তিনদিনের ছুটিতে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে খাগড়াছড়ি ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহজালাল উদ্দিনের (৩৫)। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের পশ্চিম মরিচ্যা গ্রামের বাড়িতে থাকা বাবাকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফোনে এমনটাই জানিয়েছিলেন তিনি। এরপর ছেলের আর ফোন না পেয়ে বাবা ভেবেছিলেন, ছেলে হয়ত স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে গেছে।
কিন্তু বাবার সেই ধারণা সত্যি হয়নি। কাস্টমস কর্মকর্তা শাহজালাল এবং তার স্ত্রী মেহেরুন নেসা হেলালী (২৪) ও চার বছরের মেয়ে ফাইরুজ কাশেম জামিলার মরদেহ পাওয়া গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজে’ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয় তাদের।
শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে তাদের মরদেহ গ্রহণ করেন কাস্টমস কর্মকর্তা শাহজালালের ভাই শাহজাহান সাজু।
হলদিয়াপালং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সাজু সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, মরদেহবাহী গাড়িতে করে ভাই ও তার স্ত্রী-সন্তানের মরদেহ নিয়ে তিনি ঢাকা থেকে মরিচ্যা গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।
এর আগে সকাল ৮টার দিকে মরিচ্যা গ্রামে শাহজালালদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবুল কাশেম বাড়ির সামনে বসা। উঠানে সারিবদ্ধ করে চেয়ার বসানো। গ্রামের কিছু মানুষের আনাগোনা রয়েছে বাড়িতে। বাড়ির একটু দূরে পশ্চিম মরিচ্যা জামে মসজিদের পাশের কবরস্থানে খনন করা হচ্ছে তিনটি কবর, যেখানে শায়িত করা হবে কাস্টমস কর্মকর্তা শাহজালাল ও তার স্ত্রী-সন্তানকে।
একসঙ্গে ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতনিকে হারিয়ে অনেকটাই নির্বাক শাহজালালের বাবা। বাড়িতে থাকা শাহজালালের মামাত ভাই স্কুলশিক্ষক জালাল উদ্দিন জানান, পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে শাহজালাল ছিলেন তৃতীয়। তিনি ২০১৭ সালে কাস্টমসের চাকরিতে যোগদান করেন। সর্বশেষ ঢাকার কেরাণীগঞ্জের পানগাঁও কাস্টমস অফিসে কর্মরত ছিলেন। প্রতিদিন বাবার সঙ্গে ৩-৪ বার ফোনে কথা বলতেন শাহজালাল, বৃদ্ধ বাবাকে ওষুধ সেবনের জন্য তাড়া দিতেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শাহজালাল বাবার সঙ্গে শেষ কথা বলেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “শাহজালাল বাবাকে জানিয়েছিলেন, তিনদিনের ছুটি পাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে খাগড়াছড়ি ভ্রমণে যাচ্ছেন। ঢাকায় শ্যালিকার মেডিকেল কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি এসেছেন। তাদের সঙ্গে দেখা করেই বাসে উঠে রওনা হবেন।”
শাহজালালের ছোট ভাই হাশেম বিন লিনকন জানান, সন্ধ্যায় কথা হওয়ার পর আর ভাইয়ের ফোন পাননি বাবা। তিনি (বাবা) ধারণা করেছিলেন, ছেলে হয়ত বউ ও নাতনিকে নিয়ে খাগড়াছড়ি গেছেন।
তিনি বলেন, বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের অনেক পরে কক্সবাজার কাস্টমস অফিসে কর্মরত ভাইয়ের এক সহকর্মী ফোন করে জানান, ফেসবুকে অজ্ঞাত পরিচয়ে যে কয়েকজনের মরদেহ দেখা যাচ্ছে সেখানে ভাবি ও মেয়ের ছবি দেখা যাচ্ছে। ভাইয়ের বিষয়টি জানেন না।
হাশেম জানান, এরপর তাদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তার ভাইয়ের শ্বশুর ইঞ্জিনিয়ার মোক্তার হোসেন হেলালী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে গিয়ে তিনজনের মরদেহ শনাক্ত করেন। কিন্তু প্রশাসনিকভাবে মরদেহ হস্তান্তর করতে আইনগত বিষয় থাকায় রাতে তার আরেক ভাই (সাজু) ঢাকা যান। তিনি মরদেহ গ্রহণ করে গাড়িতে করে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।
শাহজালালের একমাত্র বোন তসলিমা আকতার বলেন, “ভাই শাহজালাল অনেকটা বাবার ভূমিকা পালন করতেন। প্রতিনিয়ত ফোন করে খোঁজ-খবর নিতেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও ফোন করে কিছু লাগবে কিনা জানতে চেয়েছিলেন। এখন সেই ভাই নেই।”
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে ঢাকার বেইলি রোডে ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ নামের ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভবনটিতে কাচ্চি ভাইসহ বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান, মোবাইল ফোন ও কাপড়ের দোকান ছিল।