Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

এক ছাত্রের গ্রেপ্তার ও হেফাজতে মৃত্যু এবং একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের ইতিবৃত্ত-২

মঈদুল ইসলাম। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

দেশে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে কয়েকজন ছাত্রসহ বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু এবং সারাদেশে ছাত্রসহ অনেক মানুষকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় অনেকেই এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন চাইছেন। এই প্রেক্ষাপটে ফিরে দেখা যেতে পারে দুই যুগেরও বেশি আগের একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের কথা। ১৯৯৮-এর ২৩ জুলাই ডিবি পুলিশের হেফাজতে বিবিএ-এর ছাত্র শামীম রেজা রুবেলের মৃত্যুর ঘটনায় গঠিত বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন, সরকারের জবাব এবং আদালতের সুপারিশ সমূহে উঠে এসেছিল কাউকে কখন কিভাবে গ্রেপ্তার করা যাবে, গ্রেপ্তারের সময় ও গ্রেপ্তারের পরে কি কি করতে হবে, কিভাবে আদালতে তোলা হবে এবং এসব ক্ষেত্রে পুলিশ ও জজ-ম্যাজিস্ট্রেটরা কী করবেন সেসব বিষয়। সেই বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের ইতিবৃত্ত সবিস্তারে তুলে ধরছেন মঈদুল ইসলাম। 

(প্রথম কিস্তির পর)

প্রথম কিস্তির লিংক

৩. আপিল বিভাগে সরকারের আপিল

লিভ পিটিশনে (সিপিএলএ ৪৯৮/২০০৩) অনুমতি পাবার সঙ্গে সঙ্গে ২০০৪ সালে তখনকার (বিএনপির চার দলীয় জোটের) সরকার আপিল বিভাগে আপিল করে (৫৩/২০০৪ নম্বর সিভিল আপিল)। তাজ্জব কি বাত হলো: সেই আপিলে এক নম্বর আপিলকারী ছিল আইন-বিচারের রক্ষক ‘আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়’, যেখানে একজনও পুলিশের লোক নেই, বিচারকাজ রেখে আসা সক্কলে। সেখানে মন্ত্রী নিজে সুপ্রিম কোর্টের প্র্যাকটিস রেখে আসা সিনিয়র আইনজীবী; আর বাকি সবাই ডেপুটেশনে আসা অধস্তন আদালতের বিচারক, যাদেরকে আনা হয় সুপ্রিম কোর্টের সম্মতি নিয়েই! সরকারের পক্ষে আপিলের ‘লিভ পিটিশন’ করা না করার, তারও আগে রিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা না করার মেরিট যাচাই করে মতামত দেওয়ার কাজটাও করে এই মন্ত্রণালয়ের ডেপুটেশনে আসা বিচারকে ঠাসা ‘সলিসিটর উইং’, শেষ সিদ্ধান্তটা হয় এই মন্ত্রণালয়েই। আইনের কারবারি আর বিচারকারীরা আইন-বিচার মন্ত্রণালয়ে এসে হাত লাগালেন নির্বিচারি গ্রেপ্তারির পক্ষে! বিচারকাজ রেখে আসা দু-দিনের আমলাগিরিতে বসা সংকরআমলারা নিমিষেই হয়ে ওঠেন খাসআমলার চেয়েও পাকা আমলা!

তার প্রমাণ রেখেছে তারা বারে বারে নিজেদের কাজে। আগে একবার রেখেছে এই রিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পক্ষে মতামত-সিদ্ধান্ত দিয়ে। রিটে হেরে আরো বেশি করে রেখেছে আপিল করার পক্ষে মতামত-সিদ্ধান্ত নিয়ে ১ নম্বর আপিলকারী সেজে। সেই লিভ পিটিশন ও সিভিল আপিলের পক্ষে যেসব অজুহাত (grounds) তোলা হয় তার বাংলা সারকথা হলো:

(ক) ব্রিটিশের আইনের (সিআরপিসি, পিআরবি, পুলিশ অ্যাক্ট) কোনো দোষ নাই, আমাদের সংবিধানের সঙ্গেও তার কোনো সংঘর্ষ নাই, দোষ হলে হতে পারে তার প্রয়োগে পুলিশের টুকটাক বাড়াবাড়িতে [এই কথাই বলেছিলাম এ-প্রবন্ধের ১ম অংশে];

(খ) শুধু তো এক ৫৪ ধারা নয়, গ্রেপ্তারে পুলিশের ধারার অন্ত নেই [খাঁটি কথা একেবারে], তাদের বাড়াড়িতে বেড়ি দিতে তাই আইনে সংশোধন বা দিকনির্দেশনা দিয়ে লাভ নাই; বরং বাড়াবাড়ির খবর পেলে একটা একটা করে ধরে বিচারে, আপিলে, রিভিশনে আদালতই সব ঠাণ্ডা করে দিতে পারে নিজ হাতে;

(গ) আইন সংশোধন করতে বলাটাই বরং বাড়াবাড়ি, রায়ে অমন কথা লেখার হাতই দেয়নি সংবিধান হাইকোর্টকে।  

এসব কি অজুহাত হলো আপিলের! শক্তপোক্ত একটাও নেই, সবই খোঁড়া যে! হেফাজতে মৃত্যু ঠেকানো, মানবাধিকার রক্ষা সব শুধু একা আদালতের হাতে? সরকারের কোনো হাত নেই কোনোটাতে? ধারাগুলো জুতমতো মেরামত করে আইন সংশোধন করে দিলে, দিকনির্দেশনাগুলো মেনে চলতে বললে কোন পাকা ধানে মই পড়বে সেই অসুবিধার একটা কথাও বলার মতো নেই? ছুতানাতায় সংবিধান টানা!

মানবাধিকার রক্ষায় সরকারেরও হাত লাগাবার কথা যে লেখা আছে তার বুকে, সেদিকেতে চোখ নেই! এ তো শুধু গ্রেপ্তার-আটকের বাড়াবাড়িতে লাগাম ছেড়ে রাখার সেই একগুঁয়ে গোঁ। সর্বসাধারণের স্বার্থকে জলে অঞ্জলি দিয়ে [হাল আমলের ভাষায়: বুড়িগঙ্গার নোংরা কালো জলে ডুবিয়ে (সেটাই এখন জনা-আবর্জনা, সুশীল-অশীল সব ডোবাবার যোগ্য জলাশয় কিনা! কিংবা, পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে টুস করে নদীতে ফেলে!)] সরকারি স্বার্থের ধুয়া তুলে নিজেদের শ্রেণিগোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলে তলে তলে কত অদ্ভুত মিল আপাত বৈরী সব দলে দলে!

শুনানির ধোপে টেকেনি সরকারের ওসব খোঁড়া অজুহাত আপিলে। ২০০৪ সালের এক সরকারের আমলের আপিল এক যুগ বারো বছর ঝুলে থেকে নিষ্পত্তি হলো ২০১৬-তে (২৪ মে) আরেক সরকারের আমলে, ১৯৯৮-তে যাদের আমলে শুরু হয়েছিল রিটের এ-মামলা, হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় নিজেদের করা বিচারবিভগীয় কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে হাত না লাগানোতে। [তার আলোচনা হয়েছে এ-প্রবন্ধের আগের অংশগুলোতে] মাঝখানে দেড় যুগে কেটে গেছে আঠারোটা বছর [মামলাকারীদের চালে বিচারের কী হাল!]। হেরে যায় সরকার আপিল বিভাগেও। আইন সংশোধন করা থেকে মাফ পায় ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩’ দেখিয়ে। এ-আইনের প্রস্তাবনায় দোহাই পাড়া হয়:

“যেহেতু ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ডবিরোধী একটি সনদ স্বাক্ষরিত হইয়াছে; এবং

যেহেতু ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর স্বাক্ষরিত দলিলের মাধ্যমে উক্ত সনদে বাংলাদেশও অংশীদার হইয়াছে; এবং

যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করিয়াছে; এবং  

যেহেতু জাতিসংঘ সনদের ২(১) ও ৪ অনুচ্ছেদ নির্যাতন, নিষ্ঠুর, অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করিয়া নিজ নিজ দেশে আইন প্রণয়নের দাবি করে; এবং

যেহেতু বাংলাদেশে উপরিউক্ত সনদে বর্ণিত অঙ্গীকারসমূহের কার্যকারিতা প্রদানে আইনী বিধান প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়;

সেহেতু এতদ্‌দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল:— ”

হায় হায়! এত কাণ্ড করে এত দিন পরে এসে এ কী কথা সরকারের মুখে! নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে মানবাধিকারের এত কথা বলা ছিল ১৯৭২-এ আমাদেরই সংবিধানে! নির্যাতন-নিপীড়ন নিবারণের বিধিব্যবস্থা একটাও তবু করেননি! তারও এক যুগ পরে ১৯৮৪-তে বলেছে জাতিসংঘ সনদে। তাতে শুধু স্বাক্ষরটা করতেই কাটিয়ে দিলেন আরো এক যুগ, বারো বছর! ১৯৯৮-তে স্বাক্ষরটা দিয়েই উল্টো আবার নিবারণ আটকাতে নেমে পড়লেন রিটের মামলা লড়তে! [এ-প্রবন্ধের আগের পর্বগুলো দেখুন] রিটে হেরে আবার আপিলটাও ঠুকলেন! কীসের জেদে? কার স্বার্থে? ২০১৩-তেই যদি ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’-টা করলেন তবে কেন ২০১৬ পর্যন্ত আপিলটা টানলেন! মাঝখানে এত বছরে কত মানুষ হেফাজতে নির্যাতন-মৃত্যুর শিকার হলো [তার খবর কিছু (সব তো আর খবর হয় না) আছে পত্রিকার পাতাতে। তার থেকে নিয়ে ১৯৯৭-এর জানুয়ারি হতে ২০০৩-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের চিত্রটা তুলে ধরে ওই রিটে ব্লাস্ট-এর সঙ্গে থাকা দরখাস্তকারী ‘আইন ও সালিস কেন্দ্র’।] তার কী করলেন! নিবারণী এ-আইনের বিলটাই-বা সংসদে কেন সরকার থেকে না এনে নিজ দলের এক সংসদ সদস্যকে দিয়ে বেসরকারি বিল আকারে আনালেন! ২০০৯-এর সেপ্টেম্বরে আনার পরে সে-বিল ফেলে রেখে চারটা বছর বসে বসে আবার এত কী ভাবলেন? নাকি অধীনস্থ পুলিশ বাহিনীর বাধা সামলালেন? এ দেখি আরেক গোলকধাঁধাঁ যে!

২০০৪ সালে লিভ পিটিশন মঞ্জুর করে আপিলের অনুমতি দেওয়ার সময়েই আপিল বিভাগ সরকারকে ঠিক ঠিকভাবে আইন মেনে চলার এবং রিটে হাইকোর্টের দেওয়া সেই ১৫ দফা নির্দেশনা [নির্দেশনাগুলো দেখুন এ-প্রবন্ধের ১ম পর্ব] ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন। ২০১৬ সালে আপিল শুনানির সময়ে [২২ মার্চ এবং ১১ ও ২৪ মে] আপিল বিভাগ বারো বছর আগের দেওয়া সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকার কতটুক হাত লাগিয়েছে তার খবর চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বার বার সময় নিয়েও কিছুই জানাতে পারেননি। সরকার কিছু করে থাকলে তো তিনি জানাবেন! দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া নির্দেশনার একটাও সুদীর্ঘ এই বারো বছরে কোনো সরকারই বাস্তবায়ন করেনি। বিচারকে বুড়ো আঙুল দেখাবার এত বড়ো ধার্ষ্টামি আর কোন দেশে কোন সরকারে করে!

খুঁজে পায়নি আপিল বিভাগ। খেদ ঝেড়ে ক্ষোভ প্রশমন করে রায়ে। কাজ নেই আর আইন সংশোধনে, ২০১৩ সালে করা নিবারণ আইনে যেটুকু হয়েছে তাতেই চলবে। ব্রিটিশের আইনের (সিআরপিসি, পিআরবি, পুলিশ অ্যাক্ট) আসলে কোনো দোষ নেই, আমাদের সংবিধানের সঙ্গেও তার খুব একটা সংঘর্ষ নেই, যত দোষ ওই প্রয়োগকারীদের বাড়াবাড়িতে বলে সরকারের কথাই সঠিক সাব্যস্ত করেন আপিল বিভাগ। শুধু আইন হাতে দিয়ে প্রয়োগকারীদের ছেড়ে রাখা ‍নিরাপদ নয়, বাড়াবাড়িতে একটুখানি বেড়ি দিতেই হবে। সব শুধু একা আদালতের হাতে নয়, সরকারকেও হাত লাগাতে হবে সাথে।

বাদ গেল আইন সংশোধনের সুপারিশ (রিটে হাইকোর্টের দেওয়া)। ঘুরে ফিরে গ্রেপ্তার-আটকে থাকল শুধু দিকনির্দেশনা (গাইডলাইনস)। গ্রেপ্তার-আটককারীদের (পুলিশ ও র‌্যাবসহ সবার) জন্য ১০ দফা, আর আমল গ্রহণকারী জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য ৯ দফা। নিজে বানিয়ে দেন আপিল বিভাগ সেই রায়ে।

কী বলা ছিল সেই দিকনির্দেশনাগুলোতে?

