বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অনেক উদ্বেগের মধ্যে প্রধান, যা দমাতে নীতি সুদহার বাড়ানোসহ ব্যাংক ঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে রাখা হয়েছে। বাড়তে থাকা সুদহার ৯ থেকে এখন ১৫ শতাংশে উঠেছে, তবু তার সুফল ঘরে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। কমেনি মূল্যস্ফীতি; সামনে রয়েছে আরও বাড়ার আভাস।
ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তাদের সেপ্টেম্বর সংস্করণের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) প্রতিবেদনে আভাস দিয়েছে, জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাম্প্রতিক বন্যার কারণে চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসবে। সেইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে, তা ১০ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হবে। এর মানে, এ বছরও দেশের সাধারণ মানুষকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৯ মে ঋণের সুদহার ‘বাজারভিত্তিক’ করে দেয়; এর পর নিজেদের সুবিধামতো সুদহার নির্ধারণের অধিকার ফিরে পায় ব্যাংকগুলো। ফলে সব ধরনের ঋণের ওপর সুদের হার বেড়ে গেছে।
সুদহার বাড়ায় ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে আগ্রহ দেখালেও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিঘ্ন ঘটায়, সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে। এতে ব্যাংক ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউসহ রাজনৈতিক পরিস্থিতি করে অস্থির হয়ে ওঠায় চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। তবে মাঝের তিন দিন কোনও সরকার না থাকা এবং সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়, যা এখনও ঠিক হয়ে ওঠেনি।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দীর্ঘ বঞ্চনা ও দাবি-দাওয়া নিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করে চলেছেন; দেশের কিছু অঞ্চলে সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে, যা দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও আগের মতো কঠোর হচ্ছে না।
রাষ্ট্রক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীও তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছিলেন।
তিন মাস ধরে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম অনেকটাই বিঘ্নিত। তার সঙ্গে সাম্প্রতিক বন্যার প্রভাবেও দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত। এই দুই কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গতি কমবে বলে মনে করছে এডিবি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে মাঠে থাকা সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর পোশাকশিল্পের অস্থিরতা নিরসনেও শ্রমিক-মালিক-সরকার পক্ষের মতৈক্য হয়েছে বলে ঘোষণা এসেছে।
গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের একটি বড় নেটওয়ার্ক দেশে গড়ে উঠেছিল। তাদের অনেকেই এখনও পালিয়ে আছেন, বা বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এছাড়া বিগত সরকারের সময় ব্যাংক খাত থেকেও বড় অঙ্কের টাকা ঋণের নামে বের করে নিয়েছে অনেক ব্যবসায়ী। সরকার পতনের পর এসব ব্যাংকের তারল্য ঘাটতির চিত্র প্রকাশ পায়। ফলে আমানত তোলার হিড়িক পড়ে সেসব ব্যাংকে।
বিভিন্ন অনিশ্চয়তার কারণে দেশের সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত তিন মাসে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের দেখা যাচ্ছে ধীর গতি।
অর্থনীতির বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, বন্যায় কৃষির বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কা না থাকলেও বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পোশাক খাতের পণ্য রপ্তানিতে দেরি হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা বিকল্প গন্তব্যের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করেছেন; সম্প্রতি বেক্সিমকো গ্রুপের এক চিঠিতেও এ ধরনের কথা তুলে ধরা হয়।
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিপন্থী অনেক ব্যবসায়ী আবার ব্যবসায় মনোযোগ দিতে শুরু করেছেন। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আওয়াল মিন্টু সম্প্রতি তার পুরোনো ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংকে চেয়ারম্যান হয়ে ফিরেছেন। তার ছেলে তাবিথ আওয়ালও ফিরেছেন ক্রিড়াঙ্গনের বিনিয়োগে।
দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নেতৃত্ব পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এতে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। ফলে এই সংগঠন এখন কিছুটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
তাদের অনেকেই এখন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কথা বলতে অনিহা প্রকাশ করছেন। কেউ কেউ বলেছেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে ঋণের সুদ বাড়ানোর কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। উৎপাদন ব্যাহত হলে মূল্যস্ফীতি আবারও ঊর্ধ্বমুখী হবে।
তবে গত ২৩ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর বলেছিলেন, “আমি আশাবাদী, মূল্যস্ফীতি মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে একটি ভালো জায়গায় চলে আসবে। কতখানি ভালো জায়গায় আসবে, সেটা হয়ত বলা যাবে না। তবে আমরা পলিসি টাইট করব, যাতে মূল্যস্ফীতি কমে আসে।
“আমাদের এখন বিনিময় হার স্থিতিশীল আছে। এছাড়া রেমিটেন্সও বাড়ছে। আশা করি, আগামীতেও বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকবে। যদি এটা ধরে রাখা যায় তাহলে মূল্যস্ফীতি অবশ্যেই কমে আসবে।”
“তাছাড়া আমাদের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণের যে লক্ষ্য রাখা হয়েছে, তা ৫০ হাজার কোটি টাকা কমানো হতে পারে। এটা হলে বেসরকারি বিনিয়োগও ঠিক হয়ে আসবে। সবমিলিয়ে আমরা যদি মূল্যস্ফীতি ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারি তাহলে সুদের হার আমরা কমিয়ে আনতে পারব। সে জন্য সময় দিতে হবে।”
ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ
মেট্রোপলিটিন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন ব্যাংকে যেসব সমস্যা হচ্ছে সেগুলো আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখছি। বলা হলো, অনেক ব্যাংক ক্লিনিকালি ডেড। সব ব্যাংক যে এরকম তা না। তবে অনেক ব্যাংকের অবস্থা খুব খারাপ। সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর বিরাট একটি ধাক্কা গেছে, যাচ্ছে।
“প্রস্তুতকারক খাত বিশেষ করে পোশাক খাতে কিছুদিন কী হয়েছে… সম্প্রতি একটি সমঝোতা হয়েছে। আশা করছি, এতে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হবে।”
রপ্তানি খাতের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে উল্লেখ করে কামরান টি রহমান বলেন, “রপ্তানি যদি না হয় বিদেশি মুদ্রার আহরণ বিশাল একটি ধাক্কা খাবে। ঋণের উচ্চ সুদ প্রস্তুতকারক খাতসহ সব ধরনের উৎপাদন খাতকেই একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে।
“সুদ যদি আরও বাড়ে তাহলে পরিস্থিতি আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। এটাও ঠিক যে, মূল্যস্ফীতির হার এত বেশি থাকলে ঋণের সুদহার তো বাড়াতেই হবে। তাই বলে কেবল ঋণের সুদহার বাড়িয়েই মূল্যস্ফীতি কমাবে এমন কোনও কথা নাই।”
“বাংলাদেশ ব্যাংক দেখছে কীভাবে এটা করা যায়। তাদের হাতে যতগুলো হাতিয়ার আছে তার মধ্যে মুদ্রানীতি একটি। আমরা জানি না কত দিনে মূল্যস্ফীতি কমবে, ঋণের সুদহার কমবে। ঋণের সুদ না কমলে ব্যবসার খুবই অসুবিধা হবে। হচ্ছে ইতোমধ্যে, উচ্চ সুদের কারণে।”
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মাসে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে রেকর্ড হয়। গত জুলাইয়ে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ শতাংশের বেশি, যা ২০১০-১১ অর্থবছরের পর সর্বোচ্চ। পরের মাস আগস্টেও পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে।
এই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই নিয়ে দুই দফা রেপো বা নীতি সুদহার বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবশেষ গত বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) থেকে নীতি সুদহার বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ঋণের সুদহারও বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
এদিকে ৯টির মতো ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়ায় সেগুলো মার্জ বা একীভূত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
এগুলোসহ আরও কিছু ব্যাংক এখন পর্যাপ্ত ঋণ বিতরণ করতে পারছে না।
এতে চাহিদা মতো ঋণ না পাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন পূবালী জুট মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরান টি রহমান।
সফটওয়্যার শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অন্যান্য অনেক খাতের থেকে আইসিটি খাতের ব্যবসার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, এই নতুন সরকারের যে প্রতিশ্রুতি সবকিছুতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে গেলে আইসিটির ব্যবহার সবচেয়ে ফলপ্রসু হতে পারে।
“তবে এখন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও আছে এই খাতের ব্যবসায়। অনেক ছোট প্রতিষ্ঠানের ক্রেতা কমেছে। বড় প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আসছে না। এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের বের হতে হবে। তাহলেই ব্যবসা ভালো হবে।”
তিনি বলেন, “ব্যাংকের অবস্থা তো আমরা সবাই জানি। সম্প্রতি আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে কিছু বিষয় তাকে অবগত করেছি। কিছু সুবিধা চেয়েছি, যা পেলে দেশের সফটওয়্যারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।”
তবে কী কী সুবিধা চাওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে এখনই তিনি গণমাধ্যমকে কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি আশা করছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে কিছু উদ্যোগ অবশ্যই নেবে।
ই-কমার্স খাতের সংগঠনও এখন অকার্যকর। সম্প্রতি এই সংগঠনটিতে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেলের উপসচিব মুহাম্মদ সাঈদ আলী।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ই-কমার্স খাতে কিছু অসুবিধা ছিল। সেগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সমাধান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখন আমার বড় দায়িত্ব ই-ক্যাবের নির্বাচনটা করে দেওয়া। এরপর হয়তো এখাতে আবার চাঞ্চল্য ফিরবে।”
ঋণ বিতরণে ধীর গতি
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর একে একে পরিবর্তন হতে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, বিএসইসির চেয়ারম্যানসহ আর্থিক খাতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের পদ। ফলে প্রথম দিকে কিছুটা থমকে যায় এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম।
তারপরও শুরু থেকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে আনতে চেষ্টা করে। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ কমে এসেছে। তাছাড় কিছু ব্যাংকে আমানত তোলারও চাপ তৈরি হয়েছে। ফলে ওই ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে মনোযোগ দিতে পারছে না।
গভর্নর আহসান এইচ মনুসর সম্প্রতি বলেছেন, “প্রকৃতপক্ষে ৯-১০ ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে বসে আছে।” এ ধরনের ৯টি ব্যাংকে তার অডিট করে সেগুলো একীভূত করবেন বলেও পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
তবে সব মিলিয়ে ঋণের উচ্চ সুদ ও তারল্যের চাপ থাকায় দেশের সাধারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ঋণ নেওয়ার জন্য ব্যাংকমুখী হচ্ছে না।
ফলে এই বছরের শেষ ছয় মাসে ব্যাংকের ব্যবসায় তেমন অগ্রগিতর আশা করছেন না ব্যাংক কর্মকর্তারা।
এসব বিষয়ে নিয়ে সম্প্রতি সকাল সন্ধ্যা দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী থেকে শুরু করে শাখা ব্যবস্থাপকসহ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করে। তাদের বক্তব্যে উঠে আসে ঋণ বিতরণে ধীর গতির তথ্য।
তারা বলছেন, জুলাই ও আগস্ট মাসে ঋণ বিতরণ একেবারেই ছিল না বললে চলে। সেপ্টেম্বরে কিছু কিছু ঋণ বিতরণ শুরু হয়েছে। তবে তা অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি আগের মাস জুনের স্থিতির তুলনায় শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ কমে যায়। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে ঋণাত্নক প্রবৃদ্ধি হয়।
এই তথ্য ইঙ্গিত করছে, জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমায় দেশে বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়ও স্থবিরতা নেমেছিল।
ব্যবসয়ীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর তাগিদ
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) পরিচালক শাহ মো. আহসান হাবীব সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখনও ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা স্থবিরতা রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের গতি মন্থর। এ জন্য ব্যবসায়ীদের কনফিডেন্স বাড়াতে হবে ও বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
“ব্যবসায়ীরা অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যে ধরনের পরিবেশ দরকার ও আস্থা দরকার, তা ফিরে আসতে কিছুটা সময় লাগবে।”
“তাছাড়া গার্মেন্ট সেক্টরে শ্রমিকদের আন্দোলন ও ডাকাতির ভয়ে বেশ কিছু দিন পোশাক কারখানাগুলো পুরোপুরিভাবে চালু করতে পারছিলেন না মালিকরা। গত ২৪ সেপ্টেম্বর পোশাক খাতের মালিকরা শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস বৃদ্ধিসহ ১৮ দফা দাবি পূরণের ঘোষণা দেওয়ায় এ খাতের পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।”
বিআইবিএমের এই অধ্যাপক বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন দাবি-দাওয়ায় সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করায় যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনেও বিঘ্ন ঘটে। এ নিয়ে একাধীকবার ড. ইউনূস আহ্বান জানানোর পর সড়ক অবরোধ কিছুটা কমে এসেছে। তারপরও সম্প্রতি অডিটররা সড়ক অবরোধ করে বসেন।”
ব্যাংক খাতের সুদহার ১৫% ছাড়িছে
ঋণের সুদহার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ায় গত মে মাস থেকে ব্যাংকগুলোই হার নির্ধারণ করছে। এতে ঋণের সুদহার বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে ওঠায় জুলাইয়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে, পরবর্তী সময়েও খুব উন্নতি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণের স্থিতির পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৪১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এরপর চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এই ঋণ স্থিতি কমে ১৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৫ কোটি টাকায় নেমে আসে।
তবে কেবল জুলাই মাসই নয়, আগস্ট মাসেও ঋণ বিতরণে বড় ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছিল বলে জানিয়েছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “জুলাই-আগস্ট দুই মাসে স্থবিরতা ছিল। এখনও সেই স্থবিরতা কাটেনি। গার্মেন্ট আমাদের বড় ক্লায়েন্ট। সেখানে শিপমেন্ট বন্ধ ছিল, পণ্য পাঠাতে দেরি হয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের এ খাতে ঋণ বিতরণ কমে এসেছে। তাছাড়া উৎপাদন খাতেও বিনিয়োগ আসছে না। সবাই অপেক্ষা করছে পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হওয়ার।”
কিন্তু এভাবে ঋণ বিতরণ কমে গেলে ব্যাংকগুলো কত দিন চলতে পারবে—তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন ঢাকা ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব পালন করে আসা এই শীর্ষ নির্বাহী।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “তিন মাস হতে যাচ্ছে। এভাবে চললে আমাদের ভালো ব্যাংকও ভালো থাকবে না। দেখা যাক। কী হয়। এখন সেনাবাহিনী যেহেতু দুই মাস ম্যাজিস্ট্রেসি দায়িত্ব পেয়েছে, এই সময় গেলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হবে। তবে এটা ঠিক, এই বছরের প্রথম ছয় মাসে আমাদের ব্যবসা যা হয়েছে তার থেকে বেশি এ বছর আর হবে না।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে বেসরকারি ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি ছিল ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। আগের মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে আগ্রহ দেখালেও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কারণে সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে।
গত ৯ মে সুদহার নির্ধারণের সব ধরনের কলাকৌশল তুলে দিয়ে তা ‘বাজারভিত্তিক’ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে নিজেদের সুবিধামতো সুদহার নির্ধারণের অধিকার ফিরে পায় ব্যাংকগুলো। ফলে সব ধরনের ঋণের ওপর সুদের হার বেড়ে গেছে।
ঋণের সুদহার ‘সম্পূর্ণরূপে বাজারভিত্তিক’ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার নির্ধারণের সর্বশেষ পদ্ধতি স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) বিলুপ্ত করে। ৯ মাস চালু ছিল স্মার্টভিত্তিক সুদ নির্ধারণ।
২০২০ সালের এপ্রিলের আগে ব্যাংকঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক ছিল। তবে এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এই হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বেঁধে দিয়েছিল। ওই বছরের এপ্রিল থেকে সরকার ঋণ ও আমানতে নয়-ছয় হারের সীমা দিয়ে দেয়।
সুদের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়ায় ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে আগ্রহ দেখালেও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কারণে সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে।