বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টে আবার উঠল বাংলাদেশের পতাকা। এবার তা তুললেন চট্টগ্রামের বাবর আলী।
হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে রবিবার সকালে ওঠেন বাবর। ১১ বছর পর কোনও বাংলাদেশি এই কৃতিত্ব দেখালেন।
এই অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান সকাল সন্ধ্যাকে বাবরের এভারেস্ট জয়ের খবর নিশ্চিত করেছেন।
বাবরের অভিযানের সমন্বয়কারী ভার্টিকাল ড্রিমারস তাদের ফেইসবুকে লিখেছে-
এর আগে পাঁচ বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করলেও চট্টগ্রাম থেকে বাবরই প্রথম। তাই চট্টগ্রামবাসী তার এই বিজয়ে উদ্বেলিত। ফেইসবুকে নানাজনের টাইমলাইন এখন তার প্রশংসায় ভাসছে।
৩৩ বছর বয়সী বাবর আলীর বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বুডিশ্চর গ্রামে। পেশায় তিনি চিকিৎসক। এমবিবিএস ডিগ্রি নেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে। ওই মেডিকেলের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
কিছুদিন চিকিৎসক হিসাবে কাজ করলেও পর্বতজয়ের নেশা তাকে সেই পেশায় স্থির থাকতে দেয়নি। সেই সঙ্গে সাইক্লিংয়ের নেশায়ও মাতেন বাবর।
ফেইসবুকে তিনি নিজের পরিচয় দেন এভাবে- ‘পেশায় ডাক্তার, নেশায় পাহাড়ি’।
ট্রেকিংয়ে বাবরের হাতেখড়ি ২০১০ সালে, তখন তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে ট্রেকিং করতেন। চট্টগ্রামের পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমারসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। এই ক্লাবের হয়ে ২০১৪ সাল থেকে হিমালয়ের নানা শিখরে চালান অভিযান।
২০১৭ সালে ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের উত্তরকাশী শহরের নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে মৌলিক পর্বতারোহণ নিয়ে প্রশিক্ষণ নেন বাবর।
২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২২ হাজার ৩৪৯ ফুট উচ্চতার হিমালয়ের অন্যতম দুর্গম ও টেকনিক্যাল চূড়া আমা দাবলাম আরোহণ করেন তিনি।
এভারেস্ট জয়ের আগে বেশ কয়েকটি পর্বতশৃঙ্গ জয় করেন বাবর। তার মধ্যে রয়েছে সারগো রি (৪ হাজার ৯৮৪ মিটার), সুরিয়া পিক (৫ হাজার ১৪৫ মি.), মাউন্ট ইয়ানাম (৬ হাজার ১১৬ মি.), মাউন্ট ফাবরাং (৬ হাজার ১৭২ মি.), মাউন্ট চাউ চাউ কাং নিলডা (৬ হাজার ৩০৩ মি.), মাউন্ট শিবা (৬ হাজার ১৪২ মি.), মাউন্ট রামজাক (৬ হাজার ৩১৮ মি.), মাউন্ট আমা দাবলাম (৬ হাজার ৮১২ মি.) ও চুলু ইস্ট (৬ হাজার ০৫৯ মি.)।
এভারেস্ট অভিযান
গত ১ এপ্রিল থেকে শুরু হয় বাবর আলীর মাউন্ট এভারেস্ট অভিযান। ১০ এপ্রিল এভারেস্টের বেইজ ক্যাম্পে পৌঁছান তিনি। ২৬ এপ্রিল সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে এভারেস্ট ক্যাম্প-২ এ পৌঁছালেও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ফিরে আসেন তিনি।
তারপর এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার মতো উপযুক্ত আবহাওয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়েছে বাবর আলীকে। শেষ পর্যন্ত যাত্রা শুরু হয় গত ১৪ মে। এদিন তিনি দ্বিতীয় ক্যাম্পে, ১৮ মে তৃতীয় ক্যাম্পে এবং ১৯ মে ভোরে ক্যাম্প ফোরে পৌঁছান।
১৯ মে সকালে তিনি ‘ডেথ জোন’ নামে পরিচিত শৃঙ্গে আরোহণ করেন। এরমধ্য দিয়ে তার মাউন্ট এভারেস্ট জয় হলো তার।
এই অভিযানের সমন্বয়ক ফরহান জামান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাবর আলী এখন হিমালয়ের ক্যাম্প-৪ এ নামার পথে আছেন। সেই ডেথ জোনে যোগাযোগ সম্ভব নয়। তাই বিস্তারিত জানতে এবং ছবি পেতে আমাদের কিছু সময় লাগবে।”
এভারেস্টে ষষ্ঠ বাংলাদেশি
মাউন্ট এভারেস্টে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিলেন মুসা ইব্রাহীম। প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে ২০১০ সালে তিনি হিমালয় চূড়ায় ওঠার কৃতিত্ব দেখান। তার এক বছর পর ২০১১ সালে এম এ মুহিত এভারেস্ট শৃঙ্গে ওঠেন দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসাবে।
২০১২ সালের ১৯ মে বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসাবে এভারেস্ট জয় করেন নিশাত মজুমদার। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানেই আরেকজন বাংলাদেশি নারী ওয়াসফিয়া নাজরীন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করেন।
তার পরের বছর ২০১৩ সালে মো. খালেদ হোসাইন (যিনি সজল খালিদ নামে পরিচিত) উঠেছিলেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে। তবে চূড়া থেকে নামার পথে মারা যান তিনি।
তার ১১ বছর পর ২০২৪ সালে এসে বাবর আলী বাংলাদেশি হিসাবে এভারেস্ট চূড়ায় উঠলেন।
এ বিষয়ে প্রথম এভারেস্টজয়ী বাংলাদেশি মুসা ইব্রাহীম বলেন, “বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয়ীদের মধ্যে বাবর আলীর অবস্থান ষষ্ঠ। আমরা তাকে ষষ্ঠ বাংলাদেশি এভারেস্ট বিজয়ী হিসেবে জানব।”
সজল খালেদ এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তিনিও এভারেস্ট জয় করেছিলেন তবে নামার সময় মারা যান। গণনার ক্ষেত্রে সেটি মুখ্য নয় জানিয়ে মুসা বলেন, “ সেটা এখানে মূখ্য নয়। তিনি ”সজল চূড়ায় পৌঁছেছেন মানে পৌঁছেছেন। তিনি অবশ্যই তালিকায় রয়েছেন এবং থাকবেন। এ নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই, সন্দেহ নেই।”
এখানেই শেষ নয়
৮৮৪৮ মিটার উচ্চতার এভারেস্ট জয়ের পরই থেমে থাকছেন না বাবর। রবিবার ক্যাম্প-৪ এ নেমে মাঝরাতে আবার শুরু করবেন দ্বিতীয় লক্ষ্য লােৎসে’র পথে যাত্রা।
ফরহান জামা বলেন, “শুধু এভারেস্ট জয়ই আমাদের মুল লক্ষ্য নয়। এভারেস্ট লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ পর্বতশৃঙ্গ লোৎসে বিজয়ও আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ অর্জনে আমরা আপনাদের দোয়া চাইছি।”
সব অনুকূলে থাকলে সোমবার ভোরে বাবর পৌঁছে যাবেন লোৎসে চূড়ায়। সেখানে এর আগে কোনও বাংলাদেশি এখনও ওঠেননি।
আর এক অভিযানে দুটি আট হাজার মিটার উচ্চতার শৃঙ্গে এর আগে কোনও বাংলাদেশি চড়েননি। তাই লক্ষ্য পূরণ হলে বাবার আলীর অভিযান বাংলাদেশের ইতিহাসের নতুন অধ্যায় হিসাবে লেখা থাকবে।