Beta
বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

অপ্রচলিত রুটে কেন গেল ‘এমভি আবদুল্লাহ’

আবদুল্লাহ
এই ছোট জলযানটিতে চেপেই এমভি আবদুল্লাহয় এসেছিল সোমালি জলদস্যুরা
[publishpress_authors_box]

বাংলাদেশি মালিকানাধীন ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজটি মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়া বন্দরে যাচ্ছিল। যাত্রাপথটি এমন যে জাহাজটিকে অবশ্যই ভারত মহাসাগরের সোমালিয়া উপকূল দিয়ে চলতে হবে; যেটি আর্ন্তজাতিক স্বীকৃত একটি রুট। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে জাহাজটি সোমালিয়া উপকূল থেকে অনেক দূর দিয়ে যাচ্ছিল।

যে পথে জাহাজটি চলছি তা প্রথমত, আর্ন্তজাতিক স্বীকৃত রুট হিসেবে প্রচলিত নয়; দ্বিতীয়ত, এই রুটে সোমালিয়ার জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার বড় ঝুঁকি ছিল; তৃতীয়ত, জাহাজটিতে ভাড়া করা কোনও আর্মড ফোর্স ছিল না। এসব জানার পরও কেন জাহাজটি সেই অপ্রচলিত রুট দিয়ে যাত্রা করল এবং দস্যুদের কবলে পড়ল— এটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে দেশের মেরিটাইম সেক্টরে।

মেরিটাইম সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই কারণে অপ্রচলিত রুট ব্যবহার করেছে জাহাজটি। একটি হচ্ছে, আর্মড ফোর্স বাবদ খরচ বাঁচানো। আরেকটি কারণ হলো, জাহাজ মালিক এবং পণ্য পরিবহনকারী কোম্পানির অসতর্কতা।

সোমালিয়া উপকূল দিয়ে গতমাসে একটি বিদেশি কোম্পানির কার্গো জাহাজ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশি এক নাবিক। জাহাজটি চীন থেকে তুরস্ক যাচ্ছিল।

ওই নাবিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আর্ন্তজাতিক স্বীকৃত রুট দিয়ে যাওয়ার আগে আমরা তিনজন আর্মড ফোর্স নিয়েছিলাম শ্রীলংকান উপকূল থেকে। সোমালিয়া উপকূল পাড়ি দেওয়ার পর তারা গালফ অব এডেন পার হয়ে রেড সি-তে গিয়ে নির্ধারিত পয়েন্টে নেমে যায়। এজন্য অবশ্য আগে থেকেই জাহাজ কোম্পানি নির্দিষ্ট সিকিউরিটি কোম্পানিকে বুকিং দিয়েছিল। সেই অনুযায়ী আমাদের ভাড়া দিতে হয়েছিল।”

তিনি বলেন, “আমরা জানি, গত কয়েকমাস ধরে এই রুট দিয়ে চলতে গিয়ে বেশ কিছু জাহাজ দস্যুতার কবলে পড়েছে। ফলে আমার জাহাজ কোম্পানি সেই ঝুঁকি নিতে চায়নি বলেই আমরা ফোর্স নিয়েছি। এখন আবদুল্লাহ জাহাজের মালিক এসআর শিপিং সেই ফোর্স নেয়নি কেন, আমি জানি না। জাহাজ কোম্পানিই ভালো জানবে।”

সোমালিয়ার দস্যুদের ঠেকাতে ভারত মহাসাগর এবং হর্ন অব আফ্রিকা উপকূলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশেষায়িত সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে ‘অপারেশন আটলান্টা’ নামে নজরদারি কার্যক্রম করে। ফলে বেশ কবছর ধরেই সেই রুটে দস্যুতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সোমালিয়ার দস্যুরা। একটি বড় কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমুদ্রপথে নিরাপত্তা দেওয়া আর্ন্তজাতিক বাহিনীগুলোর এখন মূল দৃষ্টি পাশে থাকা লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহীদের ঠেকানো। সব আর্ন্তজাতিক বাহিনী সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার কারণেই এই অঞ্চলে জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আর সেই সুযোগটিই নিয়েছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা।

মেরিটাইম সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোমালিয়ার উপকূলে আর্ন্তজাতিক স্বীকৃত রুট দিয়ে চলতে গেলে সিকিউরিটি নিতেই হবে। আর সেই রুটে দিনে-রাতে প্রচুর জাহাজ চলাচল করে। সাগরের সেই রুটে বাই রোটেশনে টহল থাকে নির্দিষ্ট বাহিনীর। ফলে সোমালিয়ার দস্যুদের পক্ষে এতবড় জাহাজ ছিনতাই করা সহজ হতো না। কিন্তু সেই পথ এড়িয়ে অন্য রুট দিয়ে যেতেই বিপদে পড়ে ‘এমভি আবদুল্লাহ’।

জানতে চাইলে মাস্টার মেরিনার ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আর্ন্তজাতিক স্বীকৃত যে রুট ছিল সেটি হাই রিস্ক ছিল। কিন্তু সেই রুটে আবার বিদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ টহল ছিল। আবদুল্লাহ জাহাজটি যে রুট দিয়ে গেল সেটি আসলে স্বীকৃত রুটের বাইরে ঘুরপথে।

“তারা হয়ত ভেবেছিল, এই রুট দিয়ে গেলে দস্যুতা এড়ানো যাবে। কিন্তু তারাই শিকারে পরিণত হলো। এর প্রধান কারণ আবদুল্লাহ জাহাজটিতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। আর জাহাজটি ধীরগতিতে চলছিল। ফলে খুব সহজেই দস্যুদের শিকারে পরিণত হয় আবদুল্লাহ জাহাজ।”

জাহাজটি বাংলাদেশের এসআর শিপিং কোম্পানির হলেও সেটি ভাড়ায় চলছিল। অর্থ্যাৎ একটি ট্রাক যেমন অন্য কোম্পানির পণ্য পরিবহনের জন্য ভাড়ায় নেওয়া হয় ঠিক তার মতো। দুবাইভিত্তিক একটি কোম্পানির পণ্য পরিবহন কাজে নিয়োজিত ছিল জাহাজটি। ফলে আর্ন্তজাতিক স্বীকৃত রুট দিয়ে চলতে গেলে বাড়তি যে খরচ হবে সেটি কে বহন করবে তা জাহাজ কোম্পানি এবং পণ্য পরিবহন কোম্পানির চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত। এখন আর্মড ফোর্স নেওয়ার শর্ত সেই দুই কোম্পানির চুক্তিতে ছিল না কিনা সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

জানতে চাইলে এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এগুলো আসলে আমরা পরে ভাবব। এখন নাবিক উদ্ধার করাই আমাদের প্রধান ফোকাস।”

এবিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির অন্য কোনও কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আর্মড ফোর্স নিতে খরচ কত

সোমালিয়া সাগর পথের হাই রিস্ক বা অতি ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিতে নির্ধারিত এবং আর্ন্তজাতিক স্বীকৃত কোম্পানি আর্মড ফোর্স সরবরাহ দিয়ে থাকে। এসব ফোর্স বিশ্বস্ত এবং বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত।

জানতে চাইলে ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, “এই পথ পাড়ি দিতে যে যার সুবিধামতো বন্দর থেকে আর্মড গার্ড নেয়। হাই রিস্ক এলাকা পার হওয়ার পর পরবর্তী বন্দরে তাদের নামিয়ে দেয়। প্রতিটি জাহাজকে কমপক্ষে তিনজন আর্মড গার্ড নিতে হয়। আর প্রতিজনের জন্য ব্যয় করতে হয় ১০ হাজার মার্কিন ডলার। তিনজন নিলে ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। এখন সেই খরচ বাঁচানোর জন্য তারা অন্য পথ ব্যবহার করেছেন কিনা তা জাহাজ কোম্পানিই ভালো জানবে।”

“তবে এই ফোর্স না নেওয়ার জন্যই জাহাজটি ঝুঁকিতে পড়ল সন্দেহ নেই। একইসাথে আবদুল্লাহ জাহাজের চারিদিকে কোনও ফেন্সিং বা রেজার না থাকায় দস্যুতার কবলে পড়ার সুযোগ তৈরি হয়,” বলেন তিনি।

অপ্রচলিত রুটে যাওয়ার তথ্য দস্যুরা পেল কীভাবে

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করার মতো। সোমালিয়ার দস্যুরা সাধারণত ছিনতাই করে উপকূলের কাছাকাছি থাকা জাহাজগুলোকে। ফিশিং বোটে করে গিয়েই তারা ছিনতাই করে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছোট ফিশিং বোটে উপকূল থেকে সাড়ে ৬শ’ নটিক্যাল মাইল দূরে যাওয়া সম্ভব না। এ ধরনের বোটে বড়জোর ১শ’ নটিক্যাল মাইল দূরে যাওয়া যেতে পারে।

‘এমভি আবদুল্লাহ’ ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রে জলদস্যুরা যে কৌশলটি নিয়েছে তা হচ্ছে, আগে থেকেই একটি ইরানি বড় ফিশিং বোট তারা ছিনতাই করে রাখে। সেই বোটের পাশে নিজেদের ছোট ছোট ফিশিং বোট বেঁধে তারা অপেক্ষায় থাকে। এরপর সেই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে দস্যুদের কবলে পড়ে ‘এমভি আবদুল্লাহ’।

এ বিষয়ে এক মেরিনার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আবদুল্লাহ জাহাজের আর্মড ফোর্স না নেওয়া, জাহাজটির ধীরগতি এবং জাহাজের চারিদিকে ফেন্সিংসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা তাদেরকে দস্যুদের শিকারে পরিণত করে।“

তিনি বলেন, “এখানে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এই জাহাজটি অপ্রচলিত রুট দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিল এবং মোজাম্বিক থেকে রওনা দেওয়ার পর সেই তথ্য সোমালিয়ার দস্যুদের কাছে কীভাবে গেল?”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত