অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত। এই সূচক নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আছে দেশে। তবে গত তিন সপ্তাহে রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়েছে। তাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি অবস্থান করছে এখন রিজার্ভ।
আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ঋণ দিয়েছে তার সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর শেষে প্রকৃত বা নিট রিজার্ভ থাকার কথা ছিল ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। বছর শেষে প্রকৃত রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বুধবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা প্রকৃত রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ রাখার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিলাম। সেটা সফল হয়েছে। আমাদের রিজার্ভ আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি।”
রিজার্ভ আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারায় পত্রপত্রিকার রিপোর্ট নিয়ে তিনি বলেন, “এখানে পরিষ্কার করে একটা কথা বলা প্রয়োজন– আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়। তারা একটি লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। পুরোপুরি অর্জন করতে না পারলেও কাছাকাছি পৌঁছানো গেছে।”
“আইএমএফ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সামান্য পিছিয়ে থাকাকে ‘অর্জন হয়নি’ বিবেচনা করবে না।”
তিনি বলেন, “আইএমএফ যেটা বলেছে সেটা সময়ভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা। রিজার্ভ এর কম বা বেশি হতেই পারে। লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ ব্যাংকের যত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, তা নিয়েছে।”
‘সরকার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারলে আরও ভালো হতো’ মত দিয়ে অর্থনীতি গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তবে এটা দেখে ভালো লাগছে যে, সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করেছে।”
“নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে রিজার্ভ বেশ খানিকটা বেড়েছে। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের বাকি কিস্তি পেতে বাংলাদেশকে আগামী মাসগুলোতে এই গতি ধরে রাখতে হবে,” বলে অভিমত দেন দীর্ঘদিন আইএমএফে চাকরি করে আসা আহসান মনসুর।
প্রকৃত রিজার্ভ কী?
প্রকৃত রিজার্ভ হলো দায়হীন রিজার্ভ। প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব কীভাবে হবে, সেই সূত্রও ঋণ দেওয়ার সময় বাংলাদেশকে জানিয়ে দেয় আইএমএফ। সংস্থাটি ঋণের শর্ত হিসেবে নির্দিষ্ট সময় পরপর কী পরিমাণ প্রকৃত রিজার্ভ রাখতে হবে, তা-ও ঠিক করে দেয়। সেই অনুযায়ী, প্রতি তিন মাস পরপর আইএমএফের শর্ত মেনে রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হচ্ছে।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরেও আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে বাংলাদেশের অনুরোধে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্য কমিয়ে দেয় সংস্থাটি। ডিসেম্বর শেষে সেই সংশোধিত লক্ষ্যও পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
প্রকৃত রিজার্ভ হলো আইএমএফের এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) খাত, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে রাখা ডলার ও এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন বা আকুর বিলের জন্য জমা থাকা ডলার বাদ দিয়ে যে হিসাব হয়—সেই রিজার্ভ।
এসডিআর হলো আইএমএফের একধরনের নিজস্ব অর্থব্যবস্থা। আইএমএফের সম্পদ ও ঋণকে এসডিআর এককে গণনা করা হয়। তবে এটি নিজে কোনো মুদ্রা নয়, একটি ধারণামাত্র। এসডিআরের মান ধরা হয় মার্কিন ডলার, ইউরো, চীনা রেনমিনবি, জাপানি ইয়েন ও পাউন্ড—এই পাঁচ মুদ্রার আনুপাতিক গড় হিসাব করে। তবে বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এর মূল্যমানকে সমর্থন করে।
বুধবার ১ এসডিআরের মূল্যমান ছিল ১ দশমিক ৩৪ মার্কিন ডলার। সদস্যদের চাঁদা থেকে আইএমএফের তহবিলে জমা আছে প্রায় ৪৭ হাজার ৬২৭ কোটি ২০ লাখ এসডিআর। এর মধ্যে বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে ১০৬ কোটি ৬৬ লাখ এসডিআর, যা মোট এসডিআরের দশমিক ২২ শতাংশ।
এর বাইরে রিজার্ভের আরও দুটি হিসাব রয়েছে। তার একটি হলো মোট বা গ্রস রিজার্ভ। আরেকটি আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রক্ষিত রিজার্ভ।
বুধবার দিনের শুরুতে বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২৭ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, “রিজার্ভ ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় ডলারের জোগান বেড়েছে; সংকট কেটে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ডলারের দর ১ টাকা কমেছে।”
রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় রিজার্ভ বেড়েছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসছে বলে মনে করেন মেজবাউল হক।
বিদায়ী ২০২৩ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর আগের বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে একই মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৫৩০ কোটি ৮১ লাখ (৫.৩১ বিলিয়ন) ডলার দেশে এনেছেন রপ্তানিকারকরা। একক মাসের হিসাবে এই আয় এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি; আর বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫৩৬ কোটি ৫২ লাখ (৬.৩৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল একক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ।
পটভূমি
ডলার-সংকটের মধ্যে আর্থিক হিসাব ও চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিলে ২০২২ সালের জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে ঋণ চায় বাংলাদেশ। ছয় মাস পর সংস্থাটি গত বছরের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার ও গত মাসে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।
ঋণ দেওয়ার সময় আর্থিক খাতে নানা সংস্কারের পাশাপাশি বেশ কিছু শর্তও জুড়ে দেয় আইএমএফ। শর্ত অনুযায়ী গত জুন শেষে নিট রিজার্ভ থাকার কথা ছিল ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ওই সময় তা ছিল ২০ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
আইএমএফের নতুন শর্ত অনুযায়ী, আগামী মার্চে প্রকৃত রিজার্ভ থাকতে হবে ১৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। জুনে থাকতে হবে ২০ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার।
আইএমএফের ৪২ মাসের ঋণ কর্মসূচির পরবর্তী পর্যালোচনা আগামী মে মাসে অনুষ্ঠিত হবে। তখন বাংলাদেশ ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।