Beta
সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
সোমবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৫

সাইকেল রপ্তানিকারক দেশের সাইক্লিস্টদের হাপিত্যেশ

s1
[publishpress_authors_box]

অলিম্পিক ও বিশ্বকাপে বাংলাদেশি খেলোয়াড়রা পদকের ধারেকাছেই থাকেন না। কিন্তু এ দেশের তৈরি ক্রীড়া সরঞ্জামের সদর্প উপস্থিতি থাকে ওসব ক্রীড়া মহাযজ্ঞে। দেখা যায়, এখানকার তৈরি আর্চারি তীর, গলফ শ্যাফট বা জার্সি পরে পদক জিতছেন বিশ্ব তারকারা। অথচ দেশে তৈরি ওসব উন্নত ক্রীড়া সরঞ্জামের খবরই জানেন না দেশি তারকারা। এ নিয়েই সকাল সন্ধ্যার রাহেনুর ইসলাম–এর চার পর্বের ধারবাহিক। আজ তৃতীয় পর্বে থাকছে বাইসাইকেল।

বাংলাদেশের দ্রুততম সাইক্লিস্ট তরিকুল ইসলাম। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে বিভিন্ন ইভেন্ট মিলিয়ে জিতেছেন ৪৪টি সোনা। ২০১৪ গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে খেলতে গিয়ে সেই তরিকুল পড়েন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে।

নিজের ইভেন্টে নামার আগে গ্লাসগো কর্তৃপক্ষ সাইকেল পরীক্ষা করে তরিকুলের। সেটা নিম্নমানের হওয়ায় আপত্তি তুলে আয়োজকরা। এই সাইকেল নিয়ে তারা খেলতে দেবে না তাকে! জাপান থেকে উপহার পাওয়া ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের চারটি সাইকেলের কোনটিই গেমসের উপযোগী মনে হয়নি আয়োজকদের। পরে বাংলাদেশের কর্তারা গেমস কর্তৃপক্ষকে ‘দেশে এটি নতুন খেলা’ বলে কোনোরকমে বুঝিয়ে অনুমতি আদায় করেন তরিকুলের জন্য।

অথচ বাংলাদেশ সাইকেল রপ্তানিতে বিশ্বে অষ্টম বৃহত্তম। তথ্যটা এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে জানার পর তরিকুল ইসলাম বললেন,‘‘এতদিন ধরে সাইক্লিংয়ে আছি, এটা তো জানা ছিল না। ফেডারেশন চাইলে যোগাযোগ করতে পারে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে। তাহলে উপহারের সাইকেলে খেলতে গিয়ে বিব্রত হতে হয় না।’’

তরিকুল এখন খেলেন বাংলাদেশ আনসারের হয়ে। আনসার কর্তৃপক্ষ চীন থেকে প্রায় ৮ লাখ টাকা দিয়ে কয়েকটা উন্নত সাইকেল এনেছে তাদের খেলোয়াড়দের জন্য। আর অনুশীলনের জন্য তরিকুল চীন থেকে এনেছেন ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দামের সাইকেল। সেই সাইকেলে অনুশীলন করেন আবার তিনজন মিলে।

এছাড়া ইউনিয়ন সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (ইউসিআই) থেকে বাংলাদেশ সাইক্লিং ফেডারেশনকে উপহার দেওয়া হয়েছিল ১০টি সাইকেল। সেগুলো নিয়ে বাংলাদেশ সাইক্লিং দলের কোচ শহিদুর রহমান জানান, ‘‘আমরা সাইকেলগুলো পেয়েছিলাম ২০১২ সালের দিকে। তখনই এগুলো ছিল পুরোনো মডেল, এখন পুরোনো হয়েছে আরও। সেসব দিয়ে বড়জোড় অনুশীলন করা যায়, আন্তর্জাতিক গেমস অংশ নেওয়া যায় না।’’

সাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশ অষ্টম বৃহত্তম

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যানবিষয়ক সংস্থা ইউরোস্ট্যাট এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে তৃতীয় ও বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম বাইসাইকেল রপ্তানিকারক দেশ। গত এক দশক থেকেই ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ রয়েছে তিন নম্বরে।

বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশি কোম্পানির মধ্যে মেঘনা গ্রুপের অবদান ৬০ শতাংশ। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া বাইসাইকেলের ৮০ শতাংশ যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। বাকিটা ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশের আরও কয়েকটি দেশে।

২৬ বছর আগে ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তাইওয়ানের কোম্পানি আলিতা বাংলাদেশ লিমিটেড স্বল্প পরিসরে বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল রপ্তানি শুরু করে। পরে এই ধারায় যুক্ত হয় মেঘনা গ্রুপ, আরএফএলসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। গাজীপুরে অবস্থিত মেঘনা গ্রুপের বাইসাইকেল কারখানার বিভিন্ন বিভাগে ১০ হাজারের মতো কর্মী কাজ করেন।

আরএফএলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড তৈরি করে বাইসাইকেল। হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ থানায় হবিগঞ্জ ইন্ড্রাস্টিয়াল পার্কে রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের বছরে ৯ লাখ বাইসাইকেল তৈরির সক্ষমতা আছে।

বর্তমানে ফ্রিস্টাইল, মাউন্টেন ট্রেকিং, ফ্লোডিং, চপার, রোড রেসিং, টেন্ডমেড (দুজনে চালাতে হয়) ধরনের বাইসাইকেল রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। রেড, ফেরাল ও ইনিগো- এই তিন ব্র্যান্ডের সাইকেল উৎপাদন করে মেঘনা গ্রুপ। বাইসাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশি কোম্পানির মধ্যে তাদের অবদান ৬০ শতাংশ।

এসব বাইসাইকেল তৈরির জন্য কিছু যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হয় অন্য দেশ থেকে। তবে চাকা, টিউব, হুইল, প্যাডেল, হাতল, বিয়ারিং, আসনের মতো বেশির ভাগ যন্ত্রাংশই তৈরি হচ্ছে দেশে। 

রপ্তানি আয় কত

ইউরোপের দেশগুলো একসময় বেশিরভাগ বাইসাইকেল আমদানি করতো চীন থেকে। কিন্তু অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করায় (প্রায় ৪৮ শতাংশ) সরে দাঁড়ায় চীন। ২০১৩ সাল থেকে উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করা হয় আরও কয়েকটি দেশের বাইসাইকেলের উপর। তাতেই বাংলাদেশের জন্য খুলে যায় সম্ভাবনার দুয়ার।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বাইসাইকেলের ডিজাইন পাঠানো হয় বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর কাছে। সেই ডিজাইন অনুযায়ী বাইসাইকেল তৈরি করে পাঠানো হয় সেখানে।

২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ  ১৬ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার এসেছিল বাইসাইকেল রপ্তানি থেকে। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসেবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ  ১৬ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার এসেছিল বাইসাইকেল রপ্তানি থেকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এরপর রপ্তানি কমে যায়। তবে গত বছর আবারও ঘুরতে শুরু করেছে রপ্তানির ‘সাইকেলের চাকা’। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী কেবল গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরেই আয় বেড়েছে গত বছরের তুলনায় ১৫০ শতাংশের বেশি।

সাইক্লিং ফেডারেশনের ভাবনা

বাংলাদেশ সাইক্লিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক তাহেরুল আলম স্বপন চৌধুরীর জানা আছে বিদেশে বাংলাদেশের বাইসাইকেলের বাজার নিয়ে। তারপরও দেশে তৈরি বাইসাইকেলে তার আগ্রহ না থাকার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন সকাল সন্ধ্যাকে, ‘‘যেসব বাইসাইকেল ওরা বিদেশে রপ্তানি করে সেগুলো দেশের বাজারে ছাড়ে না। হয়তো বেশি দামের জন্যই। ওরা আমাদের জন্য তৈরি করলে ভ্যাট, ট্যাক্স মিলিয়ে যে দাম পড়বে, সেটা বিদেশি বাইসাইকেলের চেয়ে বেশিই পড়ে যাবে।’’

একই কথা বললেন বাংলাদেশ সাইক্লিং দলের কোচ শহিদুর রহমান,‘‘ওরা বিদেশে রপ্তানির জন্য শুল্ক মুক্ত কাঁচাপণ্য আমদানি করে। আমাদের জন্য করলে সেই সুবিধা পাবে না। তবে দেশে যখন উন্নতমানের সাইকেল উৎপাদন হচ্ছে, তখন আলোচনা তো করা যেতেই পারে।’’

 প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন বিভাগের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল এ নিয়ে বললেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে চাহিদা অনুযায়ী বাইসাইকেল তৈরি করে দিতে পারব। তাতে খরচ বেশি পড়ার কথা নয়।’’

একই কথা বললেন মেঘনা গ্রুপের পরিচালক লুৎফুল বারী,‘‘স্পোর্টসের সাইকেল তৈরি করি আমরা। রপ্তানি ও দেশের বাজারের জন্য আলাদা কারখানাও আছে। ৫০০ ডলারের বাইসাইকেলের চাহিদা বেশি ইউরোপে। আর নামি অনেক ব্র্যান্ড আমাদের কাছ থেকে ফ্রেম তৈরি করে নেয়। দেশের খেলোয়াড়দের জন্য আমরা ফ্রেমটা তৈরি করে দিলেও অনেক ডলারের সাশ্রয় হতে পারে।’’

তারকা সাইক্লিস্ট রাকিবুলের চাওয়া

রাকিবুল ইসলাম। ছবি : সংগৃহীত

এসএ গেমসে সাইক্লিংয়ে একটা মাত্র পদক বাংলাদেশের। ২০১০ সালের গেমসে ৮০ কিলোমিটার রোড টাইম ট্রায়াল দলগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জেতে বাংলাদেশ। এই হতাশার মাঝেও দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভালো বেতনে চাকরি ছেড়ে সাইক্লিংয়ে যোগ দেওয়া ফার্মাসিস্ট রাকিবুল ইসলাম। মালয়েশিয়াতে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত পাওয়ারম্যান এশিয়া চ্যাম্পিয়নশিপে রুপা জেতেন তিনি।

 রাকিবুল টিম বিডিসি সাইক্লিং দলের সদস্য। এই দলের চার সাইক্লিস্ট মিলে ২০২১ সালের নভেম্বরে ৪৮ ঘণ্টায় ১ হাজার ৬৬৭ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস গড়েছিলেন।

গত বছর ৯ জুন খাগড়াছড়ির জিরোমাইল সমতল থেকে তারেং পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত টানা ১৮ বার উঠানামা করে রাকিবুল জায়গা পান এভারেস্টিং কর্তৃপক্ষের ‘হল অব ফেমে’।

সাইক্লিংয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করা রাকিবুল প্রতিযোগিতায় অংশ নেন তাইওয়ানের তৈরি ‘জায়ান্ট’ ও ‘ড্রাইস’ ব্র্যান্ডের বাইসাইকেলে। দেশি ব্র্যান্ডের বাইসাইকেল নিয়ে তার পরামর্শ,‘‘সাইক্লিংয়ের উন্নতির জন্য সবার আগে দরকার ভেলোড্রাম। বাংলাদেশে একটিও ভেলোড্রাম নেই, পাশের দেশ ভারতে আছে ১৭টা। দেশের বাইসাইকেল ইউরোপ ব্যবহার করছে, আর আমরা খেলছি আমদানি করা বাইসাইকেলে-এটা বিস্ময়ের। ফেডারেশনের কর্তাদের পরামর্শ দেবো, দেশী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। অল্প দামে ভালো বাইসাইকেল কিনতে পারলে উন্নতিই হবে খেলাটার।’’

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত