- ২৪ বছরেও টেস্ট খেলতে শেখেনি বাংলাদেশ
- তরুণদের ক্রিকেট আবেগে টেস্টের কোনও জায়গা নেই
- ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামোর উন্নতিতে উদ্যোগী নয় বিসিবি
প্রায়ই দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় দেশের টেস্ট ক্রিকেটে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খুব বাজেভাবে টেস্ট সিরিজ হারের পর সেই হতাশা আবার ফিরেছে প্রবলভাবে- ২৪ বছরেও বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট খেলতে শিখল না!
• কীভাবে শিখবে? যিনি আপাদমস্তক টেস্ট ক্রিকেটার সেই মুমিনুল হকের তো অমন খ্যাতি নেই এদেশের ক্রিকেটে। টেস্টে সবচেয়ে বেশি ১২ সেঞ্চুরির মালিকের তো সাকিব-তামিমদের মতো বিশেষ ভক্তকূল নেই। তাকে নিয়ে অমন আলোড়নও হয় না। টেস্টকে আলিঙ্গন করে নীরবে-নিভৃতে দেশের বৃহৎ ক্রিকেট আঙিনায় এক কোনায় পড়ে থাকেন অদৃশ্য সুঁইয়ের মতো।
• টেস্ট ক্রিকেটকে প্রিয় ফরম্যাট বলে মানেন, দেশের এমন এক ক্রিকেটারের নাম বলুন তো? আপনি মনে করতে পারবেন না। দেশের কোনও ক্রিকেটারের মুখেই আপনি এমন ভালোলাগার কথা শুনেননি। উল্টো শুনেছেন, দুই-একজন দেশি তারকা টেস্ট না খেলে আইপিএল খেলার ছুটি চেয়েছেন বিসিবির কাছে। নিশ্চয় মনে আছে, মোস্তাফিজের টেস্টের চেয়ে আইপিএল-প্রীতি দেখে দুই বছর আগে খেপেছিলেন বিসিবি পরিচালক খালেদ মাহমুদ।
লাল বলের ক্রিকেট-বোধই নেই
সত্যি বললে, রাগ-ক্ষোভ দেখিয়ে লাভ নেই। দেশের ক্রিকেটে হালের জোয়ার ও তরুণদের মধ্যে যে ক্রিকেট আবেগ কাজ করে সেখানে টেস্টের কোনও জায়গা নেই। সবাই ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির বেগের সঙ্গে তাল মেলাতে চাইছে। এখানে গ্ল্যামার আছে, অনেক অর্থ আছে। তরুণদের মতো তাদের অভিভাবকদের ‘লোভাতুর চোখ’-ও সেদিকে। এই দুটো সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে মোটামুটি খেলতে পারলে ছেলের জীবনে অন্তত অর্থ সংকট থাকবে না। তার একটা ক্যারিয়ার তৈরি হয়ে যাবে।
সবাই এখন ক্যারিয়ার গড়ার ইঁদুর-দৌড়ে সামিল হয়েছে। কেউ গুণেমানে বড় ক্রিকেটার হওয়ার কথা ভাবে না। ক্রিকেট মাধুর্য ছড়িয়ে কেউ বিশ্ব ক্রিকেটে ডানা মেলে উড়ার স্বপ্ন দেখে না। ক্রিকেট ব্যাট শুধুই শট খেলার জন্য নয়, শটের সুরভীর পাশাপাশি নিখুঁত রক্ষণও একজন ব্যাটারকে আকর্ষণীয় করে তোলে। বোলারের ভালো বলকে কুর্নিশ জানানোর মধ্যেও লুকিয়ে আছে ক্রিকেটীয় সৌন্দর্য। এসব আপনার কতটা কী আছে তার পরীক্ষা নেয় টেস্ট ক্রিকেট।
টি-টোয়েন্টি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেও ডেভিড ওয়ার্নার হয়ে গেছেন দুর্দান্ত টেস্ট ওপেনার। লাল বলের ক্রিকেট থেকে কিছুদিন আগেই অবসর নিয়েছেন তিনি। তবে তার কাছে এই ফরম্যাটই ক্রিকেটের আসল জায়গা, “লাল বলে ক্রিকেট খেলতে আসা ছেলেদের আমি পছন্দ করি। কারণ এটাই খেলাটির ঐতিহ্য যা আপনি পেছনে রেখে যেতে চান। এটাই ক্রিকেটের সত্যিকারের পরীক্ষার জায়গা। আপনি কতটা ভালো খেলেন, এটা দিয়েই তার পরিমাপ হয়।” এই মাপে বাংলাদেশের কজন টিকবেন!
আরেক ভারতীয় কীর্তিমান ব্যাটার বিরাট কোহলি বলছেন, “টেস্টই হলো ক্রিকেটের আসল ভিত। আমার কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে। এর ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বাকি সবের থেকে আলাদা। চার-পাঁচ দিনের খেলায় নিজেকে নিংড়ে দিতে হয়। ক্রিকেট খেলতে আপনি যত অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা তার মধ্যে সম্পূর্ণ অন্যরকম।”
এদেশের কোনও ক্রিকেটারের মনোজগতে এমন ভাবনার উদয় হয়েছে কিনা, ঘোরতর সন্দেহ আছে। আপনি মনপ্রাণ দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটকে ধারণ করতে না পারলে কখনোই মাঠে গিয়ে তার প্রকাশ ঘটাতে পারবেন না। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বোধ ও টেকনিক নিয়ে আপনি টেস্ট সমুদ্রে নামলে ডুবে মরার ভয় থাকবেই। তাই বেশিরভাগ সময় ডুবছে। স্কোরবোর্ডে শ্রীলঙ্কার পাঁচশোর্ধ্ব রান দেখার পরও চট্টগ্রামের ব্যাটিং উইকেটে নেমে লিটন-শান্তরা উইকেট বিলিয়ে আসেন।
বিসিবির দায়ও অনেক
টেস্ট হারলেই কেবল গেল গেল রব ওঠে। তার আগে বিসিবি কর্তাদের টেস্ট দরদী হতে দেখা যায় না। তাদের কাছেও বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচের গুরুত্ব নেই। থাকলে এটি আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতো, অবকাঠামোর উন্নতি হতো।
পাশের দেশ ভারতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আছে রঞ্জি ট্রফি, দুলীপ ট্রফি, ইরানি ট্রফির মতো টুর্নামেন্ট। এগুলোই হলো তাদের ক্রিকেট শিক্ষার পীঠস্থান। যেখানে টেকনিক ও টেম্পারমেন্টের পরীক্ষা দিয়ে জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে হয় ক্রিকেটারদের। সেই মানের টুর্নামেন্ট এখানে নেই। আমাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মঞ্চটা বড় দুর্বল। টেস্টের অন্ধকার কাটিয়ে যে পথের জোনাক জ্বালাবে, সেই ক্ষমতা তার নেই।
মুমিনুলের স্বীকারোক্তি, এখানকার চাপহীন খেলায় টেস্ট ক্রিকেটের চ্যালেঞ্জের ছিটেফোঁটাও অনুভব করেন না তিনি। তাই সেই মানের টেস্ট ব্যাটারের অভাব দেখে আক্ষেপ করেন প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। উপায়ন্তর না দেখে তিনি বলছেন, “টেস্ট খেলে খেলেই আমাদের শিখতে হবে।” কিন্তু এটা কখনও সামগ্রিক শিক্ষার ক্ষেত্র হতে পারে না। শিখতে হবে ঘরোয়া ক্রিকেটে, আর কতটুকু শিখলাম তার প্রমাণ দিতে হবে টেস্ট ক্রিকেটে।
কারণে-অকারণে দেশের মানুষ ক্রিকেটে বুঁদ হয়ে আছে। স্কুলের বাচ্চারাও সেই মোহে আবিষ্ট। বিসিবিতেও অর্থের টান নেই, হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়ের গল্প ফিরছে তাদের মুখে মুখে। সেই থেকে সামান্য বিনিয়োগে রচিত হতে পারে ঘরোয়া ক্রিকেট উন্নয়নের একটি ছোট গল্প, যা খেলাটিকে আরও গৌরব ও সুষমামন্ডিত করতে পারে।
পরিশেষে
একসময় দেশের ফুটবলেও সব ছিল। অর্থ-তারকা-জনজোয়ার সবই। তারকার শোভা ছিল মাঠে। উপচে পড়া দর্শক ছিল গ্যালারিতে। তারুণ্যের মোহ তৈরি হয়েছিল ফুটবলে। ফুটবলের এই শোভার পেছনে কোনও উদ্যোগ ছিল না, বিশেষ কারও হাত ছিল না। বিনোদনের অভাবের যুগে সহজলভ্য ফুটবল ও প্রাকৃতিক পরম্পরায় দেশের আনাচে-কানাচে খেলাটি সুরভিত হয়েছিল। ঢাকার মাঠে তা আরও রসোত্তীর্ণ হয়ে মানুষের হৃদয়ে দোলা দিয়ে জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এটি পুরোপুরিই প্রাকৃতিক ছিল। সংগঠকরাও হয়তো ভেবেছিলেন, জেলা থেকে ফুটবলার আসতেই থাকবে এবং এই ধারা বহমান থাকবে আজীবন। সেটাই ছিল বড় ভুল।
জেলা ও ঢাকার ফুটবলকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়নি বলে ফুটবলের সেই রসের ধারা আর অটুট থাকেনি। ফুটবলের ছন্নছাড়া বাতাবরণের মধ্যে এখন নানা চেষ্টা-চরিত্র করেও হচ্ছে না। নাজমুল হাসান ক্রীড়ামন্ত্রী হয়েও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
তাই বলি, ক্রিকেটের ঝরনার দুরন্ত উচ্ছ্বাস থেমে গেলে, মানুষের মোহ কেটে গেলে কিন্তু বড় বিপদ হয়ে যাবে। শত চেষ্টা করলেও তখন হবে না। টেস্ট ক্রিকেট বারবার সতর্ক সংকেত দিচ্ছে নাজমুল হাসানের ক্রিকেটকে।