সেটা খুব সম্ভব ১৯৯৯ সাল। ১৯৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রথম আমল। আমি তখন সাতক্ষীরায় সদর সিনিয়র সহকারী জজ। সেই সঙ্গে নকলখানার ‘জাজ ইন চার্জ’-এর দায়িত্বও আমার হাতে। সে-সময়ে আমাদের জেলা জজ যিনি ছিলেন তাঁর আবার ছিল তবলিগের আমল। ‘শব গুজারি’ (রাত্রি যাপন) করতে প্রতি বৃহস্পতিবার তো মসজিদে থাকতেনই, মাঝে মাঝে শুক্রবারে বেরিয়ে পড়তেন তিন দিনের জন্যও, একেক বার একেক জায়গার মসজিদে।
তার আগের জেলা জজের ছিল লন টেনিস খেলা। তাঁর আমলে জেলার অন্য সব জজেরা পারুন না পারুন, দল বেঁধে সব হাফ প্যান্ট পরে ব্যাট হাতে নামতেন টেনিস কোর্টে। টেনিস খেলায় আমার একটু আধটু সখ ছিল আগে থেকেই। তবলিগের আমলি জেলা জজ সাহেবের আমলে এসে সেই সব জজ সাহেবদের বদলে গেল পথটা, হাফ প্যান্ট আর টেনিস ব্যাট ছেড়ে জোব্বা পরে জেলা জজ সাহেবের পেছনে পেছনে নামলেন তবলিগের ‘শব গুজারি’ করতে আর তিন দিন লাগাতে। ব্যতিক্রম হিসেবে আমি থেকে গিয়েছিলাম টেনিস ব্যাট নিয়ে। আমাকে অবশ্য তিনি বা আর কেউ জোর করেননি তবলিগে শরীক হতে, সে হয়ত আমার স্বভাব দেখে।
তবে, উকিল সাহেবরাও কেউ কেউ তবলিগে সঙ্গী হতে লাগলেন জেলা জজ সাহেবের। আসামি, বাদীরাও দেখল এই তো সুযোগ জেলা জজ সাহেবের ওজুর বদনা এগিয়ে দিয়ে, হাতে পায়ে পানি ঢেলে দিয়ে, হাত-মুখ মোছার গামছা এগিয়ে ধরে খেদমত করার। তারাও কেউ কেউ হাজির হতে লাগলেন জেলা জজ সাহেবের তবলিগের মসজিদে মসজিদে। একটি হত্যা মামলায় আসামি ছিল সাতক্ষীরা মটর শ্রমিক-মালিক সমিতির সভাপতি অথবা সম্পাদক। তিনিও চেলা চামুণ্ডা নিয়ে নামেন তবলিগের মসজিদে মসজিদে জেলা জজ সাহেবের খেদমতের সুযোগ নিতে। হত্যা মামলায় তাঁর আসামি থাকার ব্যপারটা জেলা জজ সাহেব জানতেন কিনা জানি। তবলিগে কেউ আসতে চাইলে তো নিষেধ করা যায় না। নিষেধ অবশ্য টেনিস খেলায়ও করা যায় না। তবে খেলাটা খানিক জানতে হয়, আর সেটা ছিল অফিসারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবলিগে সেসব বালাই নেই। সুতরাং চলতে থাকল তবলিগের ‘শব গুজারি’ আর তিন দিন লাগানো।
অবশ্য সেই হত্যা মামলাটা তখনো জেলা জজ কোর্টে (ফৌজদারি মামলায় সেটাই হয়ে যায় জেলা দায়রা জজ কোর্ট) উঠেনি। আটকে ছিল তদন্তের পর ম্যাজিস্ট্রেটের কগনিজ্যান্সের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গিয়ে। আর আসামিরা ছিল হাইকোর্টের জামিনে। অবশেষে একদিন ম্যাজিস্ট্রেটের কগনিজ্যান্স বহাল রেখে মামলা নামল হাইকোর্ট থেকে। আসামিদের জামিন বাতিল হয়ে আদেশ হয় জেলা দায়রা জজ কোর্টে সারেন্ডারের। মনে তার আশা ছিল (হয়ত) তবলিগি সাথী ভাই হিসেবে জেলা জজ সাহেব জামিন দেবেন নিশ্চয়। না দিলে কী হবে সেটা বোধ করি খোদ জেলা জজ সাহেবেরও জানা ছিল না। হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল তার সারেন্ডারের দিনে।
সারেন্ডারের দিনে জেলা জজ সাহেব অন্য সব শুনানি শেষে ধরেন সেই হত্যা মামলার আসামির সারেন্ডারের আর জামিনের শুনানি। উভয় পক্ষ শুনে জামিন না-মঞ্জুর করে খাস কামরায় নামেন জোহরের আজানের আগ দিয়ে। পাশেই ছিল বাসস্ট্যান্ড। জোহরের আজান শেষ না হতেই বাসস্ট্যান্ড থেকে কয়েকখানা মিনিবাস এনে জজ কোর্ট ভবন চত্বরের মেইন গেট আটকে দিয়ে শতখানেক মটর-শ্রমিক এসে জড়ো হয়। তারা মাইক এনে আসামিদের জামিনের জন্য শ্লোগান দিতে শুরু করে। সেই সঙ্গে জুড়ে দেয় বিশ্রী সব শ্লোগান দিতে। পুলিশে খবর করা হলো। পুলিশ এসে পৌঁছাবার আগেই জজ কোর্ট ভবন ও একই চত্বরে থাকা কালেক্টরিয়েট ভবনের নিচতলায় বাইরে থেকে ভাংচুর শুরু করে ঢিল পাটকেল আর লাঠিসোঁটা দিয়ে। ভাঙচুর প্রায় শেষ হয়ে এলে পুলিশ এসে বাকিটুকু সামাল দেয়। কিন্তু, মেইন গেট থেকে তাদের অবস্থান সরলো না। আমরা সব জজ সাহেবরা জড়ো হলাম জেলা জজের খাস কামরায়। তারা কাউকে চত্বরের ভেতর থেকে বেরোতে বা কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না। ভেতরে আমরা সব জজ সাহেবরা আর কালেক্টরিয়েট ভবনের সাহেবরা জিম্মি হয়ে আটকা পড়ে রইলাম। বাইরে চলতে থাকল অবস্থান আর শ্লোগান। থামাবার সম্মিলিত কোনো তৎপরতা ছিল না উকিল সাহেবদের। আসামির জামিন করানো ছাড়া যেন আর কোনো দায় নেই তাদের!
এভাবে চলতে চলতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। সন্ধ্যার পর মাঠে নামেন এসপি সাহেব স্বয়ং। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে অবস্থান তুলে নিতে তাদেরকে সম্মত করান। এশার আজানের পরে অবস্থান তুলে দিয়ে এসপি সাহেব উঠে আসেন জেলা জজ সাহেবের খাস কামরায়। অবস্থানকারীদের কারো সঙ্গে আমাদের জেলা জজের আলোচনা হয়নি। নামঞ্জুর আদেশের পাতা ছিঁড়ে নতুন করে জামিন আদেশ লিখতে হয়নি তাঁকে। প্রিজন ভ্যানে করে আসামিরা গেল জেল হাজতে। আমরা গেলাম যে যার বাসায়। আমলটা আওয়ামী লীগের হলেও সাতক্ষীরা মটর শ্রমিক-মালিক সমিতি তখন ছিল বিএনপির কবজায়। একালের মতো এতটা স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেনি তখনকার আওয়ামী শাসন। আর মানুষও তখন এখনকার মতো আগুন খেলায় মেতে ওঠেনি। এ-ঘটনায় তখন একটিও গুলি খরচ হয়নি পুলিশের।
পরদিন নকলখানার হেড কম্পেয়ারিং অ্যাসিস্ট্যান্ট নকলের একখানা দরখাস্ত আমার কাছে নিয়ে এসে জানতে চায় নকলটা দেবে কিনা? আমার প্রশ্ন, সমস্যা কী? জানালো, এটা সেই হত্যা মামলার আসামিদের জামিনের দরখাস্ত ও আদেশের নকলের জন্য তো তাই! বুঝলাম গতকালের তাণ্ডব থামাবার উদ্যোগ নেবার চেয়ে জামিনেই গরজ বেশি উকিল সাহেবদের। জামিনের জন্য হাইকোর্ট যেতে নকলের দরখাস্ত ঠুকেছেন সাততাড়াতাড়ি। বললাম, দরখাস্তটা খারিজ করে দেবার আইনগত কোনো কারণ আছে কি? জানালো, নেই, আর্জেন্ট কোর্ট ফি ঠিকমতো দেওয়া আছে। তাহলে খারিজ হবে কীভাবে। ফেরত দিলাম দরখাস্তটা তার কাছে। নিয়ে চলে গেল সে।
তার দু-দিন পর, জেলা জজ সাহেব ছুটিতে বাসায়। অতিরিক্ত জেলা জজ সাহেব চার্জে। সালাম দিয়ে পাঠালেন তিনি তার খাস কামরায়। ঢুকতেই প্রশ্ন, নকলের সেই দরখাস্তটা খারিজ না করে ছাড়লাম কেন? দরখাস্ত খারিজ করার আইনগত কোনো কারণ না থাকলে খারিজ করব কীভাবে। শুনে উত্তেজিত হয়ে তিনি রাগারাগি করলেন আমার ওপর। বললেন, দুদিন আগে তারা যখন সমস্ত জজ কোর্ট ঘেরাও করে গালাগালি করল, ভাঙচুর করল, রাত পর্যন্ত জিম্মি করে রাখল আমাদের, তখন কোথায় ছিল আইন? এখন আইন দেখাচ্ছেন! আইন তখনো ছিল, আইনের পুলিশ এসে উদ্ধার করেছে, যদিও তা দেরিতে; আইন এখনো আছে, সেদিনে সে কাণ্ড ঘটাবার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যায়, কিন্তু সে কারণ দেখিয়ে নকলের দরখাস্ত তো খারিজ করা যায় না। জবাব শুনে আরো ক্ষেপে গেলেন। বুঝতে চান না কিছুতেই। সালাম জানিয়ে বেরিয়ে এলাম তার চেম্বার থেকে।
নিজের চেম্বারে এসে ডেকে পাঠালাম হেড কম্পেয়ারিং অ্যাসিস্ট্যান্টকে। তার কাছে জানা গেল : নকলখানা থেকে তলব দিলে জেলা জজের অফিস থেকে মামলার নথি পাওয়া যায় দ্রুত, নথি পেয়ে অ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছে, অ্যাসেসমেন্টের সাথে সাথেই দরখাস্তকারী পক্ষ সেই মতো ফোলিও-কোর্ট ফি দাখিল করেছে, নকল টাইপ করে প্রস্তুত হলে তারা আগের দিনই নিয়ে গেছে, এখন হাইকোর্টের পথে রওয়ানা দিয়েছে জামিনের জন্য। কিছুক্ষণ পর জেলা জজ সাহেব স্বয়ং ফোন করে (ততদিনে সিনিয়র সহকারী জজদের অফিস-বাসায় টেলিফোন লেগে গেছে) অতিরিক্ত জেলা জজের কথাগুলোরই পুনর্ব্যক্ত করে বকাবকি করলেন। আমারও সেই একই জবাব। তিনিও বুঝতে নারাজ। পরদিন কোর্টে এসে তিনি আবার ডাকলেন আমাদের তাঁর চেম্বারে। চলল সেই একই কথা। আমার হেড কম্পেয়ারিং অ্যাসিস্ট্যান্ট আর জেলা জজের দায়রা সহকারীর বদলি হলো। ঘেরাও করে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া আর অফিস ভাঙচুরের দায়ে কোনো মামলা হয়েছিল বলে স্মরণে আসার মতো কিছু ঘটেনি। সেই আসামিরা হাইকোর্ট থেকে জামিনে বেরিয়ে এলো আবার।
আমাদের দেশে কোর্ট কাছারিগুলোতে এই চলে আসছে আকছার। যে অপরাধ ঘটেছে তার মামলা না করে শোধ তোলা হয় অন্য মামলা দিয়ে, অন্য রকম ব্যবস্থা নিয়ে। পতিত স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের এমপি-মন্ত্রী-দোসরদের বিরুদ্ধে চলছে পাইকারী হারে হত্যা মামলা দায়ের, একেকটি মামলায় শতাধিক আসামি, অজ্ঞাত আরো; যেন এরা সবাই ২০২৪ এর জুলাই গণহত্যায় দায়ী, যেন এরা অন্য আর কোনো অপরাধ ঘটায়নি, যেন দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা ছাড়া আর কোনো আইনের ধারা নেই আমাদের। আর কিছু না হোক দুর্নীতিবাজ ছিল তো এরা প্রত্যেকে। সে-মামলা কিন্তু হচ্ছে না তেমন, অনুসন্ধানই চলছে কেবল, তাও অল্প দু-এক জনের বিরুদ্ধে। দুদকের অনুসন্ধানে আবার ক্লিন সার্টিফিকেট দেবার রিস্ক আছে। এছাড়া কেবল আওয়ামী সরকারের এমপি-মন্ত্রী-কর্মকর্তাই নয় হত্যা মামলা হচ্ছে খেলোয়াড়, শিল্পী, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও।
পরিহাসের শেষ নেই যেন! ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতনের আগে যেসব হত্যা মামলাগুলো হয়েছিল সরকারের এমপি-মন্ত্রী-দোসরদের ইন্ধনে তাদেরকেই এখন সেসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে! কাকে যে কোন মামলায় গ্রেপ্তার দেখাবে তা আগে থেকে জানে না কেউ! ধরা পড়লে একটা না একটাতে দিলেই হলো! কী দারুণ সুবিধে পুলিশের! কোর্টে আনা সব আসামির ওপর হামলে পড়ছে সবে চড় থাপ্পড়, পচা ডিম নিয়ে। যেন এসব থামাবার, কোর্টের ভাবগম্ভীর পরিবেশ রক্ষার, আসামির মানবাধিকার রক্ষার কোনো দায় নেই উকিল সাহেবদের। প্রত্যেকটা জেলার উকিল সাহেবরা সিদ্ধান্ত নিলে এসব মামলা হামলা বন্ধ হতে কতক্ষণ। বিজ্ঞ সব লোকেদের চৈতন্যোদয় হবে কবে?
লেখক: কলামিস্ট, প্রবন্ধকার ও গ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।ইমেইল: [email protected]