অবিস্মরণীয়, অভাবনীয়-যা কল্পনাও করেনি বাংলাদেশের নিপাট ক্রিকেটপ্রেমীও। না ভাবে রাখা চিন্তাপটে রং-তুলির আঁচড়ে ভালো লাগার ছবি এঁকে দিয়ে গেল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ১৫ বছর পর স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে উইন্ডিজের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয় এনে দিল ১০১ রানের। এবার অবশ্য তাদের সেরা দলটিকে হারিয়েই। এতে সিরিজ ১-১ এ ড্র হলো।
এই টেস্টে গল্পের মতো হলো সব। আগের টেস্টে তাকালে যা কখনও বিশ্বাস হবে না। পিছিয়ে পড়ে ফিরে আসার গল্প এটা। ব্যাটারদের শুরুর ব্যর্থতা বল হাতে ফর্মুলা ওয়ান গতিতে উড়িয়ে দিলেন নাহিদ রানা। মাঝে জাকের আলির দৃপ্তচিত্তে লড়াই দেখিয়ে দিল বিদেশের মাটিতে একজন বাংলাদেশি ব্যাটারের সাহস ও দায়িত্ব নিয়ে খেলার সবচেয়ে ভালো উদাহরণটা। শেষে তাইজুল ইসলাম মেলে ধরলেন নিজের অভিজ্ঞতার সবটা।
উইন্ডিজকে ২৮৭ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দিয়ে ১৮৫তে অলআউট করে দেওয়া গেছে। পাওয়া গেল ক্যারিয়ানদের মাটিতে তৃতীয় টেস্ট জয়। সেই সঙ্গে এক বছরে সমান সংখ্যক অ্যাওয়ে টেস্ট জয়। বাংলাদেশের জন্য যা ইতিহাসে প্রথম।
মঙ্গলবার রাতের জ্যামাইকা চট করে মনে করিয়ে দিল নিউজিল্যান্ডের মাউন্ট মঙ্গানুইকে। জয়ের পাল্লায় সেই ম্যাচের সাফল্যও ওজনে এমন ভারি হবে। সেদিনও সাকিব-তামিম দলে ছিলেন না। যাদের না থাকায় বাংলাদেশ কি করে এগিয়ে যাবে তা নিয়ে মাথা ঘামতো সবার। উইন্ডিজেও সেদিনের মতো জয় চলে এসেছে। সেদিকেই মতোই একজন ৬ উইকেট নিলেন, একজন আশির ওপর রান করলেন।
সবচেয়ে বড় কথা দল হয়ে খেলেছে বাংলাদেশ। জাকের আলি চাইলে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সেঞ্চুরি পূর্ণ করতে পারতেন। কিন্তু দলের জন্য বড় শট নিতে গিয়ে সেঞ্চুরি বিসর্জন দিলেন। উইন্ডিজের প্রথম ইনিংসে নাহিদ রানার ওই স্পেলের পর বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের বদলে যাওয়া মানসিকতা। সাহসের সঙ্গে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করা। ছোট ছোট জুটিতে দলকে তিনশোর কাছে নিয়েও যাওয়া দলগত লড়াইয়ের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
অধিনায়ক মেহেদি হাসান মিরাজের কথা আলাদা করে বলতেই হবে। দ্বিতীয় ইনিংসে তার ৩৯ বলে ৪২ রানের ইনিংসে গুটিয়ে থাকার আড়মোড়া কাটিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। পাল্টা আক্রমণে দলের মধ্যে নিজের সাহসী মনোভাব ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। শেষ ইনিংসে বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং পরিবর্তনে উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙেছেন মিরাজ।
তাই তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদ, তাইজুল ইসলাম ও নাহিদ রানারা সময়ে সময়ে উইকেট দিতে পেরেছেন দলকে। তাইজুল পেয়েছেন তার ১৫তম ইনিংসে ৫ উইকেট। তার ৫০ রানে ৫ উইকেটের পাশাপাশি তাসকিন ও হাসান মাহমুদ দুটি করে উইকেট নিয়েছেন। একটি পেয়েছেন প্রথম ইনিংসের ৫ উইকেট শিকারী নাহিদ।
চা বিরতির আগে কাভেম হজের লড়াইয়ে আশায় বুক বেঁধেছিল ক্যারিবিয়ানরা। বিরতির পর তাকে ফিরিয়েই ধ্বসের শুরু করে বাংলাদেশ। ৫৫ রান করা হজকে এলবিডব্লিউ আউট করেন তাইজুল। তাসকিন কিছুটা লো হওয়া ডেলিভারিতে ২০ রান করা জাস্টিন গ্রিভসের উইকেট উপরে ফেলেন হজের বিদায়ের পাঁচ ওভারের মধ্যে।
ক্যারিবিয়ানদের শেষ দুই প্রতিষ্ঠিত ব্যাটারদের ফিরিয়ে জয় তখন সময়ের অপেক্ষায় নিয়ে আসেন বাংলাদেশ বোলাররা। বাকি সময়ে হাসান মাহমুদ আলজারি জোসেফ ও কেমার রোচকে। তাইজুল জশুয়া ডি সিলভাকে আর নাহিদ রানা শেষ ব্যাটার শামার জোসেফকে বোল্ড করে স্মরনীয় জয় নিশ্চিত করেন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস : ১৬৪/১০ ও ২য় ইনিংস : ২৬৮/১০ (জাকের ৯১, সাদমান ৪৬, মেহেদি ৪২; কেমার রোচ ৩/৩৬)। উইন্ডিজ ১ম ইনিংস : ১৪৬/১০ ও ২য় ইনিংস : ১৮৫ (কাভেম হজ ৫৫, ব্র্যাথওয়েট ৪৩, গ্রিভস ২০; তাইজুল ৫/৫০, তাসকিন ২/৪৫, হাসান ২/২০, নাহিদ ১/৩২)। ফল : বাংলাদেশ ১০১ রানে জয়ী। ম্যাচ সেরা : তাইজুল ইসলাম। সিরিজ সেরা : তাসকিন আহমেদ।
তাইজুল এগিয়ে দিলেন বাংলাদেশকে
দুই ওভারে দুই উইকেট তুলে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখলেন তাইজুল ইসলাম। উইন্ডিজের ইনিংসের ২৫ ও ২৭তম ওভারে ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট ও আলিক আথানেজকে ফেরালেন তিনি।
এরপর চা বিরতি পর্যন্ত আর উইকেট হারায়নি উইন্ডিজ। ৪ উইকেটেই ১৩৩ রান নিয়ে চতুর্থ দিন চা বিরতিতে যায় স্বাগতিকরা। ৬৩ বলে ৪৯ রান করে কাভেম হজ টানছেন দলকে। জয়ের জন্য ১৫৪ রান চাই উইন্ডিজের।
এর আগে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছিলেন ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট। উইন্ডিজ অধিনায়ক ৬৩ বলে করেছিলেন ৪৩ রান। তাকে স্লিপে ক্যাচ বানিয়ে ফেরালেন তাইজুল। পরের ওভারে আলিককে সরাসরি বোল্ড করলেন। তাইজুলকে ড্রাইভ করতে গিয়ে টার্ন মিস করে বোল্ড হন এই ব্যাটার।
জোড়া উইকেটে জয়ের পথে আরো একটু এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।
তাসকিন এনে দিলেন দ্বিতীয় উইকেট
লাঞ্চের পর ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন দুই উইন্ডিজ ব্যাটার। জুটি গড়ে তোলেন ৩৪ রানের। নাহিদ রানাকে আক্রমণে এনেও উইকেট নিতে পারছিল না বাংলাদেশ। তবে রান আটকে দিয়ে সাফল্য আসে।
নাহিদ আক্রমণে আসতেই বাউন্ডারীতে রান পাওয়া আটকে যায় উইন্ডিজের। সঙ্গে সিঙ্গেল নেওয়ায় কঠিন করে তোলেন নাহিদ। সুবাদে উইকেট পাওয়া সহজ হয়। তাসকিন অফস্ট্যাম্পের বাইরের চ্যানেলে বল করে সাফল্য পেলেন।
ইনিংসে প্রথম শিকার তার। ৫৭ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারাল ক্যারিবিয়ানরা। ৪৩ বলে ১৪ রান করে ফিরেছেন কেসি কার্টি। জয়ের জন্য আরও ২২৩ রান চাই স্বাগতিকদের। বাংলাদেশের আট উইকেট।
লাঞ্চের আগেই এক উইকেট নিল বাংলাদেশ
লাঞ্চের আগে ২০ মিনিট খেলা হওয়ার কথা ছিল। তাতে ৫ ওভারের মতো হতে পারে। এক ওভার বেশি করতে স্পিনার তাইজুল ইসলামকে আক্রমণে অনেন মেহেদি হাসান মিরাজ। এতে সময় কম ব্যয় হবে।
বাংলাদেশের সৌভাগ্য ওই ওভারেই উইকেট মিলল। তাইজুলের বলে ফ্রন্টফুট ডিফেন্স করতে গিয়ে ব্যাট প্যাড হয়ে ক্যাচ আউট হলেন মিকেল লুই। তার ব্যাটের ভেতরের কানায় বল লেগে জুতায় বাউন্স করে শূন্যে ভাসে। শর্ট লেগে দাঁড়ানো শাহাদাত হোসেন দিপু ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাচ নেন। বাংলাদেশ পেয়ে যায় প্রথম সাফল্য।
২৩ রানে উইন্ডিজের এ উইকেট পড়তেই চতুর্থ দিন লাঞ্চের ঘোষণা দেন আম্পায়াররা। উইকেটে অপরাজিত আছেন ১৪ বলে ১৬ রান করা ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট। জয়ের জন্য আরও ২৬৪ রান চাই উইন্ডিজের।
জাকেরের সেঞ্চুরির আক্ষেপে শেষ হলো বাংলাদেশের ইনিংস
অসাধারণ ইনিংস উপহার দিলেন জাকের আলি। এক প্রান্ত আগলে রেখে দলকে এনে দিলেন স্বস্তিদায়ক লিড। যে লিডে তাকিয়ে উইন্ডিজ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট জয়ের স্বপ্ন দেখবে বাংলাদেশ।
অথচ দ্বিতীয় ইনিংসে নিজের স্বপ্নটা পূরণ করতে পারলেন না জাকের। প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির খুব কাছে গিয়েও পারলেন না দাগ অতিক্রম করতে। তিন অঙ্ক থেকে ৯ রান দূরে জাকের থামলেন ৯১ রানে। আরেকটু সময় নিলে হয়তো সেঞ্চুরিটা পেয়েই যেতেন।
তবে দলের জন্য খেলেছেন বলেই শেষ উইকেটে নিজেরটা ভাবেননি। বড় শট নিতে গিয়ে ক্যাচ আউট হন মিডউইকেটে। সেঞ্চুরির আক্ষেপ নিয়ে মাঠ ছাড়লেও দল জিতলে তা আর থাকবে না জাকেরর। কারণ তার সেঞ্চুরিসম ৯১ রানে উইন্ডিজকে ২৮৭ রানের জয়ের লক্ষ্য দিতে পেরেছে বাংলাদেশ।
৯১ রানের ইনিংসে শেষদিকে শুধু ছক্কা ও চারে নির্ভর ছিলেন জাকের। হাসান মাহমুদ আউট হওয়ার পর তিন ছক্কা ও দুটি চারে ২৬ রান তোলে জাকের। এই সময় সিঙ্গেল নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি।
তাতে দ্রুত রান উঠেছে। উইন্ডিজকে বড় টার্গেট দেওয়া গেছে। জ্যামাইকাতে উইন্ডিজ সবশেষ জিতেছিল ২১২ রান তাড়া করে।
টানা তিন টেস্টে ফিফটি জাকেরের
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডারের নিচের দিকের রানের সমস্যা অনেক। একপ্রান্ত আগলে রেখে দলের রান বাড়ানোর মতো কেউ নেই যেন। সেই সমস্যা মিটিয়ে দিতে এসেছেন জাকের আলি। টানা তিন টেস্টে তিন ফিফটিতে নির্ভরযোগ্যতার নাম হয়ে উঠেছেন এই কিপার ব্যাটার।
তার ফিফটির সব ইনিংসেই লড়াইয়ের পুঁজি পয়েছে বাংলাদেশ। তবে জয়ের পথ পায়নি। এবার খুব সম্ভব তা হতে চলেছে। জাকেরের ফিফটিতে জ্যামাইকে টেস্টে উইন্ডিজকে কঠিন লক্ষ্য দিতে চলেছে বাংলাদেশ। চতুর্থ দিন পানি পানের বিরতি পর্যন্ত বাংলাদেশের রান ৭ উইকেটে ২৩৬। লিড দাঁড়িয়েছে ২৫৪ রান।
জাকের আলি অপরাজিত আছেন ৮৩ বলে ৬১ রানে। যা তার ক্যারিয়ার সেরা। আলজেরি জোসেফকে ছক্কা মেরে ফিফটিকে পৌঁছানো জাকের পরের দুই বলেও চার ও ছক্কা হাঁকিয়েছেন। তার সঙ্গে অপরাজিত আছেন ৩ রান করা হাসান মাহমুদ।
মুমিনুলের লজ্জার রেকর্ড
জাকেরর লড়াইয়ের আগে রেকর্ড বইয়ে নাম তুলেছেন মুমিনুল হক। এই টেস্টে দুই ইনিংসেই ০ রানে আউট হয়েছেন তিনি। যাকে বলা হয় পেয়ার (জোড়া)। এতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ১৮ বার ০-তে আউট হওয়ায় কীর্তি গড়লেন মুমিনুল।
দুইশো পার করে স্বপ্ন বড় করছে বাংলাদেশ
প্রথম ইনিংসের পর জ্যামাইকা টেস্টের ফল নিয়ে সবাই আগাম ভবিষ্যদ্বানি করেছেন। তাতে বাংলাদেশের আরেকটি টেস্ট হারের এপিটাফ নিশ্চিত ছিল। সবাইকে সোমবার রাতে ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছেন মেহেদি হাসান মিরাজরা।
সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশ এখন চালকের আসনে। শুধু তাই নয় ম্যাচ জয়ের পথে বিশাল এক পা ফেলেছেন মিরাজরা। ৫ উইকেটে ১৯৩ রানে তৃতীয় দিন শেষ করেছিল বাংলাদেশ। চতুর্থ দিন শুরুতে দুইশো পার করে এগিয়ে চলা ধরে রেখেছে সফরকারীরা।
জাকের আলির চারে দুইশো ছুঁয়েছে বাংলাদেশের স্কোর। ৫ উইকেটে ২০৩ রান এখন। লিড ২২১ রানের। জাকের ৬১ বলে ৩৫ ও তাইজুল ৩৭ বলে ১২ রানে ব্যাট করছেন। জ্যামাইকায় এখনও পর্যন্ত ২১২ রান তাড়া করে টেস্ট জয়ের রেকর্ড আছে। বাংলাদেশের লিড ইতিমধ্যে ওই রান ছাড়িয়েছে।