চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়াম হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের। মানে শুধুই ফুটবলের! এই স্টেডিয়াম ২৫ বছরের জন্য বাফুফেকে বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। কারণ এটি সংস্কার করা হবে ফিফার প্রোজেক্টের আওতায়। কিন্তু সমস্যা হবে চট্টগ্রামের বাকি খেলাগুলোর। ফুটবলের বাইরে বাকি ৩০টিরও বেশি খেলা কোথায় আয়োজন করবে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা?
চট্টগ্রামের স্টেডিয়াম যেভাবে বাফুফের
সালাউদ্দিন নেতৃত্বাধীন বাফুফের বিগত কমিটি দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকার বাইরে একটি নির্দিষ্ট ভেন্যু চেয়ে আসছিল সরকারের কাছে। যেখানে সারা বছর বিভিন্ন ফুটবলীয় কর্মকান্ড করা যাবে। আবার এ স্টেডিয়ামের মানোন্নয়ন বা সংস্কারের কথা বলে ফিফা থেকে বড় অংকের ফান্ডও পাবে বাফুফে। এই প্রেক্ষাপটে বাফুফে আগে থেকে চিঠি চালাচালি করছিল এনএসসির (জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ) সঙ্গে। অবশেষে বাফুফের নতুন কমিটি সেটা বোঝাতে পেরেছে এনএসসিকে।
তবে ফিফা তখনই অর্থায়ন করবে যখন সরকার একটি স্টেডিয়াম অন্তত ২০ বছরের জন্য বরাদ্দ দেবে বাফুফের অনুকূলে। এনএসসি আরও ৫ বছর বাড়িয়ে অর্থাৎ ২৫ বছরের জন্য এমএ আজিজ স্টেডিয়াম বরাদ্দ দিয়েছে বাফুফেকে।
এই স্টেডিয়ামে চলা অন্য খেলাগুলো নিয়ে যদিও বাফুফে বা এনএসসি কারও কোনও উদ্বেগ নেই। এনএসসির সচিব আমিনুল ইসলাম তো বলেই দিয়েছেন, “আসলে ওদেরকে সব কিছু দিয়ে দিয়েছি। বাফুফে যা করার করবে। ওরা তো ফিফার ফান্ডিং পাবে। অন্য কোনও প্রতিযোগিতা আপাতত তাই রাখতে চাইছি না। তাহলে ফুটবলের স্পিরিট আর থাকে না। তাছাড়া মাঠের চারপাশে অ্যাথলেটিকস ট্র্যাক করলে ফিফা যদি বলে, কেন এই ফান্ডিং করব? তখন তো আরেকটা ঝামেলা। এই জন্য এই বিষয়গুলো আর রাখছি না। সেখানে শুধুমাত্র ফুটবল হবে। শুধু বাফুফেকে বলেছি, আমাদের কাছে আর টাকা পয়সা চাইবেন না।”
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মতোই আরেকটি সংস্কারযজ্ঞ হতে পারে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামকে ঘিরে। সেরকম আভাসই দিয়েছেন এনএসসি সচিব আমিনুল ইসলাম, “ স্টেডিয়াম সংস্কারের প্রথম বিষয় যেটা আসবে সেটা হলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের দোকানগুলো ভেঙে দেওয়া। বিশ্বের কোথাও স্টেডিয়ামে দোকান বাণিজ্য নেই। কিন্তু এদেশে ক্রীড়া স্থাপনায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পুরোটা ভেঙে ফেলে ফিফা যেভাবে নকশা দিয়ে দেবে সেভাবে ওটা তৈরি করা হবে।”
ফিফার ৯৮ কোটি টাকার ফান্ড
ফিফা ফরোয়ার্ড প্রোগ্রামের আওতায় প্রতিটি দেশের ফুটবল ফেডারেশন অন্তত ৮ মিলিয়ন ডলার (৯৮ কোটি টাকা) করে ডেভেলপমেন্ট ফান্ড পেতে পারে ফিফা থেকে। ২১১ টা দেশেই প্রাপ্য। তবে প্রোজেক্ট হতে হবে বিল্ডিং অবকাঠামো, ট্রেনিং সেন্টার, খেলার মাঠ ও জাতীয় দলগুলোর আবাসন ব্যবস্থার জন্য। এটাকে ফিফা বলছে টেকসই উন্নয়ন।
এমএ আজিজ স্টেডিয়ামকে ঘিরে এরকম কোনও প্রোজেক্ট তৈরি করে বাফুফে উপস্থাপন করবে ফিফার কাছে। তবে বাফুফে কীভাবে কী করবে, সেটা পরিষ্কার করে বলতে চান না বাফুফের সাধারণ সম্পাদক তুষার ইমরান।
এম এ আজিজ স্টেডিয়াম নিয়ে বাফুফের কী পরিকল্পনা
এমএ আজিজ স্টেডিয়াম ঘিরে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রয়েছে বাফুফের। বিশেষ করে সারা বছর যাতে ফুটবলকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজন করা যায় সেটাই ভাবনায় রয়েছে বাফুফের।
বাফুফে সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষার এ প্রসঙ্গে সকাল সন্ধ্যাকে বলেছেন, “এই স্টেডিয়াম নিয়ে আমাদের অনেক পরিকল্পনা আছে। কিভাবে সারা বছর আরও সুন্দরভাবে ফুটবল চালানো যায়, সেটার জন্য এই স্টেডিয়াম দরকার।”
এই স্টেডিয়ামে ফুটবল ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে বাফুফে সম্পাদক বলেন, “যেহেতু এটা ফুটবলকে পুরোপুরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে , সেখানে শুধু ফুটবলই হবে। উদাহরণ হিসেবে বলি, ক্রিকেট মাঠে যখন পিচ তুলে ফুটবল চালাই তখন সমালোচনা হয়। ক্রিকেট মাঠে যেভাবে সারা বছর খেলা চলে, আমরাও তেমনভাবে ফুটবল চালাতে চাই একটি মাঠে। তাছাড়া প্রতি বছর ক্রিকেটের পর এটাকে ফুটবল মাঠ করতে ৭-৮ লাখ টাকা লাগে। পরের বছর আবারও প্রথম থেকে শুরু করতে হয় সংস্কার। এর পেছনেও আমাদের অনেক টাকা চলে যায় প্রতি বছর। এই মাঠটা পেলে সেখানে তাই শুধু ফুটবলই হবে।”
তার কথা ধরলে, এক মাঠে সারা বছর ফুটবল আয়োজনের জন্যই এমএ আজিজ স্টেডিয়াম নিচ্ছে বাফুফে। তবে পুরো পরিকল্পনার জন্য আগামী ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ওই দিন চট্টগ্রামে হবে বাফুফের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা।
চট্টগ্রামে অন্য খেলাগুলো কোথায় হবে
যে মাঠকে ঘিরে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার যাবতীয় ক্রীড়া কর্মকান্ড, সেই মাঠ চলে যাচ্ছে বাফুফের হাতে। চট্টগ্রাম ফুটবল লিগ না হয় সেখানে হলো, অন্য খেলাগুলোর কী হবে? এর কোনও জবাব নেই বাফুফে সম্পাদকের কাছে। তারা কোনও কথাও বলেননি চট্টগ্রামের ক্রীড়া সংগঠকদের সঙ্গে।
এনএসসির দেওয়া চিঠিতে চট্টগ্রামে অন্যান্য খেলাগুলোর বিষয়েও কিছু উল্লেখ নেই। চট্টগ্রামে ফুটবল ছাড়াও ৩০টারও বেশি খেলা আছে, সেগুলো কোথায় হবে তার কোনও নির্দেশনা নেই। ওই খেলাগুলোর কোনও বিকল্প ব্যবস্থা না করেই সরকার একটা স্টেডিয়াম দিয়ে দিচ্ছে ফুটবলকে।
তবে এ নিয়ে স্থানীয় সংগঠকদের সঙ্গে আলোচনার ভারটা বাফুফের ওপর ছেড়ে দিলেন এনএসসি সচিব আমিনুল ইসলাম, “স্থানীয় সংগঠকরা বাফুফের সঙ্গে আলোচনা করে নেবে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। যদি বাফুফে সহযোগিতা চায় তাহলে ত্রিপক্ষীয় সভা করে সিদ্ধান্ত নেবে। ওখানে আমরা আমাদের মতো করে কিছু পরামর্শ দেবো। মূল বিষয় হচ্ছে ক্রীড়া স্থাপনা বাড়ানো এবং সেটা রক্ষণাবেক্ষণ করার এত ঝামেলা রাষ্ট্রের একার পক্ষে নেওয়ার সময় নেই।”
ক্ষুব্ধ চট্টগ্রামের সংগঠকরা
কিন্তু প্রত্যেক জেলা স্টেডিয়াম তো জেলার খেলাধুলার জন্য ব্যবহৃত হয়। সারা বছর যদি এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে ফুটবলই চলে তাহলে স্থানীয় পর্যায়ের খেলাধুলার কি হবে? স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টা নিয়ে ক্ষুব্ধ চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গন।
চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার (সিজেকেএস) সাবেক সহ-সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, “এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ছয় মাস, ফুটবল হয় ছয় মাস। অ্যাথলেটিকস, হকিসহ অন্য খেলাগুলো হয় এরই ফাঁকে। কারও সঙ্গে কারও বিরোধ নেই। এখন পুরো স্টেডিয়াম বাফুফেকে দিয়ে দিলে অন্য খেলাগুলো কোথায় যাবে? আমাদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেনি কেউ।”
চট্টগ্রাম হকি কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কোচ মহসিনুল হক চৌধুরী এমন সিদ্ধান্ত কিছুতেই মানতে পারছেন না, “মান ভালো হোক, মন্দ হোক, ৩৪টা খেলা তো বছর জুড়ে হয় এই স্টেডিয়ামে। আমাদের হকি লিগও হয়। শুধু ফুটবল এটা নিয়ে নিলে অন্যরা কোথায় যাবে? কার সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো?”
আরেক সংগঠক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এটা একটা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে, চট্টগ্রামে আর কোনও খেলা হয় না। একটা সরকার কখনও একটা জেলার খেলাকে ধ্বংস করে দিতে পারে না। এখন সিজেকেএস’র কমিটি না থাকলেও এখানকার ক্রীড়া সংগঠক ও খেলোয়াড়রা কখনও এই সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না।”
অন্তরর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্যান্য জেলার মতো চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার কমিটিও ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। কয়েকমাস ধরে জেলায় খেলাধুলা নেই বললেই চলে। এই সময়ে স্থানীয় সংগঠকদের সঙ্গে কোনও আলাপ না করে সরকার চট্টগ্রামের সবচেয়ে ব্যস্ত ক্রীড়া প্রাঙ্গনটি তুলে দিচ্ছে বাফুফের হাতে।