Beta
শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫

জনশক্তি রপ্তানিতে ধস, ইউনূস ম্যাজিক প্রত্যাশা

প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।
প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।
[publishpress_authors_box]

ধস নেমেছে জনশক্তি রপ্তানিতে; তাতে রেমিটেন্স নিয়ে শঙ্কা তৈরি করছে। এই অবস্থায় উদ্বিগ্ন জনশক্তি রপ্তানিকারকরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মৃুহাম্মদ ইউনূসের সহায় চাইছেন। তারা ভাবছেন, নোবেলজয়ী এই বাংলাদেশি তার ভাবমূর্তি দিয়ে বদলে দিতে পারেন চিত্র।

রিজার্ভ নিয়ে সংকটে থাকা বাংলাদেশে রেমিটেন্সই উত্তরণের বড় হাতিয়ার। কারণ যত বেশি বাংলাদেশি কাজ নিয়ে বিদেশে যাবে, তত বেশি ডলার তারা পাঠাবে। আর তা মজবুত করবে দেশের অর্থনীতি।

পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৬ লাখ ৩৩ হাজার কর্মী চাকরি নিয়ে বৈধভাবে বিদেশে গেছে।

এই ধারায় চলতে থাকলে বছর শেষে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা দাঁড়াবে ৯ লাখ ৬৩ হাজার জনে; তা আগের বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ কম হবে। ২০২৩ সালে এক বছরে ১৩ লাখের বেশি লাখের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছিল।  
কেন কর্মসংস্থান কমছে, তার যে কারণ পাওয়া যাচ্ছে, তা হলো, প্রবাসে কর্মসংস্থানের বড় গন্তব্যগুলো বন্ধ হওয়া এবং কিছু শ্রমবাজারে কর্মী নেওয়া কমিয়ে দেওয়া।

যেমন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে কর্মী যাওয়ার হারে বড় ধরনের ধস নেমেছে। একইভাবে ধস নেমেছে আরেক বড় গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাতেও। এছাড়া মালয়েশিয়া এবং ওমানে কর্মসংস্থান এখন পুরোপুরি বন্ধ।

তবে ছোট ছোট কিছু দেশ যেমন কুয়েত, কাতার, সিঙ্গাপুরে কর্মী নেওয়ার হার বাড়তে থাকায় প্রবাসী কর্মসংস্থানের সংখ্যা তলানিতে এখনও পৌঁছেনি।

জনশক্তি রপ্তানিকারক গালফ ট্রাভেলসের কর্ণধার শাহ আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির মুল বাজারই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক। এর বাইরে আছে কেবল মালয়েশিয়া।

“এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভিসা পুরোপুরি বন্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের বড় শ্রমবাজার ওমানে কর্মী নেওয়া বন্ধ, আর সৌদি আরব কর্মী নেওয়া চালু রাখলেও সেদেশ থেকে ভিসা ইস্যু হচ্ছে খুবই কম। এর প্রভাবেই কর্মী যাওয়ার হার কমেছে।”

বিদেশে কর্মী পাঠানোর তথ্য সংরক্ষণ করে বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)।

বিএমইটির হিসাবে, বিশ্বের ১৬৮টি দেশে চাকরি নিয়ে বাংলাদেশ থেকে মানুষ যায়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৬১ লাখ।

এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছে ৫৮ লাখ জন; মোট কর্মী বিবেচনায় এই হার ৩৬ শতাংশ। ২৬ লাখ গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে, যার হার ১৬ শতাংশ। প্রায় ১৯ লাখ গেছে ওমানে; যার হার সাড়ে ১১ শতাংশ। মালয়েশিয়ায় গেছে সাড়ে ১৪ লাখ; যার হার ৯ শতাংশ। এর বাইরে সিঙ্গাপুর প্রায় ৬ শতাংশ আর কুয়েত সাড়ে ৪ শতাংশ।

এক বছরে সর্বোচ্চ কর্মসংস্থানের রেকর্ড সৌদি আরবে। ২০২২ সালে গড়া সেই রেকর্ডে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ ১২ হাজার কর্মী সৌদি আরব গিয়েছিল কাজ নিয়ে।

