পাচারকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে সোনার চালান আটকের খবর হরহামেশাই আসছে। তবে যত পাচার হয়, তার তুলনায় আটকের পরিমাণ সিকিভাগও নয় বলে দাবি করেছে বাংলাদেশের গহনা ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাজুস। তারা বলছে, সোনা ও হীরা চোরাচালানের মধ্য দিয়ে বছরে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে প্রায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) সোমবার ঢাকায় নিজস্ব কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এই তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি সোনা ও হীরা চোরাচালান, চোরাকারবারিদের দমনে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চিরুনি অভিযান চালানোর দাবি জানিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন অ্যান্টি স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্টের চেয়ারম্যান মো. রিপনুল হাসান চোরাচালানের মাধ্যমে পাচারের অঙ্ক তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, সোনা যদি আনুষ্ঠানিক পথে আমদানি করা হতো, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকে ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ জমা হতো, যা থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণ হতো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
এপিবিএনের সর্বশেষ তথ্য দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গত কয়েক বছরে অবৈধভাবে আনা ১৩১ দশমিক ১১০ কেজি সোনার বার, অলংকার জব্দ করা হয়েছে, যার বর্তমান বাজারদর ১৩০ কোটি ৪৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।
বিভিন্ন পথে বাংলাদেশে আসা সোনা ভারতে কোন পথে পাচার হচ্ছে, সেই তথ্যও দেন বাজুস নেতা।
তিনি বলেন, পাশের দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৩০টি জেলার সীমান্ত। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের ছয়টি মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলা সোনা চোরাচালানের ‘নিরাপদ রুট’ হয়ে উঠেছে। ভারতে পাচার হওয়া সোনার বড় একটি অংশ এ সব জেলার সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়।
গত কয়েক মাসে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে প্রায় ২৬ কেজি চোরাচালানের সোনা জব্দ করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে তথ্য দেওয়া হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৬ কোটি টাকা।
রিপনুল বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১০১ দশমিক ৮৯ কোটি টাকার সোনা জব্দ করা হয়েছে।
এছাড়াও ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিজিবি সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে ৯২৫ দশমিক ৯১৯ কেজি চোরাচালানের সোনা জব্দ করে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত জব্দ করা হয় ২৭ দশমিক ৭১৩ কেজি সোনা।
সোনা পাচার বন্ধে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে রিপনুল বলেন, “বাংলাদেশ যে সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঝিনাইদহের মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত, এটা কথার কথা নয়, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। এই পরিস্থিতি উত্তরণে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিয়মিত কড়া নজরদারি প্রয়োজন।”
ডলারের দর বৃদ্ধির সঙ্গে বেপরোয়া চোরাচালানের ফলে দেশের জুয়েলারি শিল্প সংকটের মধ্যে রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিনিয়ত স্থানীয় পোদ্দার বা বুলিয়ন বাজারে সোনার দাম বাড়ানো হচ্ছে বলেও তার অভিযোগ।
“পোদ্দারদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সোনার পাইকারি বাজার। পোদ্দারদের সঙ্গে চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটের সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে। মূলত এই চোরাকারবারিদের একাধিক সিন্ডিকেট বিদেশে সোনা পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করা হয়।”
সোনা চোরাকারবারিদের ধরতে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে চিরুনি অভিযানের দাবি জানিয়ে রিপনুল বলেন, “সোনার বাজারে শৃঙ্খলা আনতে কঠোর অভিযানের বিকল্প নেই। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সোনা চোরাচালানের ক্ষেত্রে আলোচিত জেলাগুলোতে চিরুনি অভিযানের দাবি করছে বাজুস।”
বাজুসের অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে
# সোনা ও হীরা চোরাচালানে জড়িতদের ধরতে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জোরালো অভিযান
# সোনা ও হীরা চোরাচালান প্রতিরোধে বাজুসকে সম্পৃক্ত করে পৃথকভাবে সরকারি মনিটরিং সেল গঠন
# ব্যাগেজ রুল সংশোধনের মাধ্যমে সোনার বার আনা বন্ধ করা
# ট্যাক্স ফ্রি সোনার অলংকারের ক্ষেত্রে ১০০ গ্রামের পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৫০ গ্রাম করা
# একই ধরনের অলংকার দুটির বেশি আনা নিষিদ্ধ করা
# একই সঙ্গে একজন যাত্রীকে বছরে শুধু একবার ব্যাগেজ রুলের সুবিধা দেওয়ার বিধান করা
# ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনার বার ও অলঙ্কার আনার সুবিধা অপব্যবহারের কারণে ডলার সংকট ও চোরাচালানে কী প্রভাব পড়ছে, তা জানতে বাজুসকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের সমীক্ষা পরিচালনা
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাজুসের উপদেষ্টা রুহুল আমিন রাসেল, বাজুস কার্যনির্বাহী কমিটির সহসভাপতি মাসুদুর রহমান, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন অ্যান্টি-স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল উদ্দিন, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন অ্যান্টি-স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্টের সদস্য সচিব মো. আলী হোসেন, বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন অ্যান্টি-স্মাগলিং অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্টের সদস্য শাওন সাহা।