খেলাপি ঋণ আদায়ে কিছুদিন ধরেই গ্রহীতার বাড়ি কিংবা অফিসে গিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে ব্যাংক কর্মকর্তারা। সরকারি-বেসরকারি উভয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা তা করছে। তারা ঋণ খেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কটের আহ্বান জানিয়ে মাইকে বক্তব্য দিচ্ছে; টাঙিয়ে দিচ্ছে ব্যানার।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই খেলাপি ঋণে জর্জরিত। গত জুন শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা; যা ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলার মাধ্যমে সম্পত্তি নিলাম, ক্রোক বা বাজেয়াপ্ত করার সুযোগ রয়েছে, কিন্তু তাতেও ফল আসেনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলাপি ঋণ আদায়ে এমন অভিনব কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে।
এদিকে ব্যাংকের এই কৌশলের সমালোচনা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মধ্যে ক্ষোভও দেখা যাচ্ছে।
তারা বলছেন, আর কয়েক মাস পরই রোজা। ভোগ্যপণ্য আমদানি-সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখাটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই সময়ে ব্যবসায়ীদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেললে তার প্রভাব পণ্য আমদানিতেও পড়বে।
এদিকে ব্যাংক কর্মকর্তারা অবশ্য এই কর্মসূচির পক্ষে বেশ জোরাল মত দিচ্ছেন। এক মাসে ঋণ আদায়ে সুফল পাওয়ার কথাও বলছেন তারা।
কিন্তু এই কর্মসূচির মাধ্যমে কী আসলেই খেলাপি ঋণ আদায় সম্ভব হচ্ছে বা ঋণ আদায়ে গতি বাড়ছে? কিংবা ব্যবসায়ীরা চাপে পড়ে কি ঋণ পরিশোধ করছেন?
কী কর্মসূচি চলছে
বকেয়া ঋণ আদায়ে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় নাসা গ্রুপের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখার কর্মীরা।
নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার আওয়ামী লীগ আমলের পুরোটা সময় ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে আছেন তিনি।
কর্মসূচিতে থাকা ব্যাংককর্মীরা বলেন, নাসা গ্রুপের কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখায় ১ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা বকেয়া ঋণ রয়েছে। তারা ঋণ পরিশোধ করছে না। ঠিকমতো ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংক চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
একইদিন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে দুটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এদের একটি হচ্ছে বিএসএম গ্রুপ; যারা ৩৫ বছর ধরেই বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্য ব্যবসা করছেন। আরেকটি হচ্ছে, চট্টগ্রামভিত্তিক সাদ মুসা গ্রুপ। সাদ–মুসা গ্রুপের কাছে ব্যাংকের ১ হাজার ১৮০ কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে বলছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
নগরীর কুলগাঁও এলাকায় সাদ-মুসা গ্রুপের বাণিজ্যিক কার্যালয়ে ব্যানার নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ন্যাশনাল ব্যাংক। এর আগে গত সপ্তাহে চট্টগ্রামের দৈনিক সাঙ্গুর কার্যালের সামনেও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ন্যাশনাল ব্যাংক। সেই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১৬ কোটি টাকা পাবে ন্যাশনাল ব্যাংক।
গত সপ্তাহে চট্টগ্রামভিত্তিক নুরজাহান গ্রুপের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তারা। আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানটি ঋণ খেলাপির তালিকায় আছে। তাদের সম্পদ নিলামে তোলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-মালিক সবাই পলাতক অন্তত আট বছর ধরে।
