‘আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া, সন্ধান করিয়া/ স্বপ্নের ওই পাখি ধরতে চাই/ আমার স্বপ্নের কথা বলতে চাই; আমার অন্তরের কথা বলতে চাই।’ কথাগুলো সঞ্জীব চৌধুরীর। স্বপ্নের ওই পাখিটাকে ধরতে তিনি সত্যিই পথে পথে ঘুরেছেন, নির্দ্বিধায় বলে গেছেন তার অন্তরে জেগে ওঠা সমস্ত কথা। গানে-কবিতায় সেসব কথায় উঠে এসেছে অসংখ্য প্রতিবাদ, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া সমাজের নানা অসঙ্গতি এবং সত্য।
সংগীতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিবাদ করার যে প্রবণতা আমাদের দেশের শিল্পীদের মধ্যে রয়েছে, সঞ্জীব চৌধুরী তাদের উত্তরসুরি। তিনি গানে হৃদয়ের কথা বলতে চেয়েছেন, নিপীড়িত মানুষের কথা বলতে চেয়েছেন। যখনই যেখানে নিপীড়ন হয়, মানুষের দুর্দশা তুলে ধরার প্রয়োজন হয়- সেখানেই সঞ্জীব চৌধুরী প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন।
তিনি ছিলেন একাধারে সুরকার, গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী এবং একইসাথে একজন প্রতিবাদী সংগঠক। দলছুট ব্যান্ডের হয়ে গাইতেন। আলাদা হয়েও গেয়েছেন বেশ কিছু গান। যে গানই গেয়েছেন তাই মানুষের হৃদয়ে গেঁথে গেছে।
মাত্র ৪৩ বছরের জীবনে তিনি শ্রোতাহৃদয়ে অমরত্ব পেয়ে গিয়েছিলেন। ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’, ‘কিংবদন্তি’, ‘চল বুবাইজান’, ‘ইয়াসমিন’, ‘চাঁদের জন্য গান’, ‘কালা পাখি’, ‘সাদা ময়লা রঙিলা পালে’, ‘বাজি’, ‘নৌকাভ্রমণ’, ‘বায়োস্কোপ’, ‘সমুদ্রসন্তান’, ‘ভাঁজ খোলো’, ‘চোখ’, ‘কথা বলব না’, ‘বয়স হলো ২৭’, ‘অচিন বৃক্ষ’, ‘জোছনাবিহার’, ‘জোছনাদুয়ারি’, ‘কার ছবি নেই’, ‘সানগ্লাস’, ‘মনে পড়ে’, ‘আমার সন্তান’, ‘নষ্ট শহরে’, ‘হৃদয়ের দাবি রাখো’সহ অসংখ্য গানে তিনি নিজের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তার প্রাণের জায়গা। শিল্পী হিসেবে বেড়ে ওঠার পেছনে এ বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি আর সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল। তিনি এ সংগঠনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন। কেমন করে তাকে ভাবছে নতুন প্রজন্ম? কেন তিনি আজও প্রাসঙ্গিক?
সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের বর্তমান সভাপতি মাহাবুব খালাসী বলেন, “আমি মনে করি আমাদের ক্যাম্পাসে প্রতিবাদের ভাষায় সঞ্জীবদা মিশে আছেন। শিল্প যে প্রতিবাদের শক্তিশালী একটি ভাষা হতে পারে সে জায়গায় তিনি পথিকৃৎ হয়ে আছেন। সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি, যেখানেই মানুষের পক্ষে কথা বলার প্রসঙ্গ আসে সেখানেই সঞ্জীব চৌধুরী প্রাসঙ্গিক হয়ে আসেন।”
সঞ্জীবের চলে যাওয়ার দিনে মঙ্গলবার সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের উদ্যোগে টিএসসিতে আয়োজিত হয় ‘সঞ্জীব সন্ধ্যা’। কনসার্টে গান গাইতে আসা তুহিন কান্তি দাস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কিছুদিন আগেই তো আমাদের একটা বড় অভ্যুত্থান হলো, আরেকটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন রোপিত হল। সঞ্জীবদা যখন ছিলেন, ছাত্র-জনতা কিংবা আপামর মানুষের মধ্যে একটা বৈষম্য মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। এই সময়ে এসে তাকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে যে বাস্তবতা তা হল-তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন সে স্বপ্নকে অনুধাবন করে তার জীবন দর্শনের পাঠ নেয়া। সে জায়গা থেকেই সাংস্কৃতি ইউনিয়নের এ প্রয়াস।”
তুহিন কান্তি দাস আরও বলেন, “আমি মনে করি, আমাদের চারপাশে অনেক শিল্পী আছেন, কিন্তু মানুষের কথা বলা, যে বৈষম্য সমাজে আছে, সে বৈষম্যের কথা বলা শিল্পীর সংকটও আছে, সবসময় ছিল। সঞ্জীবদা তার থেকে অনেকখানি আলাদা। আমাদের মতো অনেককে তিনি স্বপ্ন দেখান।”
সংসারে থেকেও সংসার ত্যাগী সঞ্জীব চৌধুরীর সংগীত পরিচয়ের আড়ালে যেটি ঢাকা পড়ে যায়, সেটি হলো তার সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় ফিচার বিভাগকে বদলে দিয়েছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। তার হাত ধরে উঠে এসেছেন অসংখ্য দুর্দান্ত ফিচার লেখক। বলা যায়, বাংলাদেশের এই ফিচার ধারাটিকে মূল সংবাদের কাছাকাছি জনপ্রিয় কিংবা তার চেয়েও বেশি মোক্ষম করে তোলায় সঞ্জীব চৌধুরী ছিলেন অগ্রগণ্য। দেশের বিনোদন ও লাইফস্টাইল সাংবাদিকতার ইতিহাসে সঞ্জীব চৌধুরী একজন কিংবদন্তী।
মঙ্গলবার বিকেলে সাংস্কৃতিক ইউনিয়নের গান দিয়ে শুরু হয় ‘সঞ্জীব সন্ধ্যা’। এরপরে মঞ্চে ওঠেন অন্যান্য আমন্ত্রিত অতিথিরা। গান, কবিতা পাঠ, নৃত্য পরিবেশনা এবং স্মৃতিচারণের মাধ্যমে স্মরণ করা হয় সঞ্জীব চৌধুরীকে। পরিবেশনার যুক্ত ছিলেন সমসাময়িক গণমুখী শিল্পপ্রেমী, কলাকুশলী এবং সঞ্জীব চৌধুরীর সহযোদ্ধা-বন্ধু-পরিজন।
সন্ধ্যায় টিএসসির সঞ্জীব চত্বরে মোমবাতি প্রজ্বলন এবং পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে সঞ্জীব চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠানে গান এবং কবিতা পাঠের আয়োজনে অংশগ্রহণকারীরা হলেন- অং, অরোরা ফেরদৌস, অনিক দাস, অনিন্দ্য বিশ্বাস, অর্থি আনজুম, আজওয়াদ, ক্রানুপ্রু মার্মা লোটাস, প্রহরী, ফাইজা ফাইরুজ রিমঝিম, তথাপি আজাদ, তাসনিম ইজাজ, তুহিন কান্তি দাস, নবীন কিশোর গোস্বামী ও আকাশ গায়েন, নিনাদ খান, ব্লাইন্ডস্পট, মারুফ মৃন্ময়, জয়ন্ত পাল জয় ও ইমরান হোসাইন, মুয়ীয মাহফুজ, রাইয়ান আজমাঈন, লাঞ্জু, শান্তনু, অমি ও রেজওয়ান, শাহনেওয়াজ তুষার, শেখ শাবাব ত্বকী রূপক, সায়েম জয়, সূর্য পলাশ, সোহেল রায়হান, সৈকত আমীন এবং সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন পারফরমেন্স টিম।