Beta
শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪

নিবন্ধ

আকাশ পানে হাত বাড়ানো স্বপ্নের অপমৃত্যু-২

সনৎকুমার সাহা। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

(প্রথম পর্বের পর)

এই সত্তরের দশক কিন্তু গোটা বিশ্ব অর্থব্যবস্থাকেই এক বাঁকের মুখে দাঁড় করায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে পুরো ষাটের দশক অব্দি বিস্তৃত সময়পর্বটিকে বলা চলে বি-উপনিবেশায়নের কাল। নতুন-নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার যে মাত্রা থাকে, স্বাধীন দেশের গঠনমূলক পরিচালনায় তা পুরোপুরি খাটে না। অনেকে ঔপনিবেশিক শাসন প্রক্রিয়াকে একই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় চালু রাখতে অভ্যাসের ধারাবাহিকতা বজায় রাখায় স্থিতিশীলতা খোঁজেন; কেউ বা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সমাজবাদী ধ্যানধারণায় আকৃষ্ট হন, যদিও উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদান সম্পর্কের কর্মকাঠামোয় তার সংগতি মেলে না। গণতন্ত্রের কার্যকর বিধিব্যবস্থাও অনেক জায়গায় উপজাতীয় দ্বন্দ্বে ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক ভাগ-বাঁটোয়ারায় অকার্যকর প্রমাণিত হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা কোনো কায়েমি স্বার্থচক্রের দখলে চলে গেলে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের ভেতরেই ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে বৈষম্য মাথা তোলে।

বিউপনিবেশায়ন নতুন-নতুন প্রশ্নের জন্ম দেয়। সংকটও জন্মসূত্রে জারি থাকে। পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষ শিকড় থেকে গজায়। অনেক জায়গায় অমীমাংসেয় আকার নেয়। হতাশার বিস্তার ক্রমাগত বাড়ে। এই রকম বাস্তবতায় উত্তর আফ্রিকার অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ ফ্রানৎজ ফানো (Frantz Fanon) লেখেন তাঁর কালজয়ী বই The Wretched of the Earth (১৯৬১)। ঔপনিবেশিক বিকার থেকে প্রাক-ঔপনিবেশিক শুদ্ধতায় মুক্তির আকাঙ্খা তাঁর লেখায় ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে। পরে এডওয়ার্ড সাঈদ (Edward Said) ‘আপন’ ও ‘পর’-এর তত্ত্বে আধিপত্যবাদী ও উপনিবেশিত মনোজাগতিক সম্পর্ক সম্বন্ধের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিপরীতে নীরদ সি চৌধুরী দেখেন ঔপনিবেশিক দাপটের মহিমা। তার বিদায়ে ঝরে পড়ে তাঁর সরব আক্ষেপ। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো চলে আপন আপন পথে।

ইতিহাস ও ভূগোলের সুসমীকরণ সব জায়গায় ঘটে না। ফলে শৃঙ্খলমোচনের সংগ্রাম তারপরেও কোথাও কোথাও নতুন প্রেক্ষাপটে ভিন্নমাত্রায় আকার পেতে থাকে—যেমন আমাদের এখানে, তেমনি নাইজেরিয়ার বিয়াফ্রায়। আমাদের ওই পর্বের সংগ্রাম সফল পরিণতি পায়। বিয়াফ্রার আশা পূরণ হয় না।

