“মেয়ে হারানোর ব্যথা নিয়ে ছয়টি বছর কাটালাম। বিচার চাইতে গিয়ে নিজের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ন্যায়বিচার পেলাম না। সাক্ষ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও রায়ের পর্যায়ে এসে আমাদের হতাশ হতে হলো।”
এভাবেই আক্ষেপ করছিলেন ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রয়াত শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর বাবা দিলীপ অধিকারী।
৬ বছর আগে ২০১৮ সালে শিক্ষকদের দ্বারা বাবা-মার অপমান সইতে না পেরে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী আত্মহত্যা করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচণা দেওয়ার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তারের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা করেন অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী।
সেই মামলায় বিচার চেয়ে বুধবার ঢাকার কোর্ট রিপোর্টার্স ইউনিটির (সিআরইউ) কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দিলীপ এই আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ন্যায় বিচারও প্রার্থনা করেন।
দিলীপ অধিকারী বলেন, “৬ বার রায়ের তারিখ পড়লেও অদৃশ্য কারণে তা ঘোষণা করা হলো না। কিন্তু কেন রায় দিল না, এখন আমার মেয়ের আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলার বিচার পাব কি না তা নিয়ে সংশয়ে আছি। তবে যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন আমি বিচার চাইতেই থাকব।”
ঘটনার বিবরণ দিয়ে অরিত্রীর বাবা বলেন, “আমাদের আদরের সন্তান অরিত্রী। ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের ৯ম শ্রেণির একজন মেধাবী ছাত্রী ছিল। স্কুলের শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনা, শাখা প্রধান জিনাত আক্তার, অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) নাজনীন ফেরদৌস আমাদের সামনে অরিত্রীর সঙ্গে নির্মম ও নির্দয় আচরণ করে এবং বারবার টি.সি. দেওয়ার হুমকি দেয়। এতে অরিত্রী মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর সে আত্মহত্যা করে।”
তিনি বলেন, “পিবিআইতে খোঁজ নিয়েছি, তবে চার মাসের বেশি সময় পার হলেও এই সংস্থা তদন্তের কোনও আদেশ পায়নি। আজ অব্দি কোনও অগ্রগতি নেই। এভাবে যদি সময় চলে যায়, তাহলে কীভাবে আমি ন্যায়বিচার পাব?
“আমি বিচার নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছি। ন্যায় বিচারের আশায় ছয়টি বছর পার করলাম। এই বিচার পেতে আর কত অপেক্ষা করতে হবে। আমি অন্তবর্তী সরকারের কাছে ন্যায়বিচার চাচ্ছি।”
আসামিপক্ষের আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে দিলীপ অধিকারী বলেন, “এ মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন মোশারফ হোসেন কাজল, যিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের একজন পিপি ছিলেন এবং বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় লড়েছেন। আমার মেয়ের আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলার স্বাক্ষীদের তিনি বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছেন। বিচার কাজে বাধা প্রদান করেন। তার কারণে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এখন ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছি।”
এই মামলা তদন্ত করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তারকে অভিযুক্ত করে ডিবি পুলিশ চার্জশিট দাখিল করার পর ২০১৯ সালের ১০ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা (তৎকালীন) জজ রবিউল আলম।
মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণও হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ছয় বার মামলাটির রায়ের তারিখ পেছানো হয়েছে।
প্রথমে রায়ের জন্য চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি তারিখ দিয়েছিল আদালত। ওইদিন রায় প্রস্তুত না হওয়ায় তা পিছিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি ঠিক করা হয়। কিন্তু ওই দিনও একই কারণে তা পিছিয়ে ৩ মার্চ ঠিক করা হয়।
পরের দফায় রায় পিছিয়ে তারিখ পড়ে ৯ এপ্রিল। তারপর ৩ জুন নতুন তারিখ রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেদিনও রায় হয়নি।
পরে মামলাটি ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ-১২ এর বিচারক আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালতে পাঠানো হয়। গত ২৫ জুলাই তিনি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) মামলাটি পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন।
এরপর মামলাটির বাদী ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২৭ নভেম্বর রায়ের পর্যায়ে আসে। সেদিনও রায় ঘোষণা না করে আগামী ২১ জানুয়ারি রায়ের তারিখ দিয়েছেন বিচারক আব্দুল্লাহ আল মামুন।
মামলার দুই আসামি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তখনকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস এবং শাখা প্রধান জিনাত আক্তার জামিনে রয়েছেন। দোষী সাব্যস্ত হলে দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারার এ মামলার তাদের সর্বোচ্চ দশ বছর কারাদণ্ড, সঙ্গে অর্থদণ্ড হতে পারে।
অরিত্রী কেন আত্মহত্যা করেছিল
২০১৮ সালে ৩ ডিসেম্বর শান্তিনগরের বাসায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন ভিকারুন্নিসার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী (১৫)। তার আগের দিন পরীক্ষায় নকল করার অভিযোগে শিক্ষকরা তাকে পরীক্ষা হল থেকে বের করে দিয়েছিল।
শিক্ষকদের দাবি, অরিত্রী পরীক্ষায় মোবাইল ফোনে নকল নিয়ে টেবিলে রেখে লিখছিল। অন্যদিকে স্বজনদের দাবি, অরিত্রী নকল করেনি।
এরপর অরিত্রীর বাবা-মাকে স্কুলে ডেকে নিয়ে তার সামনে তাদের অপমান করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। ওই দিনই আত্মহত্যা করে অরিত্রী। অরিত্রীর আত্মহত্যার পর তার সহপাঠীরা বিক্ষোভে নামে।
৪ ডিসেম্বর তার বাবা দিলীপ অধিকারী আত্মহননে প্ররোচনার অভিযোগ এনে মামলা করেন। ওই মামলায় অরিত্রীর শিক্ষকদের পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও পরে তারা জামিনে মুক্তি পায়।
মামলায় অরিত্রীর বাবা লেখেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ মেয়ের সামনে তাদের অপমান করে। ওই অপমান এবং পরীক্ষা দিতে না পারার মানসিক আঘাত সইতে না পেরে অরিত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ নাজনীন ও জিনাতকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক কামরুল হাসান তালুকদার।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিদের ‘নির্দয় ব্যবহার ও অশিক্ষকসুলভ আচরণ’ অরিত্রী অধিকারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।
মামলার এজাহারে অরিত্রীর শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাও আসামি ছিলেন। তবে পরে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।