নুরজাহান গ্রুপের মালিক জহির আহমদ রতনকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। জামিনে ছাড়া পেয়ে তিনি বিদেশে চলে যান।
সিলেটে মাকসুদ আহমদ চোধুরী নামের এক ব্যবসায়ীর বাড়ির সামনে গিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন এক্সিম ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এক্সিম ব্যাংক সিলেটের জিন্দাবাজার শাখা থেকে ২০০৯ সালে ১৯ কোটি ঋণ নেন মাকসুদ। গত ১৬ বছরে একটি টাকাও ফেরত দেননি। পলাতক আছেন বেশ কবছর ধরেই।
কেন এই কর্মসূচি
ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, গ্রাহকদের লেনদেন স্বাভাবিক করতে ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই তারা এই কর্মসূচিতে নেমেছেন। গত সেপ্টেম্বর থেকে ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে এমন সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলে অন্তত ৮০০ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখার সিনিয়র অ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট দেওয়ান রেজা আলী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কিছু ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতার কারণে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, ব্যাংক টিকিয়ে রাখা অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রাহক, ঋণপত্রের বিপরীতে সকল পেমেন্ট সঠিক সময়ে পরিশোধের জন্য ব্যাংকাররা সবাই রাস্তায় নেমে গেছি।”
চলমান উদ্যোগে ফল পাওয়ার দাবি করে তিনি বলেন, “এভাবে ক্রমান্বয়ে যাদের ঋণ বকেয়া রয়েছে, তাদের অফিস-কারখানার সামনে অবস্থান কর্মসূচি চলতে থাকবে।
“সারা বাংলাদেশে যেসব ঋণ খেলাপি রয়েছেন, তাদের জন্য এটি সতর্ক বার্তা। ব্যাংকের ওপর যেন গ্রাহকরা আস্থা না হারায়, সেজন্য ঋণ আদায়ে এমন অবস্থান কর্মসূচি চলতে থাকবে “
সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার আগে ঋণ পরিশোধ করতে গ্রহীতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
গ্রহীতারা দেখছে কোন চোখে
এভাবে বাড়ি-অফিসের সামনে ব্যাংক কর্মকর্তাদের অবস্থানে ক্ষোভ জানাচ্ছেন ঋণ গ্রহীতারা।
বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি তো দেশ ছেড়ে পালাইনি। বিদেশে পাচার করিনি কোনও অর্থ। দেশেই থেকেছি, দেশেই আছি। তাহলে কেন আমাকে হেয় করা হলো?
“এটা যদি এমন হতো যে আমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আছে। আবার আমার বিরুদ্ধে ঋণ খেলাপির কারণে সম্পদ ক্রোক করা হয়েছে। আবার বছরের পর ঋণ রেখে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি, বিষয়টি তো এমন না। তাহলে কেন এই অপমান?”
ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে ৩০ বছরের লেনদেনের সম্পর্কের কথা জানিয়ে বশর চৌধুরী বলেন, “ব্যবসা করতে গেলে লাভ-লস দুটোই হবে। আমি কেন, কীভাবে লস দিয়েছি, সেটি জানা দরকার। ২০২৪ সালেই আমি সেই ব্যাংকে ২০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছি। অথচ আমাকে বেইজ্জত করা হলো! সেই অধিকার তাদের কে দিয়েছে “
বিএসএম গ্রুপের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আহমদ উল্লাহ সকাল সন্ধ্যাকে জানান, তাদের গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ৫৭৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পণ্য আমদানি করেছিল। এর মধ্যে সুদসহ মোট ৪৫৩ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এখন ন্যাশনাল ব্যাংক ৩৯৮ কোটি টাকা পাবে, যার মধ্যে ২৮৬ কোটি টাকা সুদ।
তিনি আরও বলেন, “গত বছর রোজার আগে ন্যাশনাল ব্যাংকের অর্থায়নে অস্ট্রেলিয়া থেকে ২০ হাজার টন ছোলার ঋণপত্র খোলা হয়েছিল। তবে ব্যাংকটি বিদেশি সরবরাহকারীকে ডলার পরিশোধ করতে না পারায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছোলাবাহী জাহাজ ফেরত চলে যায়। এতে আমাদের গ্রুপের কাছে এক মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকটির কারণে সেই ক্ষতির দায় পড়েছে আমাদের প্রতিষ্ঠানের ওপর।”
সাদ–মুসা গ্রুপের কাছে ১ হাজার ১৮০ কোটি টাকার বেশি পাওনার কথা বলছেন ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এবিষয়ে সাদ মুসা গ্রুপের কর্মকর্তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
খাতুনগঞ্জভিত্তিক ভোগ্যপণ্যের বড় ব্যবসায়ী জামান অ্যান্ড ব্রাদার্সের কর্ণধার নুরুল আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার ১৮ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে ১৪ কোটি টাকা আমি পরিশােধ করেছি। বাকি টাকা পরিশোধের প্রক্রিয়ায় আছে, সেটি নিয়ে মামলা চলমান আছে।
“কিন্তু সোনালী ব্যাংক লালদীঘি শাখা কর্তৃপক্ষ ৭/৮জন নিয়ে প্রথমে আমার বাসায় মাইক-ব্যানার নিয়ে সমাবেশ করেছে। আবার খাতুনগঞ্জে সেই কর্মকর্তারা আমার অফিসে সামনে ডোল বাজিয়ে কর্মসূচি করেছে। এভাবে হেয় করার বিষয়টি আমি আদালতে শুনানির সময় জানালে আদালত তখন তাদের শাসায় এবং আদালতের অনুমতি ছাড়া এমন কর্মসূচি পালন না করার জন্য নির্দেশনা দেয়।”
ব্যবসায়ীরা কী বলছে
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বড় ঋণ খেলাপিদের কাছেই ব্যাংকের অনেক টাকা বকেয়া। এই কৌশলে সেই অর্থ অর্থ তো আদায় হবেই না, বরং অন্যদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়াবে।
জামান অ্যান্ড ব্রাদার্সের কর্ণধার নুরুল আলম বলেন, “ঋণ আদায়ে এমন কর্মসূচিতে কখনোই সুফল মিলবে না। এর ফলে অন্য ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হবেন, ক্ষুব্ধ হবেন। দেশে এখন পণ্য আমদানিতে যে নিম্নমুখী প্রবণতা চলছে, সেটি আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। এখন তো ঋণ পরিশোধ না করে একদল ব্যবসায়ী বিদেশ পালিয়েছেন, অন্যরাও বিদেশে পালাতে উৎসাহিত হবে।”
চট্টগ্রামের শীর্ষ শিল্পগ্রুপের এক পরিচালক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ব্যাংকগুলো এসব করছে মুলত নতুন ম্যানেজমেন্ট এসে কিছু একটা করেছে, সেটি দেখানোর জন্য। এটি ‘শো আপ’ ছাড়া আর কিছুই নয়। যাকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়ে ঋণ পরিশোধে আনা যাচ্ছে না, তাকে আপনি সামাজিক প্রতিবাদে আনবেন, সেটা কীভাবে মনে করেন?
“এগুলো করে বরঞ্চ সেই ব্যবসায়ীর সাথে তিক্ততা বাড়ানো হচ্ছে। এখন সেই ব্যবসায়ী যদি বিষয়টিকে ঋণ না দেওয়ার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন, তাহলে মামলা চলতে থাকবে। আর বছরের পর বছর ঋণ অনাদায়ি থেকে যাবে। আর এর মাধ্যমে সেই ব্যবসায়ী পুরোপুরি আমদানিই বন্ধ করে দেবেন, যা এই মুহূর্তে কোনোভাবেই কাম্য নয়।”
খাতুনগঞ্জের এক ব্যবসায়ী ক্ষোভের সুরে বলেন, “কই এস আলম গ্রুপের সামনে তো প্রতিবাদ আমরা দেখছি না। দেশের বড় ঋণখেলাপি ইলিয়াছ ব্রাদার্স, মোস্তফা গ্রুপ, মিশম্যাক গ্রুপ, ইমাম গ্রুপ, ক্রিস্টাল গ্রুপ, ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল, ছিদ্দিক ট্রেডার্সের সামনে তো অবস্থান কর্মসূচি নেই। তাহলে আমরা ধরে নেব যে ব্যাংকের এসব কর্মসূচি একপেশে? এগুলো করাকে এই মুহূর্তে আমি স্যাবোটাজই বলব।”