মোটা দাগে এই ৬টি দেশেই কর্মসংস্থান হয়েছে ৮৩ শতাংশ। বাকি ১৭ শতাংশ কর্মী গেছে ১৬২ দেশে। এই থেকেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশের কর্মসংস্থানের গন্তব্যের মূল চিত্র ফুটে ওঠে।

বিশ্বের ১৬৮টি দেশে কাজ করছে বাংলাদেশের কর্মীরা।

কর্মসংস্থান কমার ধারা

বিএমইটির হিসাবে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রবাসে কর্মসংস্থান হয়েছে ২০২৩ সালে ১৩ লাখ ৫ হাজার জনের। সে বছর প্রতিদিন গড়ে ৩৫৭৬ জন কর্মী গিয়েছিল।

২০২২ সালে ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী বিদেশে গিয়েছিল চাকরি নিয়ে; দিনে গড়ে ৩১১১ জন।

২০২৪ সালের জানুয়ারি-আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৬ লাখ ৩৩ হাজার কর্মী চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছে। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ২৬৪১ জন।

এই বছর সবচেয়ে কম কর্মী গেছে আগস্টে; সংখ্যাটি ৫৩ হাজার জন। আগস্টে যারা গেছে, তাদের ভিসা প্রক্রিয়া শেষ করে অনুমোদন হয়ে জুন-জুলাইয়ে।

জুলাই-আগস্টে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনুমোদন প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তার আঁচ বোঝা যাবে অক্টোবরের পরের মাসগুলোতে।

এই বছরের জানুয়ারিতে প্রায় ৮৮ হাজার কর্মী চাকরি নিয়ে বিদেশে যায়। মে মাসে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩১ হাজারে। জুন মাসে নেমে দাঁড়ায় ৫৫ হাজার জনে। জুলাই মাসে কিছুটা বেড়ে সাড়ে ৭১ হাজার জনে উন্নীত হলেও আগস্টে আবার কমে যায়।

কোন দেশে গেল কত

বিএমইটির কর্মী পাঠানোর সর্বশেষ তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী যায় মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। কিন্তু সেই দেশগুলোতে কর্মী পাঠানোয় বড় ধরনের ধস নেমেছে।

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে সৌদি আরবে কর্মী গিয়েছিল ৪৯ হাজার জন। আগস্টে তা ২৮ হাজারে নেমেছে। কর্মী পাঠানোর সংখ্যা কমেছে ২১ হাজার আর শতাংশের হিসাবে সাড়ে ৪২ শতাংশ।

সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়েছিল মালয়েশিয়ায়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সেই দেশে কর্মী গিয়েছিল ৪ হাজার জন। আগস্টে এসে কর্মী যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আগস্টে গেছে মাত্র ৫২ জন।
আমিরাতে জানুয়ারিতে কর্মী গিয়েছিল ১০ হাজার জন। আগস্টে এসে সেটি ৬ হাজারে নেমেছে।

ওমানে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া এখন পুরোপুরি বন্ধ আছে। বন্ধ আছে বাহরাইনে কর্মী নেওয়াও। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশে জর্ডান, লেবাননে কর্মী পাঠানো কমেছে।

বিএমইটির তালিকা অনুযায়ী, যে কয়েকটি দেশে কর্মী পাঠানো বেড়েছে, সেগুলো হলো কুয়েত, কাতার, সিঙ্গাপুর। তবে সেখানে যাওয়ার সংখ্যা কম।

সিঙ্গাপুরে জানুয়ারিতে কর্মী গিয়েছিল ৩৬০১ জন; আগস্টে সেটি বেড়ে ৫১০৫ জন হয়েছে। কাতারে জানুয়ারিতে কর্মী গিয়েছিল ২০১৭ জন; আগস্টে তা প্রায় ৬ হাজার জনে উন্নীত হয়েছে।

২০২৪ সালের আট মাসের কর্মী পাঠানোর হিসাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, ৬ লাখ ৩৩ হাজার কর্মীর ৫২ শতাংশই গেছে সৌদি আরবে। ১৫ শতাংশ গেছে মালয়েশিয়ায়। ৮ শতাংশ কাতারে। ৭ শতাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ৬ শতাংশ সিঙ্গাপুরে।

২০২৩ সালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, ২০২৩ সালে যেসব দেশ কর্মী পাঠানোর শীর্ষে ছিল, ২০২৪ সালে এসে সেই দেশে কর্মী পাঠানোয় নেমেছে ধস।

২০২৩ সালে শুধু সৌদি আরবেই কর্মী গিয়েছিল ৪ লাখ ৯৮ হাজার জন। মালয়েশিয়ায় গিয়েছিল ৩ লাখ ৫১ হাজার জন। ওমানে ১ লাখ ২৭ হাজার জন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৯৮ হাজার জন। কাতারে ৫৬ হাজার জন। সিঙ্গাপুরে ৫৩ হাজার জন এবং কুয়েতে সাড়ে ৩৬ হাজার জন।

তবে বিদেশে প্রচুর কর্মসংস্থান হলেও রেমিটেন্স সেই হারে বাড়ে না। এর কারণ হিসাবে অদক্ষ-স্বল্প বেতনে চাকরিকে কারণ হিসাবে দেখা হয়।

২০২৩ সালে যে ১৩ লাখ কর্মী বিদেশে গিয়েছিল, বিএমইটি বলেছে, তাদের মধ্যে দক্ষ কর্মী প্রায় ২৫ শতাংশ এবং অদক্ষ প্রায় ৫০ শতাংশ। বাকিরা আধা-দক্ষ এবং পেশাদার।

উদাহরণ হিসাবে যুক্তরাজ্যকে নেওয়া যায়। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে সেখানে কর্মী গেছে মাত্র ৩০৭৭ জন। ২০২৩ সালে গিয়েছিল ১০ হাজার ৩৮৩ জন। কিন্তু প্রবাসী আয়ের দিক থেকে দেশটি তৃতীয় স্থানে।

২০২৪ সালের জানুয়ারি-এপ্রিলে যুক্তরাজ্য থেকে প্রবাসী আয় এসেছে ৯৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার; যা মোট প্রবাসী আয়ের ১২ শতাংশ।

আবার বিদেশে কর্মসংস্থানে প্রথম ২০ দেশের তালিকায় নেই যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মোট প্রবাসী আয়ের ১৪ শতাংশ আসে সেই দেশ থেকে।

মূলত এসব দেশে দক্ষ, প্রশিক্ষিত কর্মীরা উচ্চ বেতনে চাকরি করছে বলে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় বেশি বলে ধারণা করা যায়।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট রেমিটেন্স এসেছিল ২৩ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এসেছে ৪১৩ কোটি ডলার।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রবিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ছবি : পিআইডি
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি : পিআইডি

ড. ইউনূসে তাকিয়ে রপ্তানিকারকরা

জনশক্তি রপ্তানিকারকরা আশায় আছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে একটি ভূমিকা রাখবেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় দুবাইয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি। সরকার পতনের পর ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে আমিরাত সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন তাদের ছেড়ে দিতে। তাতে সাড়াও পেয়েছিলেন।

বিদেশে ড. ইউনূসের যে ভাবমূর্তি, তা জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রেও কাজে লাগানো যায় বলে মনে করেন গালফ ট্রাভেলসের কর্ণধার ও হজ এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশন, চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান শাহ আলম।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশ্ব পরিচিতি কাজে লাগিয়ে বন্ধ হওয়া বড় বাজার কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় দ্রুত খুলতে হবে। তা না হলে এই ধস ঠেকানো যাবে না।”

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে বন্ধ হওয়া মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলতে ড. ইউনূসের প্রভাব কাজে লাগানোর কথা বলেছিলেন। তার আশা, আগামী দুই মাসের মধ্যে শ্রমবাজার সম্প্রসারণের নতুন খবর দেওয়া যাবে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক মাসুদ রানা এবিষয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে চাননি।

তবে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, মালয়েশিয়ার বড় শ্রমবাজার নষ্টের মূল কারণ রাজনৈতিক প্রভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত। বিশ্বের ১৫টি দেশ থেকে কর্মী নেয় মালয়েশিয়া। এর মধ্যে ১৪টি দেশ থেকে কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এজেন্সি বাছাইয়ের শর্ত দেয়নি। সেটি দিয়েছে কেবল বাংলাদেশেই। এই কারণে শ্রমবাজার সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নষ্ট হয়েছে।

তাই প্রবাসে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের গুরুত্ব তুলে ধরে তারা।  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত