গত দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সফট পাওয়ার’ ব্যবহারকে বিপজ্জনক হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করে, তা যে সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার হয়নি সেই দাবি করেছেন ঢাকা লিট ফেস্টের প্রতিষ্ঠাতা আহসান আকবর।
২০১২ সাল থেকে প্রতি নভেম্বরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে যে বার্ষিক সাহিত্য উৎসব ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’ হয়ে আসছে, আওয়ামী লীগ সেই প্ল্যাটফর্মেরও অপব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
রবিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘সফট পাওয়ার, হার্ড অ্যাবিউজ : দ্য মিডিয়া মাফিয়া অফ আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব অভিযোগ তোলেন আহসান আকবর।
শেখ হাসিনার সরকার বিপজ্জনক হাতিয়ার হিসেবে ‘সফট পাওয়ার’ ব্যবহার করত; তবে সংবাদমাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে প্রচার হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সেমিনারে আহসান আকবর অভিযোগ করেন, “আগের সরকারের আমলে স্থানীয় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ এবং ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (পরে সাইবার নিরাপত্তা আইন) বাস্তবায়নের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সফট পাওয়ার প্রচারের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। এই নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রসার ঘটানো হয়।
“আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক লবিস্টদের নিয়োগ, মার্কিন কংগ্রেসের বিতর্কিত সদস্যদের অর্থ প্রদান, পক্ষপাতদুষ্ট মতামত প্রচার, সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) প্রতিষ্ঠা করে পেন বাংলাদেশ দখল করা এবং ঢাকা লিট ফেস্ট প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ।”
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থাকে লাখ লাখ ডলার দেওয়া হয়েছিল, যা বাংলাদেশি আইনের অধীনে অর্থ পাচার হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলে উল্লেখ করেন আহসান আকবর।
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আশরাফ কায়সার বলেন, যুক্তরাজ্যের দ্য সানডে টাইমসে সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, শেখ হাসিনা তার স্বৈরাচারী শাসনামলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একজন ব্রিটিশ ব্যারিস্টারকে নিয়োগ করেছিলেন।
“শেখ হাসিনার ভাগ্নের নেতৃত্বে প্রচার সংস্থা সিআরআই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলোকে প্রভাবিত করেছে। যেমন-ঢাকা লিট ফেস্ট প্যানেলের অপব্যবহার, যথাযথ নির্বাচন ছাড়াই পেন বাংলাদেশ দখল এবং স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তায় গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করেছে তারা,” বলেন আশরাফ কায়সার।
এ সময় ঢাকা লিট ফেস্টের প্রতিষ্ঠাতা আহসান আকবার অভিযোগ করেন, সেই ‘সফট পাওয়ার’ দিয়ে কৌশলে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার জন্য কাজী আনিস পরিবার লবিং করছে।
তিনি বলেন, “দেশকে জঙ্গিবাদের তকমা দিয়ে পরিবারটি অন্তর্বর্তী সরকারকে বিতর্কিত করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।”
দি ফিউচার ফোরাম আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে আহসান আকবার বলেন, ২০২৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের এক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের জন্য ওয়াশিংটন ডিসিতে লিবার্টি সাউথ এশিয়া নামের লবিস্ট নিয়োগ করা হয়, যার অর্থ দেওয়া হয়েছিল দুবাইভিত্তিক গ্রিন পার্সপেক্টিভ নামের একটি কোম্পানির মাধ্যমে। কোম্পানিটি চা, কফি ও স্ন্যাকস বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত।
দ্য সানডে টাইমসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে আহসান আকবার বলেন, “স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একজন ব্রিটিশ ব্যারিস্টারকে নিযুক্ত করেছিলেন। এছাড়া সজীব ওয়াজেদ জয় স্ট্রাইক গ্লোবাল ডিপ্লোম্যাসি (এসজিডি) ও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রাক্তন প্রধান সচিব আহমদ কায়কাউস মোরান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিসকে (এমজিএস) আন্তর্জাতিক প্রপাগান্ডা চালাতে অর্থ দিয়েছিলেন।
“সিআরআই নামের যে প্রপাগান্ডা সংস্থাটি প্রাক্তন একনায়ক শেখ হাসিনার ভাগনের নেতৃত্বে ছিল, তা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ঢাকা লিট ফেস্টের প্যানেলের অপব্যবহার, সঠিক নির্বাচন ছাড়া পেন বাংলাদেশ দখল ও স্থানীয় কিছু সাংবাদিকের সহায়তায় মিডিয়ায় প্রভাব বিস্তার তেমন কিছু কাজের উদাহরণ।”
আহসান আকবর বলেন, “জেমকন গ্রুপের সাবেক ব্যবসায়িক অংশীদার আমি নিজে। আমার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে মামলা এবং আইনি হয়রানির ঘটনাও ঘটানো হয়। জেমকন গ্রুপের স্থানীয় ঋণের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকারও বেশি।
“একইসঙ্গে এই গ্রুপের সংবাদপত্রের সাবেক কর্মীদের বকেয়া পরিশোধ না করার ঘটনাটিও আলোচিত হয়। আমি ও আমার পরিবারকে মাফিয়া পদ্ধতিতে হুমকি দেওয়া হয়। যেখানে আমাদের পরিবারটির বিরুদ্ধে র্যাব ব্যবহার করে বলপ্রয়োগ করা হয়েছিল।”
তিনি অভিযোগ করে বলেন, “গ্রুপটি অর্থ পাচারে অভিযুক্ত, যার দায়ও গ্রুপটি স্বীকার করেছে। বর্তমানে অভিযোগটি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে। দ্য ডেইলি স্টারের গত ১০ অক্টোবর একটি প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
“ইউনিভার্সিটি অব লিবারাল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) সাম্প্রতিক ছাত্র প্রতিবাদও এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ছাত্ররা ফ্যাসিবাদী শাসনের সমর্থক জেমকন গ্রুপের দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের বিরোধিতা করায় ‘জুলাই বিপ্লব’র ছাত্রদের সন্ত্রাসীর তকমা দেওয়া হয়। এই আন্দোলনে বর্তমানে পদ স্থগিত থাকা উপাচার্য ইমরান রহমানের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়, যিনি বোর্ডকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করছেন। আমরা প্রতিটি ঘটনায় স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার চাই।”