জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের পর এবার আওয়ামী লীগের শাসনামলে জোরপূর্বক গুম, খুন, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
সোমবার এ সংক্রান্ত আবেদনের শুনানির পর এ আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা।
আদেশে আসামিদের গ্রেপ্তারের পর ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে শুনানির জন্য দিন রেখেছে আদালত।
শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও বরখাস্ত হওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান।
আসামিদের মধ্যে জিয়াউল আহসান অন্য মামলায় এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
তাকে দেশে ফেরত পাঠাতে দিল্লির কাছে বাংলাদেশ সরকার চিঠি পাঠালেও এখন পর্যন্ত চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার ছাড়া আর কোনও প্রতিক্রিয়া আসেনি।
গত ১৭ অক্টোবর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় প্রসিকিউশনের আবেদনে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এরপর সোমবার ২০০৯-২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে জোরপূর্বক গুম, হত্যা, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগে জড়িতদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়ে ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানায় প্রসিকিউশন।
সেই আবেদনের ওপর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শুনানি করেন। শুনানিতে তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেখ হাসিনার নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য এসব অপরাধ করেছেন।
আদালতের আদেশের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রকিসিউটর তাজুল ইসলাম।
শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করা হয়েছিল মন্তব্য করে তাজুল বলেন, “এ সংস্কৃতির নাম গুম এবং ক্রসফায়ার। গুমের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে সাদা পোশাকে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা এসে তুলে নিয়ে যেত।
“তাদের অধিকাংশই পরে আর ফিরে আসত না। যারা ফিরেছেন, তাদেরকে সুনির্দিষ্ট একই প্যাটার্নের কিছু মামলায় আটক দেখানো হয়েছে। কাউকে গুলি করে ফেলে রাখা হয়। কেউ স্বৈরশাসনের অবসানের পর আয়নাঘর থেকে ফেরত আসেন।”
এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ দাবি করে তিনি বলেন, “গুমের মাধ্যমে বছরের পর বছর অসংখ্য মানুষকে গোপন কারাগারে আটক রেখে নির্যাতন, হত্যা এবং তাদের স্বাধীনতা বঞ্চিত করার যে অপরাধ, তা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত অপরাধ।
“বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনেও এসব মারাত্মক মানবতাবিরোধী অপরাধ।”
সেসব অপরাধের সঙ্গে বিগত শেখ হাসিনা সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সম্পৃক্ত করেছিল অভিযোগ করে চিফ প্রসিকিউর বলেন, “অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশে ও পরিকল্পনায়।
“একই সঙ্গে সেসময়ে সরকারের যেসব বাহিনী ছিল-পুলিশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনী-এসব বাহিনীর কিছু কিছু সদস্যকে প্রলোভন দেখিয়ে, বিদেশে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে, নানাভাবে পুরস্কৃত করে, পদক দিয়ে সংঘবদ্ধ পদ্ধতিতে এসব অপরাধমূলক কাজ করানো হয়েছিল।”
গণহত্যা থেকে এসব অপরাধ ভিন্ন প্রকৃতির হওয়ায় আসামিদের গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানানো হয় বলে জানান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রকিসিউটর তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “আবেদনের শুনানি শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। এদের মধ্যে একজন বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান কারাগারে আছেন।
“আসামিদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে আদালতে উপস্থাপনের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি এই মামলার পরবর্তী দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। সেদিন তদন্ত প্রতিবেদন এলে তা দাখিল করা হবে। গ্রেপ্তার সংক্রান্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।”
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার জাতি প্রত্যাশা করে বলে মনে করেন তাজুল ইসলাম।
২০২৫ সাল বিচারের বছর হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কোনও অপরাধীই রাষ্ট্রের চেয়ে বড় না। সুতরাং আমরা খুঁজছি অপরাধ, আমরা খুঁজছি অপরাধী। আমরা দেখব না কে কত বড়, কে কোথায় চাকরি করেন, কার কী অবস্থান। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার করা হবে।”