বড়দিনে পৃথিবীর আকাশে নেমে এসেছিল এক মর্মান্তিক বিপর্যয়। আজারবাইজান এয়ারলাইনসের একটি বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩৮ জন মানুষ। রাশিয়াগামী বিমানটি কাজাখস্তানের আকতাউ শহরের কাছে বিধ্বস্ত হয়। প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে,পাখির সঙ্গে সংঘর্ষে এই দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। প্রশ্ন উঠেছে, পাখির আঘাতে এমন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কতটুকু এবং কতটা সাধারণ?
ক্রিসমাসের দিন আজারবাইজানের বাকু থেকে চেচনিয়ার গ্রোজনি শহরে যাত্রা করা একটি ফ্লাইট অনেক যাত্রীর জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠে। যাত্রা শুরুর কয়েক ঘণ্টা পরই বিমানটি তার নির্ধারিত পথ থেকে সরে গিয়ে কাজাখস্তানের আকতাউ শহরের কাছে বিধ্বস্ত হয়।
আজারবাইজান এয়ারলাইনসের বিমানটি বুধবার ভোর ৩টা ৫৫ মিনিটে (জিএমটি) আকাশে উড়ে এবং সকাল ৬টা ২৮ মিনিটে বিধ্বস্ত হয়। এতে বিমানে থাকা ৬৭ জন আরোহীর মধ্যে ৩৮ জন নিহত হয়েছে।
ফ্লাইট-ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, বিমানটি স্বাভাবিক যাত্রাপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে কাস্পিয়ান সাগর পেরিয়ে আকতাউয়ের কাছে কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে বিধ্বস্ত হয়।
আকতাউ শহর কাস্পিয়ান সাগরের পূর্ব তীরে অবস্থিত এবং এটি তেল ও গ্যাস শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বিমানটি শহরটির বিমান বন্দরের মাঠে বিধ্বস্ত হয়।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, পাখির আঘাতের পর বিমানটির পাইলট জরুরিভাবে মাটিতে নেমে আসার সিদ্ধান্ত নেন, যা দুর্ঘটনার কারণ হয়।
আজারবাইজান এয়ারলাইনসও প্রথমে জানিয়েছিল, বিমানটি একটি পাখির ঝাঁকের মধ্য দিয়ে উড়ে গিয়েছিল। তবে পরে তারা এই বিবৃতি প্রত্যাহার করে নেয়।
আজারবাইজানের প্রসিকিউটর জেনারেলের অফিস এক বিবৃতিতে জানায়, “এ মুহূর্তে তদন্তের কোনও ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব নয়।”
তাহলে বিমানটি কীভাবে দুর্ঘটনার শিকার হলো? আর পাখির আঘাত (বার্ড স্ট্রাইক) কী এবং কীভাবে একটি বিমানকে দুর্ঘটনায় ফেলতে পারে?
ফ্লাইটে কী ঘটেছিল?
আজারবাইজান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট J2-8243 বাকু থেকে ৬২ জন যাত্রী এবং ৫ জন ক্রু উড্ডয়ন করেছিল। বিমানটি রাশিয়ার চেচনিয়ার গ্রোজনি শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি কাজাখস্তানের আকতাউ শহরের প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে জরুরি অবতরণ করতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি আকতাউ শহরের বিমান বন্দরে অবতরণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি।
একটি অনিশ্চিত ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, বিমানটি মাটিতে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে এতে আগুন ধরে যায়। কিছু সময় পর, পুড়ে যাওয়া বিমানের ভেতর থেকে হতবাক অবস্থায় জীবিতদের বের হতে দেখা যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, বিমানটি যখন দ্রুত নিচে নামছিল, একজন যাত্রী বলছেন, “আল্লাহু আকবার” (আল্লাহ মহান)। এসময় যাত্রীদের আসনের ওপর হলুদ রঙের অক্সিজেন মাস্ক ঝুলছিল। ভিডিওতে আতঙ্কে চিৎকার ও কান্নার শব্দ শোনা যায়।
বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনায় ২৯ জন বেঁচে গেছেন, যার মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। তবে কাজাখস্তানের উপ প্রধানমন্ত্রী কানাত বোযুমবায়েভ জানিয়েছেন, ১১ জন জীবিত ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়েছেন।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ বিমানটি বিধ্বস্তের পরদিন বৃহস্পতিবার জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন। তিনি রাশিয়ায় কমনওয়েলথ অফ ইনডিপেনডেন্ট স্টেটস (সিআইএস)-এর নেতাদের অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনে তার পূর্ব নির্ধারিত সফরও বাতিল করেন। সিআইএস সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশের একটি জোট।
বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত
কাজাখস্তান এই দুর্ঘটনার কারণ তদন্তে একটি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটির ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা হয়েছে। এটি দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ নির্ধারণে সহায়ক হবে।
দুর্ঘটনার পরপরই কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ ধারণা করেন যে, রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিমানটিকে ইউক্রেনীয় ড্রোন ভেবে গুলি করে ভূপাতিত করেছে।
রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ইলিয়া তুমানোভ পরিচালিত বলে ধারণা করা হয়, এমন একটি টেলিগ্রাম চ্যানেল “ফাইটারবোম্বার” একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায়, বিমানের গায়ে গর্ত রয়েছে, যাকে কেউ কেউ বোমার আঘাত থেকে সৃষ্ট ক্ষতির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তবে রাশিয়ার এভিয়েশন ওয়াচডগ প্রাথমিক তদন্তে জানিয়েছে, পাইলট পাখির আঘাতের পর জরুরি অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন।
সংস্থাটি টেলিগ্রামে এক পোস্টে বলেছে, “প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, পাখির সঙ্গে সংঘর্ষের পর বিমানটিতে জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এতে পাইলট আকতাউ এয়ারফিল্ডকে বিকল্প অবতরণস্থল হিসাবে বেছে নেন।”
পাখির আঘাত কি?
বার্ড স্ট্রাইক বা পাখির আঘাত বলতে বোঝানো হয় বিমানের সঙ্গে পাখির সংঘর্ষ। এর মধ্যে মাটিতে পশুদের সঙ্গে সংঘর্ষও অন্তর্ভুক্ত, যেমন খরগোশ, হরিণ, কুকুর ও কুমির।
বিশ্বে বিমানের সঙ্গে পাখির সংঘর্ষের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ইতিহাসে বিমানের সঙ্গে প্রথম পাখির সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ১৯০৫ সালে। ঘটনাটি রেকর্ড করেন আরভিল রাইট, যা যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের একটি ধানক্ষেতের ওপর ঘটেছিল।
২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ২ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি বিমান ও পাখির সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, বিমানের সঙ্গে পাখির সংঘর্ষ এখন একটি নিয়মিত ঘটনা।
বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিমানের সঙ্গে পাখির সংঘর্ষ ঘটে, কারণ পাখিরা বিমান এবং বিমানবন্দরের আশেপাশের এলাকার প্রতি আকৃষ্ট হয়। বর্ষাকালে যখন খোলা মাঠে পানি জমে তাতে পোকামাকড়ের প্রজননস্থল তৈরি হয় এবং এতে পাখির উপস্থিতি বাড়ে।
এছাড়া পাখিরা একে দেশ থেকে অন্য দেশেও পাড়ি জমায়। তখন তারা অনেক সময় বিমান চলাচলের আকাশপথের রুটে চলে আসে। পাখিরা সাধারণত ঝাঁক বেঁধে চলে, ফলে সংঘর্ষের সময় একাধিক আঘাতের ঘটনা ঘটে।
পাখির আঘাতে কি মানুষ নিহত বা আহত হয়েছে?
হ্যাঁ, বিমানে পাখির আঘাতে মানুষ নিহত বা আহত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাখির আঘাত বিমানের নিরাপত্তার জন্য বিপদজনক হতে পারে। বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানের ধরনের ওপর পাখির আঘাতের প্রভাব নির্ভর করে।
উদাহরণস্বরূপ, ছোট বিমান, বিশেষ করে এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট বিমানগুলোর জন্য পাখির আঘাত মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ১৯৮৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ২৬২ জন পাখির আঘাতে নিহত হয়েছেন এবং ২৫০টি বিমান ধ্বংস হয়েছে।
পাখির আঘাতের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা
কোনও উড়োজাহাজে ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত পাখির আঘাতের ঘটনা ঘটে ২০০৯ সালে। ওই বছর ইউএস এয়ারওয়েজের ফ্লাইট ১৫৪৯ নিউ ইয়র্কের লা গার্ডিয়া বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পরপরই এক ঝাঁক পরিযায়ী কানাডিয়ান রাজহাঁসের সঙ্গে সংঘর্ষে পড়ে। বিমানটির দুটি ইঞ্জিনই নষ্ট হয়ে যায় এবং ক্যাপ্টেন সুলি সুলেনবার্গার হাডসন নদীতে বিদ্যুৎবিহীন অবতরণ করতে বাধ্য হন।
১৯৬০ সালের অক্টোবরে পাখির আঘাতে একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটে, যাতে অনেক মানুষ হতাহত হয়। পূর্বাঞ্চলীয় এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট বস্টন লোগান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের মাত্র ২০ সেকেন্ড পর পাখির আঘাতে এর ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। বিমানটি শক্তি হারিয়ে বস্টন হার্বারে পড়ে। এতে ৭২ জন যাত্রীর মধ্যে ৬২ জন নিহত হন।
১৯৮৮ সালে আরো একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। ইথিওপীয় এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৩৭ বিমানটির ইঞ্জিনে একাধিক পাখি আঘাত হানে। বিমানটি ইথিওপিয়ার বাহির দার থেকে উড্ডয়নের পরপরই বিধ্বস্ত হলে ১০৪ জন যাত্রীর মধ্যে ৩৫ জন নিহত হন।
পাখির আঘাত কি ঠেকানো সম্ভব?
হ্যাঁ, পাখির আঘাত ঠেকানো সম্ভব— কিছুটা হলেও। রাডার ব্যবহার করে পাখির ঝাঁক চিহ্নিত করা যেতে পারে। পাইলটরা তাদের যাত্রাপথ পরিবর্তন করে পাখির সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে পারেন।
প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণবাদীরা পাখিদের জন্য নিরাপদ অভিবাসন করিডোর তৈরির পক্ষে ওকালতি করেন। এটি এমন একটি পরিবেশের নেটওয়ার্ক যেখানে সাধারণ অভিবাসন পথ চিহ্নিত করে পাখিদের জন্য খাদ্য, পানি এবং বিশ্রামের স্থান সৃষ্টি করা হয়। এর মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব হয়।
তথ্যসূত্র : ফার্স্টপোস্ট