৪. আপিল বিভাগের রায় পরিণতি 

সেই আপিলে গ্রেপ্তার-আটকের কাজে পুলিশ ও র‌্যাবসহ অন্য সবার জন্য অবশ্য পালনীয় ১০ দফা, আর হাজত-রিমান্ডে পাঠাবার কাজে আমল গ্রহণকারী জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য অবশ্য পালনীয় ৯ দফা দিকনির্দেশনা (গাইডলাইনস) দেন আপিল বিভাগ। ইংরেজিতে লেখা সে-নির্দেশনাগুলোর বাংলা দাঁড়ায় মোটোমোটি এরকমের:

গ্রেপ্তার-আটককারীদের অবশ্য পালনীয় দিকনির্দেশনা –

(১) গ্রেপ্তার করার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেপ্তারের তারিখ ও সময় উল্লেখ করে গ্রেপ্তারকৃতের স্বাক্ষর নিয়ে একটি মেমো তৈরি করতে হবে গ্রেপ্তারকারীকে।

(২) গ্রেপ্তারের ১২ ঘন্টার মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব গ্রেপ্তারের তারিখ, সময় ও স্থান এবং আটক রাখার স্থান উল্লেখ করে সেই খবর গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে বা তেমন কেউ না থাকলে বন্ধুকে জানাবে গ্রেপ্তারকারী;

(৩) গ্রেপ্তারের কারণ, যার দেয়া সংবাদের প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার নাম-ঠিকানা এবং গ্রেপ্তারকৃতের কোন আত্মীয় বা বন্ধুকে এ-খবর জানানো হয়েছে তার নাম-ঠিকানা এবং যে কর্মকর্তার হেফাজতে আটক রাখা হয়েছে তার নাম-পদবি ডায়েরিভুক্ত রাখতে হবে।

(৪) মামলা দায়ের না থাকলে গ্রেপ্তারকৃতকে জেল হাজতে বা পুলিশ রিমান্ডে আটক রাখতে চাওয়া যাবে না।

(৫) ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারায় ডিটেনশনে রাখার উদ্দেশ্যে কাউকে সিআরপিসির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা যাবে না। 

(৬) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি ও সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে গ্রেপ্তারকারী কর্মকর্তা নিজের পরিচয় অবশ্যই জানাবে এবং চাইলে পরিচয়পত্রও দেখাবে।

(৭) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোনো জখমের চিহ্ন দেখতে পেলে গ্রেপ্তারকারী কর্মকর্তা তার কারণ লিখে রাখবেন এবং চিকিৎসার জন্য গ্রেপ্তারকৃতকে কাছাকাছি হাসপাতালে নিয়ে যাবেন এবং চিকিৎসা দেয়া ডাক্তারের কাছ থেকে তার সার্টিফিকেট নেবেন।

(৮) কাউকে তার বাড়ি বা কর্মস্থল ছাড়া অন্য কোথাও থেকে গ্রেপ্তার করা হলে তাকে থানায় আনার ১২ ঘন্টার মধ্যে তার নিকট আত্মীয়কে সে-খবর লিখিতভাবে গ্রেপ্তারকারী কর্মকর্তা জানাবেন।

(৯) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি চাইলে তাকে তার পছন্দমতো আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে ও নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে দেবে গ্রপ্তারকারী কর্মকর্তা।

(১০) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সোপর্দ করার সময় আইনের নির্ধারিত ২৪ ঘন্টার মধ্যে কেন তদন্ত শেষ করা যায়নি, কেন সে-ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ বা প্রাপ্ত তথ্যের যথেষ্ট ভিত্তি আছে বলে মনে হয় তা গ্রেপ্তারকারী কর্মকর্তা তার ফরোয়াডিংয়ে অবশ্যই বর্ণনা করবেন এবং কেস ডায়েরির সংশ্লিষ্ট অংশের কপিও অবশ্যই দাখিল করবেন।  

আমল গ্রহণকারী জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদের অবশ্য পালনীয় দিকনির্দেশনা – 

(১) আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কর্মকর্তা সিআরপিসির ১৬৭(১) ধারায় উল্লেখিত ডায়েরির কপি ছাড়া কাউকে রিম্যান্ডে নেবার বা জেল হাজতে আটক রাখার প্রার্থনা জানিয়ে হাজির করলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালত তৎক্ষণাৎ হাজিরকৃত কাছ থেকে সিআরপিসির ১৬৯ ধারার বিধান মোতাবেক বন্ড নিয়ে তাকে মুক্তি দেবেন।   

(২) আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কর্মকর্তা হাজতে থাকা কাউকে অন্য কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখাবার প্রার্থনা জানালে তাকে (আসামিকে) নতুন মামলার ডায়েরির কপিসহ হাজির না করা হলে, কিংবা সেমতো হাজির করা হলেও তাকে গ্রেপ্তার দেখাবার যথেষ্ট ভিত্তি না থাকলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালত গ্রেপ্তার দেখাবার প্রার্থনা নামঞ্জুর করবেন।  

(৩) পুলিশ ফরোয়ার্ডিং ও কেস ডায়েরি পর্যালোচনায় অভিযোগ বা তথ্যের যথেষ্ট ভিত্তি আছে বলে এবং গ্রেপ্তারকৃতকে আটক রাখার মতো যথেষ্ট উপাদান কেস ডায়েরিতে আছে বলে সন্তুষ্ট হলে ম্যাজিস্ট্রেট যেমন উপযুক্ত মনে করেন তেমন হেফাজতে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আটক রাখার বা অধিকতর আটক রাখার আদেশ দেবেন। 

(৪) ওই সব শর্ত পূরণ হলেও গ্রেপ্তারকৃতকে আটক রাখার ১৫ দিনের মধ্যে মামলাটির তদন্ত শেষ না হলে এবং মামলাটি দায়রায় বা ট্রাইব্যুনালে বিচার্য হলে ম্যাজিস্ট্রেট সিআরপিসির ৩৪৪ ধারায় আর বড়োজোর ১৫ দিনের আটকাদেশ দিতে পারবেন। 

(৫) নিরাপত্তা হেফাজতে আটক রাখার উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ ফরোয়ার্ডিং থেকে দেখা গেলে তাকে ম্যাজিস্ট্রেট কখনই জেল হাজতে আটক রাখার আদেশ দিতে পারবেন না।

(৬) আসামিকে যার সামনে হাজির করা হয় সেই ম্যাজিস্ট্রেট/ট্রাইব্যুনালের অবশ্য কর্তব্য হলো সিআরপিসির ১৬৭ ধারায় কোনো আদেশ দেবার আগে উপরে বর্ণিত নিয়মগুলি মানা হয়েছে কিনা তা দেখে নেওয়া;

(৭) আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য বা আটক করার আইনগত কর্তৃত্ব সম্পন্ন কোনো কর্মকর্তা আইন পরিপন্থী কাজ করেছেন বলে বিশ্বাস করার কারণ দেখলে ম্যাজিস্ট্রেট সেই সদস্য/কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২২০ ধারায় সাজার উদ্দেশ্যে কার্যক্রম শুরু করবেন।

(৮) আইন প্রয়োগকারী কোনো কর্মকর্তা কোনো আসামীকে রিমান্ডে নিলে রিমান্ডের মেয়াদ শেষে তাকে প্রকাশ্য আদালতে হাজির করা সেই কর্মকর্তারই দায়িত্ব এবং ওই আসামি মারা গেছে বলে পুলিশ রিপোর্ট থেকে বা অন্যভাবে জানা গেলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট ওই মৃত আসামিকে মেডিক্যাল বোর্ড দ্বারা পরীক্ষার নির্দেশ দেবেন, কবর দেওয়া হয়ে গিয়ে থাকলে মেডিক্যাল বোর্ড দ্বারা নতুনভাবে পরীক্ষার জন্য লাশ তোলার নির্দেশ দেবেন এবং তারপর মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্টে মৃত্যুটি হত্যা ধরনের বলে পাওয়া গেলে যার হেফাজতে থাকাবস্থায় ওই মৃত্যু ঘটেছে সেই কর্মকর্তা ও তার কমান্ডিং অফিসার বা সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩’-এর ১৫ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট আমল গ্রহণ করবেন।

(৯) ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩’–র ২ ধারার সংজ্ঞামতে হেফাজতে কেউ নির্যাতনের শিকার হয়েছে বা কারো মৃত্যু ঘটেছে বলে খবর থাকলে বা মনে করার কারণ দেখলে ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্যই তার কারণ বের করতে নির্যাতিতকে নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে আর মৃতের লাশটি মেডিক্যাল বোর্ডে পাঠাবেন, এবং নির্যাতন করা হয়েছে বা নির্যাতনের ফলে মৃত্যু ঘটেছে বলে মেডিক্যাল এভিডেন্স পেলে ম্যাজিস্ট্রেট ওই আইনের ৪ ও ৫ ধারায় মামলা রুজুর অপেক্ষা না করে সিআরপিসির ১৯০(১)(গ) ধারার ক্ষমতাবলে স্বপ্রণোদিত হয়ে অপরাধের আমল গ্রহণ করে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।

এতসব নির্দেশনা আর গাইডলাইন সবই আবার উঠলো শিকেয়। আপিল বিভাগের রায় বাস্তবায়ন না করে সরকার সঙ্গে সঙ্গে দাখিল করে রিভিউ। তাজ্জব কি বাত হলো, সেই রিভিউ সঙ্গে সঙ্গে নিষ্পত্তি না হয়ে এখনো আটকে আছে আপিল বিভাগের নিজেরই ঘরে। বুঝহ সুজন, ২০২৪ সালে এসে দীর্ঘ ২৬ বছরে আজ পর্যন্ত এই হলো পরিণতি ১৯৯৮ সালে গঠিত বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের ১৯৯৮ সালেই প্রদত্ত রিপোর্টের। বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের রিপোর্টই হোক আর বিচার বিভাগের রায়ই হোক, মানা না মানা সরকারের মর্জি, বুদ্ধি করে আবার ঢুকিয়ে দিতে পারে বিচার বিভাগেরই ঘরে, আটকে রাখতে পারে যুগ যুগ ধরে! এমন করে আটকে আছে কমিশনের আরো অনেক রিপোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের আরো অনেক রায়!    

২০১৩ সালের হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে মামলা করার সাহস তেমন দেখায়নি কেউ মোটে। নির্বিচারি গ্রেপ্তার আর হেফাজতে মৃত্যু কমেছে কি বেড়েছে তার খবর আছে পত্রিকার পাতাতে, ডিজিটালের আকাশে, মানবাধিকার সংঠনগুলোর কাছে, আর আছে ভুক্তভোগী দুর্ভাগা সব পরিবারের বুকে।   

পুনশ্চ :
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের করা লিভ পিটিশন আপিল বিভাগ মঞ্জুর করে আপিলের অনুমতি ২০০৪ সালে দিয়েছিল রিটে হাইকোর্টের দেওয়া ১৫ দফা নির্দেশনা [নির্দেশনাগুলো দেখুন এ-প্রবন্ধের ১ম কিস্তিতে ] ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করার শর্তে। তাহলে বাস্তবায়নের পরিপত্র না দেখে আপিল বিভাগে ২০০৪ সালে সরকারের সিভিল আপিলটি গ্রহণ করা হল কেন? কিভাবে? ধাপ্পা দেওয়া হয়েছিল কি কোর্টকে?    

আবার হঠাৎ কেন ২০১০ সালের ২৩ আগস্ট সরকারের আইন-বিচার মন্ত্রণালয় হাইকোর্ট বিভাগের সেই ১৫ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য আইজি পুলিশ, জেলা জজ, চিফ জুডিসিয়াল ও চিফ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্টের রায়ের কপিসহ বিচার-৪/১ এম-১১/২০১০-১০৪৪ নম্বর পরিপত্র জারি করেছিল, আর কেনই-বা তা অ্যাটর্নি জেনারেল ২০১৬ সালে শুনানির সময়ে আপিল বিভাগে দেখালেন না? চেপে যাবার কারণ কী? উদ্দেশ্যই-বা কী? সেটা কি হাইকোর্টের ১৫ দফা নির্দেশনা আপিল বিভাগে বাতিল করিয়ে নেওয়ার বুদ্ধিতে? সেটা হলে তবু সরকারের রিভিউ করার সঙ্গতি পাওয়া যায়। না হলে রিভিউ আবার কীসের জন্যে? 

এসব রহস্যের উত্তর আমার কাছে নেই।

(সমাপ্ত)

লেখক : কলামিস্ট, প্রবন্ধকার ও আইনগ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।
ইমেইল: [email protected]

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত