপ্তারকৃতকে মুক্তি দিলে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২২০ ধারার অপরাধে সিআরপিসির ১৯০(১)(ক) ধারার ক্ষমতাবলে আমল গ্রহণ করবেন;    

(১১) সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে জেল হাজতে আটক রাখার আদেশ দিলে তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্তের জন্য প্রয়োজন মনে করলে তাকে জেলের ভেতরে একটি কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন;

(১২) তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেবার দরখাস্তে অবশ্যই তার বিস্তারিত কারণ বর্ণনা করবেন;

(১৩) পুলিশ-রিমান্ড মঞ্জুর করলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্যই হাইকোর্টের এই রায়ে বর্ণিত সুপারিশসমূহ অনুসরণ করবেন;

(১৪) জেল বা পুলিশ হেফাজতে কারো মৃত্যু ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই জেলার বা পুলিশ হেফাজতে নিয়ে আসা গ্রেপ্তারকারী/তদন্তকারী কর্মকর্তা সে-খবর নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জানাবেন;

(১৫) জেল বা পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই সেই ম্যাজিস্ট্রেট হাইকোর্টের এই রায়ে বর্ণিত সুপারিশ অনুসরণে ইনকোয়ারি পরিচালনা করবেন;      

২০০৩ সালে দেওয়া হাইকোর্টের সেই রায় মনঃপূত হলো না তখনকার সরকারেরও। তাদের মন পুড়ে তখন পুলিশের নির্বিচার গ্রেপ্তারির সম্ভাব্য বেকারত্বে। সরকারে তখন বিএনপির চারদলীয় জোট বসে, ১৯৯৮ সালে যারা বিরোধী দলে থাকতে ছিল ডিবি পুলিশ হেফাজতে এই মৃত্যুর ঘটনায় [সে-কেচ্ছা আছে এ-প্রবন্ধের ১ম অংশে] সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে। সরকারে এসে ক্ষমতায় বসে উল্টে যায় তাদের মন পুলিশের পক্ষে! হেফাজতে মৃত্যু আল্লাহর ওয়াস্তে রেখে তারা হাত লাগায় রিটে দেওয়া হাইকোর্টের সুপারিশ-নির্দেশনার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে ‘লিভ পিটিশন’ (আপিলের পূর্বানুমতির দরখাস্ত) করতে, দাখিল করে সিপিএলএ ৪৯৮/২০০৩। হাইকোর্টের সুপারিশ-নির্দেশনাও শিকেয় তুলে শুরু হলো এবার আপিলের মোকদ্দমা খেলা!

কে বলে সরকার বদলায়? দেখছি তো শুধুই বদলায় রাজনৈতিক দল! সরকারে এসে ক্ষমতায় বসে গেলেই সে-দল নিমিষেই ভোল পাল্টিয়ে শাসকের উৎপীড়ক বিকট রূপ ধারণ করে বদলে নেয় নিজেকেই, ‘সার্ভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ তত্ত্বের উল্টোটাই সত্যি করে! সরকার থেকে বিদায় ঘটলে সে-দলই আবার নিমিষে ভোল পাল্টিয়ে শাসন-পীড়ন বিরোধী অতিদরদী রূপ ধরে। ক্ষমতায় গেলে শাসক-পীড়ক-বিকট বেদরদী, ক্ষমতা হারালে অতিদরদী, এই দুই রূপ একই দলের একই অঙ্গে। এই-ই তাদের একে অপরকে ঠেলে ফেলে ক্ষমতায় টিকে থাকা আর উঠে আসা খেলার কৌশল। ক্ষমতায় উঠে আসতে পারলেই বেধড়ক ধরপাকড়ই হবে অপরকে ঠেলে ফেলে টিকে থাকার হাতিয়ার। দলে দলের ক্ষমতা কাড়াকাড়ির নোংরা খেলার ঠেলার চোটে প্রাণ যায় গণ প্রজাদের। সরকার থাকে চিরকাল শাসকের উৎপীড়ক বিকট রূপ ধরে, রাষ্ট্রযন্ত্র বারে বারে কটকট যন্ত্রণাই উৎপাদন করে। গণপ্রজাতন্ত্রে চলছে বেশ গণতন্ত্র খেলা!

(দ্বিতীয় কিস্তির লিংক)

লেখক: কলামিস্ট, প্রবন্ধকার ও আইনগ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।ইমেইল: [email protected]

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত