অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের চিকিৎসা পেশার নিবন্ধন বাতিলের পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে (বিএমডিসি) নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
দেড় বছর আগে ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে এন্ডোসকপির সময় এক প্রকৌশলীর মৃত্যুর ঘটনার তদন্তে ডা. স্বপ্নীলের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ায় সম্প্রতি এই নির্দেশ দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এই সংক্রান্ত চিঠি পাওয়ার কথা জানিয়ে বিএমডিসির রেজিস্ট্রার লিয়াকত আলী বলেছেন, তারা দ্রুতই তাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন।
বাংলাদেশে চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রিধারীদের পেশাগত কাজ পরিচালনার জন্য সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বিএমডিসি থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। নিবন্ধন ছাড়া কেউ চিকিৎসক হিসাবে কাজ করতে পারেন না।
ডা. স্বপ্নীল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেপাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক। এই বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান তিনি।
তার স্ত্রী ডা. নুজহাত চৌধুরী একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অপথ্যালমলজি বিভাগের অধ্যাপক। চক্ষু বিশেষজ্ঞ নুজহাত শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরীর সন্তান।
ধানমণ্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে ডা. স্বপ্নীলের কাছে এন্ডোসকপি করাতে গিয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বরে মারা যান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) উপজেলা প্রকৌশলী আফসার আহমেদ।
এই মৃত্যুর জন্য ডা. স্বপ্নীলের গাফিলতিকে দায়ী করে তার বিচার চেয়ে গত বছরের ২৪ মার্চ আফসারের ছোট ভাই খায়রুল বাশার তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলেন।
এক বছর পর গত ১৬ জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাঠানো হয় বিএমডিসিতে, সেখানে ডা. স্বপ্নীলের নিবন্ধন বাতিলের পদক্ষেপ নিতে বলা হয়।
প্রকৌশলী আফসারের মৃত্যুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার কথা জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, “সে তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) এর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।”
বিএমডিসি রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. লিয়াকত হোসেন বুধবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তারা মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছেন। তারা এনিয়ে কাজ করেছেন। খুব শিগগিরই সিদ্ধান্ত জানাবেন।
“এক্ষুনি কিছু বলতে পারছি না, একটু সময় দিতে হবে। এখনও আমাদের অফিসিয়াল কাজ শেষ হয়নি। তবে অলমোস্ট শেষের পথে। সামনের নির্বাহী কমিটির মিটিংয়ে বিষয়টি উপস্থাপন করতে হবে। খুব শিগগিরই আমাদের সিদ্ধান্ত আপনারা জানতে পারবেন।”
বিএমডিসি নিবন্ধন বাতিল করলে ডা. স্বপ্নীল আর চিকিৎসক হিসাবে কাজ করতে পারবেন না বলে জানান বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই মাহবুব।
তিনি সকাল সন্ধ্যার জিজ্ঞাসায় বলেন, “নিবন্ধন এবং নম্বর ছাড়া তখন তো সে আর চিকিৎসক নন, কাজেই তিনি চিকিৎসা দেবেন কীভাবে?”
কত দিনের জন্য এই শাস্তি হয়ে থাকে- জানতে চাইলে প্রবীণ এই চিকিৎসক নেতা বলেন, “সেটা রায়ে তারা (বিএমডিসি) লিখে দেন। আর এটা নির্ভর করে অপরাধের ওপর।”
বিএমডিসি যেমন কোনও চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে, তেমনি পুনরায় নিবন্ধন ফিরিয়েও দিতে পারে। বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইনেই তাদের এই ক্ষমতা দেওয়া আছে।
এই অভিযোগের বিষয়ে ডা. স্বপ্নীলের কোনও বক্তব্য সকাল সন্ধ্যা জানতে পারেনি। অভিযোগ ওঠার পর এর আগে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়েও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে তিনি অন্য সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, এই ঘটনায় তার কোনও গাফিলতি ছিল বলে তিনি মনে করেন না।
প্রকৌশলী আফসারের ভাই খায়রুল বাশার মন্ত্রণালয়ে দেওয়া আবেদনে বলেছিলেন, ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর সকালে তার ভাই ধানমণ্ডির ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালে গেলে ডা. স্বপ্নীল এন্ডোসকপির জন্য বিকালে আসতে বলেন। বিকালে যাওয়ার চার ঘণ্টা পর তার ডাক পড়ে। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ শুনে সকাল থেকে খাওয়া বন্ধ রেখেছিলেন তিনি। আবার ওষুধ সেবনের পর তার ঘন ঘন মলত্যাগ হচ্ছিল।
কিন্তু ডা. স্বপ্নীল এসব কিছু বিবেচনায় না নিয়েই প্রকৌশলী আফসারকে এন্ডোসকপি করার জন্য অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়ার নির্দেশ দেন বলে জানান বাশার। এরপর অবস্থা খারাপ হলে আইসিইউতে নেওয়া হয় আফসারকে এবং সেই রাতেই তার মৃত্যু হয়।
ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য ডা. স্বপ্নীল এবং ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, অবহেলাকে দায়ী করেন বাশার। আবেদনে তিনি আরও লেখেন, ডা, স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আরও রয়েছে।
গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ল্যাবএইড হাসপাতালেই ডা. স্বপ্নীল এন্ডোসকপি করার সময় রাহিব রেজা নামের এক রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটে। তাকেও আইসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। চার দিন পর তার মৃত্যু ঘটে।
রাহিব রেজার পরিবারেরও অভিযোগ, গাফিলতির কারণেই এই মৃত্যু ঘটেছে এবং এর দায় ডা. স্বপ্নীল কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
সেসময় দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন।
রাহিবের পরিবার আদালতেও গিয়েছিল। গত বছরের ১১ মার্চ আদালত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়।
ছয় মাস তদন্ত শেষে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করে অধিদপ্তরের কমিটি। যেখানে চিকিৎসায় গুরুতর অবহেলার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানানো হয়। ডা. স্বপ্নীলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বলেছিল তদন্ত কমিটি। তবে মন্ত্রণালয় এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।