এটা বুঝি, স্থান ও কালের বহুমাত্রিকতা গ্রহণ-বর্জনে-মিলনে-বিচ্ছেদে কাল থেকে কালান্তরে, রূপ থেকে রূপান্তরে প্রবাহিত হয়ে চলে। ভালো-মন্দ, দুটোই আপেক্ষিক। যদিও সব মানব-মানবীর আপন আপন আকাঙ্খা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার মৌলিক। কিন্তু বাস্তব তাতে বাধ সাধে। পরস্পরের সম্পর্ক-সম্বন্ধ মিলনে-বিরোধে আকীর্ণ। এক পক্ষের সঙ্গে বন্ধুতা হতে পারে অন্যপক্ষের সঙ্গে শত্রুতার কারণ। সেখানে যদি সামষ্টিক মতভেদ নৈর্ব্যক্তিক বিদ্বেষের জন্ম দেয়, অথবা, সকলের রোষ যদি লাগামহীন আক্রোশে পরিণত হয়, তবে মানব বাস্তবতায় ব্যক্তিপর্যায়ে সম্পর্কহীনতা নিশ্চিত হলেও একে-অন্যে বিরোধে জড়াতে পারে। অনিবার্য পরিণাম হতে পারে তার অনাসৃষ্টি ও ধ্বংস। সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এই ধারা প্রবহমান।

স্বপ্নকল্পনায়, গৌরবগাথাও একে প্রশ্রয় দেয়। ঐতিহ্যলালিত বীরপূজা, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ঈর্ষণীয় মূল্য আরোপ, রূপকথায় যুদ্ধের উন্মাদনা, রাজত্ব ও রাজকন্যা লাভে চূড়ান্ত তৃপ্তি— এসবই প্রথাশাসিত ইচ্ছার সর্বোত্তম পরিচয়। সবখানে। তাই ঔপনিবেশিক দাসত্বে যেমন চরম অপমান, উপনিবেশের অধিকারে তেমন জাতির সম্মান। মানবিক বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে কোনো রাজশক্তি উপনিবেশ ছাড়েনি। যখন দেখেছে, উপনিবেশের রক্ষণাবেক্ষণে তুলনামূলক ব্যয়— আর্থিক ও আন্তর্জাতিক— দুই-ই বেশি, তখনই তা পাততাড়ি গুটিয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে এমনটিই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

এই রকম বিশ্ববাস্তবতার প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপটে বাংলাদেশ মরিয়া হয়ে একক কর্তৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনায় অগ্রসর হয়। উদ্দেশ্য মহৎ ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু পায়ের তলায় যে মাটি সরে যায়, তা তখনও বুঝে ওঠা যায়নি। অনুমান, পঁচাত্তরের মর্মান্তিক অপরাধ না ঘটলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা হয়তো বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত বাহাত্তরের সংবিধানে আগেই ফিরে আসত।

তবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পর্ব আমাদের অধিকারহীনতার কাল, শাসনে-শোষণে নির্যাতিত হবার কাল, অপমানে-অপমানে লাঞ্ছিত হবার কাল, এ সবের সবটুকু অভ্রান্ত হলেও আরো কিছু যোগ হয়। বারো-চৌদ্দ শতকে ইটালীয় রেনেসাঁর পর ষোল শতকের গোড়ায় প্রোটেস্টান্ট ধর্ম আন্দোলনের সূত্রপাত; প্রথার দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসা ব্যক্তিচেতনায় মুক্তির তৃষ্ণা; আঠারো শতকের শেষ ভাগে ১৭৭৬ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা; ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব, সমতা, সৌভ্রাতৃত্ব ও মুক্তির বাণী নিয়ে রাষ্ট্রীয় বিধানের অঙ্গীকার; সমান্তরালে ব্রিটিশভূমি থেকে শিল্প বিপ্লবের অগ্রাভিযান-গোটা ইউরোপে তার কর্মবিস্তার; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নব নব বিস্ময়, জ্ঞানকাণ্ডে ও চেতনায় ধারাবহিক সংযোজন; এসবের অভিঘাতের সংবাদও ওই ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরেই উপমহাদেশের চিত্তভূমির প্রসারমান সীমান্তজুড়ে আছড়ে পড়ে। জনগণের রাষ্ট্রভাবনা বা তাতে পারস্পরিক প্রত্যাশা ও দায়দায়িত্ব নিয়ে কোনো বোধ তার আগে কোথাও গড়ে ওঠেনি। রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয়। সাধারণ মানুষ নির্বিকার। প্রকৃষ্ট উদহারণ পলাশির যুদ্ধ। পলাশির প্রান্তরে লড়াই। পাশের গ্রামে কৃষকের আপন মনে জমিতে ভ্রুক্ষেপহীন হাল-চাষ। রাজা আসে, রাজা যায়। যে যার মতো খাজনা আদায় করে। পারস্পরিক দায়দায়িত্বে বৃহত্তর পরস্পর-নির্ভর রাষ্ট্র-সমাজের কোনো ধারণা কাউকে সক্রিয় করে না। মোগল সাম্রাজ্যের প্রসার ছিল। জোর ছিল তাতে সেনাশাসন ও রাজস্ব আদায়ে। সুবেদার, মনসবদার, জায়গিরদার, এঁরা সবাই সাম্রাজ্যের শাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তা। পদের গুরুত্ব অনুযায়ী তাঁদের অধীনে সেনাদল, সুরক্ষাবাহিনী। অবস্থান তাঁদের শহরে। অথবা তাঁদের ঘিরে গড়ে ওঠে শহরাঞ্চল। জনগণের বসবাস, রুজি-রোজগার গ্রামে। বিশ্বাস ও অভ্যাসলালিত রীতি-নীতি মেনে তাদের জীবনযাপন। বর্ণভেদ, জাতিভেদ, তিথি-পাঁজি-শনি-মঙ্গল-বৃহস্পতি মেনে ছক কাটা সিঁড়ি বাঁধা পূর্বনির্ধারিত বৃত্তে ভারসাম্য রচনা। জলবায়ু-পরিবেশপ্রকৃতির দাক্ষিণ্যকেই বেঁচে থাকার এবং মরে যাবার অদৃষ্ট বিধান বলে মেনে নেওয়া। শিক্ষার বৃহদংশ ইহজাগতিক কল্যাণকে প্রাথমিকতা দেয় না। পরকালে স্বর্গসাধনাই তাতে পথ দেখায়। গণমানস অলীক স্বপ্নে আচ্ছন্ন থাকে। সব মিলিয়ে স্থিতিশীলতায় পুনরাবৃত্তির বিধি-বিধান।

ব্রিটিশ শাসন পরোক্ষে উত্থীয়মান ইউরোপের চিত্তভূমির সঙ্গে যে পরিচয় ঘটায়, তারই পরিণামে নৈর্ব্যক্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, অন্তিমপর্বে সমাজতন্ত্র, এই সব ধারণার রূপকল্প এই উপমহাদেশেও শিকড় ছড়ায়। হয়ত ঔপনিবেশিক স্বার্থেই ধর্মনিরপেক্ষ ইহজাগতিক শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্ব আরোপ; তা ইতিবাচক সাড়া ফেলে। যেহেতু এখানে ব্রিটিশ শাসন গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে তাই প্রতিক্রিয়াও জাগে তারই প্রেক্ষাপটে। সরল রৈখিক নয়, নির্দ্বান্দ্বিক নয়; প্রত্যক্ষের অভিঘাত বহুমুখী। তবে উপনিবেশের শাসনব্যবস্থাই ‘ইনস্টিটিউশন’ সমূহের নৈর্ব্যক্তিক আচরণের ক্ষেত্ররচনা অনিবার্য করে তোলে । তা উদ্দেশ্য ও বিধেয়-এর পূর্ণ একৈকান্তিকতা প্রতিষ্ঠা করে, এমন বলা যায় না। বহমুখী স্বার্থের সাথে সমন্বয় ঘটে, এ দাবিও ভ্রান্ত। কিন্তু মানব-বাস্তবতায় ইহজাগতিক নির্দেশনাগুলো সংহত হবার অবকাশ পায়। এডওয়ার্ড সাঈদ যে আপন-পর তত্ত্ব খাড়া করেন, রণজিৎ গুহ যে নিম্ববর্গের স্বরূপের (Subaltern Studies) ওপর ন্যায়-কাঠামো সাজাবার লক্ষ্যে অবহেলার ওপর জোর দিয়ে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় বিকার ও বিচ্ছিন্নতার কারক হিসেবে তাকে কাঠগড়ায় তোলেন, তাঁদের আন্তরিকতায় শ্রদ্ধা রেখে ও বক্তব্যের গুরুত্ব অস্বীকার না করেও বোধহয় বলা যায়, এই উপমহাদেশের বেলায় মানবমুখী ইহজাগতিক কর্মকাঠামো নির্মাণে পুরোপুরি আন্তরিক না হয়েও বিদেশি প্রভুত্ব এখানে অন্তত রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় ইনস্টিটিউশনগুলোকে স্বেচ্ছাচারী না হয়ে নৈর্ব্যক্তিক ধ্যান-ধারণার ওপর দাঁড় করাতে সহায় হয়েছে। বাজার ব্যবস্থার আলোচনায় অ্যাডাম স্মিথ যাকে বলেছেন স্বাধীন নিরপেক্ষ দর্শক, তার ভূমিকা কিছুটা হলেও তা পালন করেছে। তবে তা উপমহাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক-সম্বন্ধের বেলাতেই শুধু;- ঔপনিবেশিক স্বার্থের বিবেচনায় নয়। এটুকু অন্তত বলা যায়, বিশ্ববাস্তবতার প্রেক্ষিতে এই ভূখণ্ডের চিন্তা ও কর্মের পরিবেশে তা ওই সময় তুলনায় ইতিবাচক প্রভাবই বেশি রেখেছে। প্রাক ব্রিটিশ শাসনপর্বের চিন্তা ও কর্মের পরিসরের সার্বিক ছবিটি (তা যে কোনো কালপর্বেই) সামনে রেখে বোধহয় এটা সংগতই মনে হয়। তবে আপন অস্তিত্বের ধারাবাহিকতায় গৌরব খোঁজাও এক সাধারণ লক্ষণ। অনিকেত যে আমরা নই, আমাদের বোধের জগতে এটা আত্মগৌরবের ভিত্তি জোগায়। হীনম্মন্যতা দূরে করে। নবযাত্রার উত্তেজনা সেই অনুপাতে ফিকে হয়। জীবনমানের প্রকৃত সূচকে এও কিন্তু মূল্যের হেরফের ঘটায়। অবশ্য কোন দৃষ্টিভঙ্গি পরিমাপে প্রাধান্য পায়, সেও একটি বিবেচনার বিষয়।

ইতিহাস ও সম্ভাবনা মিলিয়ে বাস্তবের বস্তুগ্রাহ্য মূল্যমান সর্বজনে স্বীকৃত হওয়াটা দুরূহ। তবু চলমান বাস্তবতায় মোটা দাগে তুলনা কিছু চলে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পর্ব দখলদারিত্ব ও শোষণে কণ্টকিত হলেও সার্বিক বিবেচনায় গণমানসে ও কর্ম-সংযোজনে বিরোধিতায়-সহযোগিতায়  তা  ইতিবাচক ভূমিকাও কিছু রেখে যায়। উপমহাদেশের ইতিহাস আর্যদের আগমন থেকে বরাবর এরকমই। দূর থেকে ঔপনিবেশিক শাসন, তফাত শুধু এইখানে। অবশ্য এটাও আপেক্ষিক। আমাদের আঠারো শতকের ময়মনসিংহ গীতিকায় পড়ি, অনেক দূরে মুর্শিদাবাদ নামে এক আলোঝলমল স্বর্ণমোড়া দেশ। তার ঐশ্বর্য নাকি অফুরন্ত! আজকের বাস্তবতায় বিশ্বের কোনো প্রান্তই আগম্য নয়। মানুষে-মানুষে চেনা-জানার সম্ভাবনায় অপরিচয় কোনো বাধা নয়।

গত শতকে নতুন স্বাধীন দেশগুলো উন্নয়নের পথ খোঁজায় ঔপনিবেশিক পর্বের শাসনকাঠামো নিয়েই আপন-আপন যাত্রার সূচনা করে। এই সময়ের প্রেক্ষাপটে তাদের সামনে থাকে মোটা দাগে তিনটি বিকল্প পথ: ১. ঔপনিবেশিক ধারার অনুসরণে খোলা বাজারের কার্যক্রমে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপার্জন থেকে সঞ্চয়ের বিনিয়োগে তাদের সার্বিক অধিকার মেনে নিয়ে মুনাফার কারবারে অগ্রাধিকার বজায় রাখা; ২. বিপরীতে ১৯১৭-র রুশ বিপ্লব ও ১৯৫০-এ চীনে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার আলোকে সব সম্পদে রাষ্ট্রের অধিকার স্বীকার করে তার পরিকল্পনামতো সম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সঞ্চয়ে একচ্ছত্র কর্তৃত্বে বিনিয়োগের সব উদ্যোগ তার মাধ্যমে পরিচালিত করা; এবং ৩. তিরিশের দশকের গোটা মুক্তবাজার কাণ্ডে মহামন্দায় বাজারব্যবস্থার স্বাভাবিক সক্ষমতা ব্যর্থ প্রমাণিত হলে জন মেইনার্ড কেইনসের (John Maynard Keynes) তত্ত্বকে সহায় করে বাজারকে গতিশীল করার লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে কর্মসংস্থান ও উৎপাদনে ঘাটতি বাজেটে মুদ্রা ঢেলে তাদের সচল রেখে নতুন আয় সৃষ্টি ও ক্রেতার চাহিদা চাঙ্গা করে বাজারের কেনা-বেচায় প্রাণ ফিরিয়ে আনা। অনুন্নত দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনাময় বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও সঞ্চয়ের ও প্রযুক্তির ঘাটতি যেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেখানে উৎপাদনকাণ্ডের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যা আগন্তুক, তাকে পরিকল্পিত সরকারি উদ্যোগে ফলপ্রসূ করে আর প্রয়োজনীয় পুঁজি পণ্যের জোগানের নিশ্চয়তা দিয়ে বাজারে উৎপাদনের নতুন নতুন ক্ষেত্র জাগিয়ে তোলা; পরিণামে গোটা উৎপাদন ব্যবস্থাতেই ঊর্ধ্বমুখী-গতিতে প্রাণের জোয়ার বইয়ে দেয়া। এমনটিই কেইনসীয় অর্থনীতিকে ভিন্ন এবং দুর্বলতর কর্মকাণ্ডে এখানে প্রাসঙ্গিক ও প্রায়োগিক করে তোলে। মিশ্র অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের অবকাঠামো গড়ে তোলায় বিনিয়োগ প্রকৃতপক্ষে মুনাফার আশায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের পথ রোধ করে না; বরং, তার সুস্থ বিকাশে সহায় হয়।

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

ওই সময়ে সদ্য স্বাধীন দেশগুলো কেউ কেউ নিকট অতীতের ধারাবাহিকতায় ও চেনা-জানার বৃত্তে কাজ করার অভ্যস্ততায় আন্তর্জাতিক বাজারের সম্পর্ক-সম্বন্ধে আস্থা রেখে সেই অনুযায়ী সম্পদ বিন্যাসের পথ ধরে। এতে কিন্তু সমাজে প্রাথমিক বৈষম্য বাড়ার সম্ভাবনা প্রশ্রয় পায়, যদিও অর্থের প্রচলন বাড়ে। অনেক সদ্য স্বাধীন দেশেই উৎপাদন ব্যবস্থার শতকরা মাত্র ২৫-৩০ ভাগ ছিল তখন মুদ্রা ব্যবস্থার আওতায়। কারো কারো হাতে কাঁচা টাকার মজুত এসব পরিস্থিতিতে সম্পদের বিষয় বণ্টনে উৎসাহ জোগায়। স্থাবর সম্পদের দ্রুত হাত-বদল ঘটতে থাকে। কায়েমি স্বার্থ মাথা চাড়া দেয়। সামাজিক অস্থিরতা রোধে একনায়কের আবির্ভাব ঘটে। যেমন ঘটেছিল তখন পাকিস্তানে, এমন কি আরো পরে এই বাংলাদেশেও।

তখন অবশ্য আন্তর্জাতিক বাস্তবতার প্রশ্রয়ও চলমান ঘটনারাশিতে মিশেছে। রাশিয়া ও চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উদাহরণ কাউকে-কাউকে প্রেরণা জোগায়। বৈষম্য দূর করায় ও উচ্চতর প্রবৃদ্ধিহার গতিশীল রাখায় তাদের ঘোষিত সাফল্য নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকাও তাদের গণমানসে আস্থা বাড়ায়। তবে ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিনের মুখোশ খুলে দেবার পর সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব নিয়ে আস্থায় ফাটল ধরে। চীনে মাও যদিও স্ট্যালিনের পথ অনুসরণ করে চলেন। আগেই বলেছি, তাঁর মৃত্যুর পর অবশ্য সেখানেও উৎপাদন ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন ঘটে চলে। দলীয় একনায়কত্ব ছাড়া সমাজতন্ত্রের কিছুই আর সেখানে অবশিষ্ট নেই। পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশই এখন তার লক্ষ্য। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের পেছনে অন্যতম কারণ খনিজ সম্পদ সন্ধানে মিয়ানমার সামরিক জান্তার গোটা আরাকান অঞ্চল চীনের হাতে ইজারা দেওয়া। বিশ্বে অন্য কোনো বাম ব্যবস্থাধীন রাষ্ট্রই আর নিজেকে সমাজতান্ত্রিক বলে চেনায় না। অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা অবশ্য ভিয়েতনামে ও কিউবায় বজায় আছে। শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের কথা ফলপ্রসূ পদক্ষেপ হিসেবে আর কোথাও উচ্চারিত হচ্ছে বলে জানি না।

কিছু দেশ সে সময় মিশ্র অর্থনীতির পথ অনুসরণ করে অগ্রসর হতে চায়। রাষ্ট্রব্যবস্থা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক। কিন্তু অর্থনীতি সরকার নির্দেশিত পরিকল্পনানির্ভর। সাধারণত পরিকল্পনা পঞ্চবার্ষিকী। তাতে উৎপাদন ও বিনিয়োগের খাতওয়ারি লক্ষ্য, প্রযুক্তি ও উদ্যোগপ্রক্রিয়ার অনুমোদিত দিক-নির্দেশনা ও সম্পদ আহরণ-বণ্টনে পদ্ধতি-পরিমাণের প্রত্যাশিত হিসাব-নিকাশ ঘোষিত থাকে। সেই অনুযায়ী পরিচালিত হয় সমগ্র অর্থনীতির বিবিধ কর্মকাণ্ড। সরকারি ও বেসরকারি খাতের অধিকার ও সীমা বেঁধে দেয় প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত স্বাধীন ভোটে নির্বাচিত সরকার। সব মিলিয়ে ঘটে মার্কসীয় ও কেইনসীয় ধ্যানধারণার মিশ্রণ। এই ধরনের কর্মকাঠামোর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ভারত। যুগোশ্লভিয়া, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, এরাও ছিল কমবেশি অনুরূপ পথের অনুসারী। এসব দেশে প্রবৃদ্ধি হারে দর্শনীয় চমক তেমন কখনও চোখে পড়েনি। তবে আর্থ সামাজিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে ভারী শিল্পোদ্যোগে গুরুত্ব আরোপে সার্বিক উৎপাদনের ভিত্তি সবল করার উদ্যোগ প্রাথমিকতা পেয়েছে। 

পঁচাত্তরের পর থেকে আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন যে-ই থাক, নিজেকে অথবা নিজেদের দেশে এবং বিদেশে গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে পদ্ধতিগতভাবে একই পথ অনুসরণ করে চলে। পছন্দে-অপছন্দে তফাত আছে অবশ্যই। নৈতিকতার মানদণ্ডে স্খলন-পতন-ত্রুটি এসবও ধারাবাহিক। তারপরেও আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। বেড়েছে চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তা। ভবিষ্যৎ আশার আলো দেখায়। যদিও ঝড়-তুফানের আশঙ্কাও সঙ্গে-সঙ্গে চলে। এমনটিই বাস্তব। আজ, এবং আগামীর।

বিশ্ব অর্থনীতি এক বড় ধরনের ধাক্কা খায় সত্তরের দশকের গোড়ায়। সার্বিক পরিস্থিতি কোনোখানেই আর অভ্যস্ত পথে খাপ খাওয়াতে চায় না। হয়তো বিশ্ব অর্থনীতি যে পথেই অগ্রসর হোক, ভেতর থেকে তা স্থবির হয়ে পড়ছিল। সেখানে ১৯৭৩-এ আরব-ইজরায়েল সংঘর্ষের অনুসরণে খনিজ তেল সমৃদ্ধ দেশগুলো জোট বেঁধে তেলের দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। সব উৎপাদনেই রাতারাতি খরচ বেড়ে যেতে থাকে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হারায়। কিন্তু কেইনসীয় ধারণা অনুযায়ী দামের টানে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বাড়ে না। স্থবিরতা ও মূল্যবৃদ্ধি এক সঙ্গে ঘটতে থাকে। যাকে বলা হয় ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ (Stagflation)। মুদ্রাবাদী তাত্ত্বিকরা (monetary economists) বাজারকাণ্ডে হস্তক্ষেপের বিরোধী। শিকাগো স্কুলের মিল্টন ফ্রিডম্যান, জোসেফ স্টিগলার, তাঁদের গুরু ফন হায়াক, তাঁরা ও তাঁদের অনুসারীরা দেখলেন, এইটিই কেইনসীয় ধ্যানধারণাকে কবর দেবার মাহেন্দ্রক্ষণ। রাজনৈতিক সামাজিক ও তাত্ত্বিক সব মাধ্যমে তথ্যের ও কার্যক্রমের এই ব্যাখ্যা শুরু হলো, বাজার স্বয়ংক্রিয়, নৈর্ব্যক্তিকভাবে স্বয়ংশাসিত ও যৌক্তিকভাবে যথাযথ। সেখানে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কেবল বিকার, অদক্ষতা ও একচেটিয়া দলীয় স্বার্থকে প্রশ্রয় জোগায়। স্ট্যাগফ্লেশন তারই পরিণাম।

আমরা আরো দেখেছি, সমাজতান্ত্রিক অবস্থাতেও তখন চলছে সৃষ্টিশীলতা বর্জিত ধারাবাহিক পৌণঃপুণিকতা; অথবা, বিপ্লবের নামে দখলদারির উৎসব। এ সবই আত্মবিশ্বাসের অভাবকে আড়াল করার মরিয়া পরিণাম। পাশাপাশি এই পর্বেই ঘটে তথ্যপ্রযুক্তি-বিপ্লবের বিশ্বজোড়া বিস্ফোরণ। কোনো লৌহযবনিকায় আর আড়াল মেলে না। সমাজতন্ত্রে যাদের বসবাস, ঘরে বসেই তারা দেখতে পারে অবাধ জীবনের চাকচিক্য, তার স্বতস্ফূর্ত উন্মাদনা। অসাড় বিরাগ ভেতরেই জমতে থাকে।

এই রকম বিশ্ববাস্তবতার প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপটে বাংলাদেশ মরিয়া হয়ে একক কর্তৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনায় অগ্রসর হয়। উদ্দেশ্য মহৎ ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু পায়ের তলায় যে মাটি সরে যায়, তা তখনও বুঝে ওঠা যায়নি। অনুমান, পঁচাত্তরের মর্মান্তিক অপরাধ না ঘটলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা হয়তো বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত বাহাত্তরের সংবিধানে আগেই ফিরে আসত।

আশির দশকে সংকট উত্তরণে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের নির্বাচিত সরকার বাজারব্যবস্থার চরম শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামে। রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক সব দায়িত্ব পর্যায়ক্রমে ছেঁটে ফেলতে শুরু করে। প্রকাশ্যেই বলে, অনার্জিত সুবিধা কেউ ভোগ করবে না। ভর্তুকি পাওয়া সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। একে বলা হয় আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কাঠামোগত সামঞ্জস্য বিধান (Structural Adjusment)। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান প্রকাশ্য অধিবেশনে বীরদর্পে হুংকার দেন, সমাজ কী, তা তিনি জানেন না। প্রত্যেকে নিজের নিজের উদ্দেশ্য হাসিলে মাঠে নামে। রাষ্ট্র কারো দায় নিতে বাধ্য নয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার সরাসরি বলেন, ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’। রাষ্ট্র কোনো দাতব্য-প্রতিষ্ঠান নয়। মানবতাবাদীরা শুধু মিনতি করতে পারেন, বাজারের কাঠামোগত শুদ্ধি যা করার করো, শুধু দেখো, তা যেন মানবিক থাকে (Adjustment with a human face)। আশির দশকে সোভিয়েট ইউনিয়নে রাষ্ট্রপতি গর্ভাচভ পরিস্থিতি অকার্যকর হুবার মুখে ব্যক্তিস্বাধীনতায় কিছু ছাড় দেন (‘পেরেস্ত্রয়কা’ ও ‘গ্লাসনস্ট’)।

কিন্তু তাতে প্রলয় ঠেকানো যায় না। ১৯৯১-তে দলের ভেতর থেকেই ইয়েলেৎসিন অধিকাংশ সদস্যকে ভাগিয়ে নিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। প্রথম কাজ হলো তাঁর কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে যায়। প্রজাতন্ত্রের দেশগুলো এখন আলাদা-আলাদা রাষ্ট্র। চীনের দ্বান্দ্বিক বাস্তবতার উল্লেখ আগেই করেছি। মুক্তবাজার অর্থনীতির দাপটের মুখে মিশ্র অর্থনীতির কর্মকাণ্ড একরকম মুখ থুবড়ে পড়ে। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল তলানিতে গিয়ে ঠেকে। বাধ্য হয়ে সরকার উৎপাদনকাণ্ড থেকে সরে আসতে শুরু করে। পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিঃশব্দে অতীতের খতিয়ানে পরিণত হয়। ব্যক্তিমালিকানায় পুঁজিপতিদের দাপট বাড়ে। সেই সঙ্গে যোগ হয় গণমানুষের আস্থা পেতে অতীত বিশ্বাসের আড়ম্বর। এদিকে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সাড়ম্বরে প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদনে এমনটিই তোতা পাখির উচ্চারণে শোনাতে থাকে, মুক্তবাজার অর্থনীতিই উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোক্ষলাভের পথ। বাস্তবে অন্য পথের সব রাস্তাই তখন বন্ধ অথবা অকার্যকর।

পঁচাত্তরের পর থেকে আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন যে-ই থাক, নিজেকে অথবা নিজেদের দেশে এবং বিদেশে গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে পদ্ধতিগতভাবে একই পথ অনুসরণ করে চলে। পছন্দে-অপছন্দে তফাত আছে অবশ্যই। নৈতিকতার মানদণ্ডে স্খলন-পতন-ত্রুটি এসবও ধারাবাহিক। তারপরেও আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। বেড়েছে চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তা। ভবিষ্যৎ আশার আলো দেখায়। যদিও ঝড়-তুফানের আশঙ্কাও সঙ্গে-সঙ্গে চলে। এমনটিই বাস্তব। আজ, এবং আগামীর।

(সমাপ্ত)

রাজশাহী, ২০২২।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও লেখক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সাবেক সদস্য।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত