Beta
মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪

জুয়া নিষিদ্ধ, অথচ বিজ্ঞাপন প্রকাশ্য

শাহবাগে বিলবোর্ডে ব্যাটজিলির বিজ্ঞাপন।
শাহবাগে বিলবোর্ডে ব্যাটজিলির বিজ্ঞাপন।
Picture of অনিক রায়

অনিক রায়

জুয়া খেলা কি বাংলাদেশে বৈধ? শাহবাগ মোড়ে বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড কিংবা টিভির পর্দায় বিজ্ঞাপন দেখলে অবৈধ মনে হওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ দেশের সংবিধান ও আইন বলছে ভিন্ন কথা।

শাহবাগ মোড় রাজধানীর ব্যস্ত এলাকার একটি। এ রাস্তায় যাওয়ার সময় ডিজিটাল বিজ্ঞাপনী বোর্ডগুলো চোখে না পড়ার উপায় নেই। সেই বোর্ডেই অনেক কিছুর সাথে বিজ্ঞাপন চলছে বেটজিলি (Batjili) ও ক্রিকএক্স.নিউজ (Cricex.news) নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের।

প্রথম প্রতিষ্ঠানটি দাবি করছে, তারা অনলাইনে বিভিন্ন খেলাধুলার সামগ্রী বিক্রি করে। আর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান বলছে, তাদের ওয়েবসাইট শুধুই ক্রিকেটের খবরের জন্য।

কিন্তু কেউ যদি Batjili নামে ইন্টারনেটে ঢুকতে চায়, তাহলে তা নিয়ে যাবে betjili.com এ, যা আসলে অনলাইন জুয়ার সাইট। সাইটটির বাংলা ভার্সনই রয়েছে। সেখানে জুয়া খেলার জন্য দেশের এমএফএস প্রতিষ্ঠান দিয়ে লেনদেনের সুযোগও রয়েছে।

Cricex.news এ ঢুকলে ক্রিকেটের বিভিন্ন সংবাদ অবশ্য পাওয়া যায়, তবে তার সঙ্গে অনলাইন জুয়ার পথে নিয়ে যাওয়ার লিংক রয়েছে।

দেশের বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের টিভি স্টেশন টি-স্পোর্টসে দেদারসে চলছে 1XBet ও MelBet মতো জুয়ার সাইটগুলোর বিজ্ঞাপন। তবে একই কৌশলে।

1XBet অনলাইন জুয়ার সাইট। কিন্তু বিজ্ঞাপনে নাম দেখানো হচ্ছে 1XBat। গুগলে এই নামে সার্চ দিলে অবশ্য আপনাকে 1XBet এ নিয়ে যাবে। একইভাবে Melbat আপনাকে নিয়ে যাবে Melbet এ। Cricex ও কৌশল করে নামের শেষে জুড়ে দিচ্ছে নিউজ শব্দটি।

এসব সাইটে কীভাবে জুয়া খেলতে হয়, কীভাবে লেনদেন করতে হয়, তা নিয়ে ইউটিউবে বেশ কিছু ভিডিও রয়েছে। মাসে বড় অঙ্কের অর্থ পাওয়ার নানা প্রলোভন রয়েছে সেখানে।

1xbet Agent Bangladesh নামে ফেইসবুক পাতা রয়েছে, যা অনুসরণ করছে ৩৫ হাজার জন। ১ থেকে ৫ মিনিটের মধ্যে অর্থ জমা ও তুলে নেওয়ার সুযোগ থাকার ঘোষণা দেওয়া রয়েছে সেখানে।

অনলাইন জুয়ার সাইটের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান। পরে তিনি চুক্তি বাতিল করেন। কিন্তু কৌশলী নামের সাইটের বিজ্ঞাপনে তার মুখ দেখা যাচ্ছে নিয়মিতই।

Cricex.news এর ওয়েবসাইটে খেলার সংবাদের পাশাপাশি দেখাচ্ছে জুয়ার প্রলোভন।

আইন কী বলছে

বাংলাদেশ পরিচালনার খুঁটি সংবিধানেই জুয়া নিয়ে স্পষ্ট বলা আছে। এর ১৮ (২) অনুচ্ছেদে নৈতিকতা রক্ষায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

১৮৬৭ সাল থেকে চালু প্রকাশ্য জুয়া আইন অনুসারে, কেউ টাকার বিনিময়ে বাজি বা জুয়ার আসর বসালে এবং কেউ তাতে অংশ নিলে তা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ।

সুতরাং সংবিধানের ১৮ (২) অনুচ্ছেদ এবং প্রচলিত আইন অনুসারে সব ধরনের জুয়া বাংলাদেশে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

১৮৬৮ সালের পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, যে কোনও ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনও সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

অন্যদিকে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির (যা বাংলাদেশে বলবৎ) ২৯৪ (ক) ধারায় অনুমোদনহীন লটারির জন্য জরিমানাসহ ছয় মাসের জেলের বিধান রয়েছে।

কিছু দিন আগে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বাংলাদেশে সব ধরনের জুয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল। এর বাইরেও হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ ২০১৪ সালের ১৮ জুন জুয়াবিরোধী একটি রায় দেয়। তাতে বলা হয়, অর্থ দিয়ে সব খেলাই অবৈধ।

১৮৬৮ সালের আইনটি যুগোপযোগী করতে সরকার ‘জুয়া প্রতিরোধ আইন’ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২৩ সালে আইনের খসড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রণয়ন করলেও তা এখনও পাস হয়নি।

বেটজিলি পুরোপুরি একটি অনলাইন জুয়ার সাইট, যেখানে বাংলাদেশ থেকে লেনদেনের সুযোগও রয়েছে।

আইনজীবীর উদ্যোগ, কী বলছেন তিনি

২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খন্দকার হাসান শাহরিয়ার এবং ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী ইসমাতুল্লাহ লাকী তালুকদার বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন দেখানো বন্ধে টি স্পোর্টসকে লিগ্যাল নোটিস দেন। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। এখনও চলছে বিজ্ঞাপন।

সেই বিজ্ঞাপনের কৌশলটি নিয়ে আইনজীবী হাসান শাহরিয়ার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তারা নাম পাল্টে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, যেন কেউ কিছু বললে তারা বলবে এটা ওই প্রতিষ্ঠান না। নিউজ শব্দটিও ব্যবহার করার ঝোঁক আছে এসব সাইটের।

“এসব সাইটে নিউজ বা ছবিও পাওয়া যায়। কিন্তু এসব সাইটের আসল কনটেন্ট কী, তা দেখতে হবে। ওরা এমনভাবে এসওএস (সেকেন্ড ওপিনিয়ন সার্ভিস) ঠিক করে রাখে, আপনি এই নামের আশপাশে যাই সার্চ করবেন, জুয়ার সাইটগুলোই পাবেন।”

এটা কতটা বৈধ- প্রশ্নে তিনি বলেন, “কোনোভাবেই বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন দেখানো আইনসম্মত না।”

হাসান শাহরিয়ার টি স্পোর্টসকে যে লিগ্যাল নোটিস দিয়েছিলেন, তার কোনও অগ্রগতি নেই।

তিনি বলেন, “আমি যখন নোটিসটা দিলাম, সংবাদপত্রগুলো কিন্তু এ নিয়ে কথা বলেছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনও পদক্ষেপ নিতে কিন্তু দেখা যায়নি। তাদের কাছ থেকে যে সহযোগিতা আমার পাওয়ার কথা ছিল, আমি কিন্তু তা পাই নাই।”

২০১৯ সালে ঘটা করে ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে থাকা ক্যাসিনো বন্ধের অভিযানে নেমেছিল আইনশৃঙ্থলা বাহিনী। তখন অনলাইন ক্যাসিনো চালানোয় জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। তবে পরে মিইয়ে আসে সেই অভিযান।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় না হলে অনলাইন জুয়া বন্ধ করা যাবে না বলে মনে করেন হাসান শাহরিয়ার।

“এসব বিষয়ে আসলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু তাদের তো আমরা ভূমিকা নিতে দেখি না। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে করে না, না কি আইন তারা ভালো মতো জানে না, তা আমি বুঝতে পারি না।”

শাহবাগের বিলবোর্ডে ব্যাটজিলির বিজ্ঞাপন। ছবি : হারুন-অর রশীদ

যারা দিচ্ছেন বিজ্ঞাপন, কী বলছেন তারা

বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার নিয়ে টি-স্পোর্টসের হেড অব মার্কেটিং আহমেদ রাকিবের সঙ্গে কথা হয় সকাল সন্ধ্যার। তবে তিনি এসব বিজ্ঞাপনকে জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন হিসাবে স্বীকার করতে রাজি নন।

রাকিব বলেন, “আমরা যেসব বিজ্ঞাপন দিচ্ছি, সেগুলো জুয়ার সাইট নয়। এগুলো বেশিরভাগই নিউজ কিংবা খেলা সম্পর্কিত সাইট।”

কিন্তু এসব সাইটের নামে গুগলে সার্চ দিলে জুয়ার সাইটগুলোকে রিডিরেক্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, “এটা তো আমার দেখার বিষয় না। এখন এগুলো সার্চ করলে কী পাওয়া যায়, তা আমার দেখার বিষয় না।

“যাদের জুয়া খেলায় ইন্টারেস্ট, তারা জুয়ার সাইটেই যাবে। এসব বলে আসলে আমাদেরকে মিসলিড করার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা যেটা প্রমোট করছি, সেগুলা জুয়ার সাইট না।”

শাহবাগে সেই বিজ্ঞাপনী ডিজিটাল বোর্ডের দায়িত্বে রয়েছে শাহীন ট্রেডার্স নামে এক প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের শাহবাগের বিজ্ঞাপনী বোর্ডের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হোসেনের সঙ্গে কথা বলে সকাল সন্ধ্যা।

প্রথমে তিনি স্বীকার করে নেন যে এসব সাইট জুয়ার। খানিক পরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন বুঝে বন্ধ করে দেন ফোন।

তবে তার আগে যতক্ষণ কথা হয়েছে, সেই সময় তিনি বলেন, “এসব বিজ্ঞাপন জুয়ার সাইটের। বেশি দিন তো থাকবে না, কয়েকদিন পরই সরিয়ে ফেলা হবে।”

টি স্পোর্টসের অনেক অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে 1xbat।

মন্ত্রণালয় ‘জানেই না’

প্রকাশ্যে জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন হচ্ছে টিভি বা বিলবোর্ডে। কিন্তু এ বিষয়ে কিছুই জানে না তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আলতাফ-উল-আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি এ বিষয়ে জানি না। খোঁজ নিয়ে আপনাকে পরে জানাব।”

এতটুকু কথা বলার পর আর প্রশ্ন করার আগেই তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন। পরে আর তিনি সকাল সন্ধ্যার ফোন ধরেননি।

এরপর কথা হয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কমিশনার প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদের সঙ্গে। তিনিও দাবি করেন যে তিনি কিছুই জানতেন না।

“স্যাটেলাইট চ্যানেলে বিজ্ঞাপন চলছে! তা তো আমি জানতাম না। আপনার কাছ থেকে জানলাম। আমরা খোঁজ নেব।”

বিটিআরসি কমিশনার বলেন, “আমরা ৬৪ জেলার সব জেলা প্রশাসককে চিঠি পাঠিয়েছি। তারা তাদের এলাকায় এরকম যেসব সাইট কার্যকর আছে, তাদের ইনফরমেশন আমাদের পাঠায়। আমরা সাথে সাথে সেইসব সাইট বন্ধ করে দিই।”

ভারতের টি টোয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আইপিএল ধরে জুয়ার প্রলোভন আছে Cricex.news এ।

আইনের দুর্বলতার অজুহাত

ওয়ার্ল্ড গ্যাম্বলিং মার্কেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বে অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য ছিল ৫ হাজার ৮২০ কোটি মার্কিন ডলারের। ২০৩২ সালে এর বাজারমূল্য ১৪ হাজার ৫৬০ কোটি ডলারের হওয়ার পূর্বাভাস আছে প্রতিবেদনটিতে। প্রতি বছর জুয়ার বাজারমূল্য ১২ শতাংশ বাড়ছে বলে জানায় প্রতিবেদনটি।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ১৫০টির ওপরে অনলাইন জুয়া কিংবা বেটিং সাইট সক্রিয় রয়েছে। এসব সাইটে প্রায় ২০ লাখের মতো মানুষ বেটিং কিংবা জুয়া খেলে থাকেন।

জুয়া ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাই মূল বলে আইনজীবী হাসান শাহরিয়ার মনে করলেও পুলিশ কর্মকর্তারা আইনের দুর্বলতাকে অজুহাত দেখাচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক পুলিশ কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা প্রায়ই এসব জুয়ার সাইটের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিই। সাইটগুলোর এড্রেস আমরা বিটিআরসিকে পাঠাই। তারা বাকি ব্যবস্থা নেয়।

“প্রয়োজন হলে আমরা অপারেশনও পরিচালনা করি। বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের আইনের দুর্বলতা থাকার কারণে আসামিরা সহজেই জামিন পেয়ে যায়।”

একই বক্তব্য দিলেন পুলিশের সাইবার ক্রাইমের ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তাও। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এরকম সাইটের বিজ্ঞাপন দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। কেউ অভিযোগ করলে অবশ্যই সেই বিজ্ঞাপনদাতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।”

আইনজীবী হাসান শাহরিয়ার পুলিশ কর্মকর্তাদের এমন বক্তব্যে সন্তুষ্ট নন।

তিনি বলেন, “প্রচলিত আইনেই তো শাস্তির বিধান আছে। সেইটাই নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আইনে কিছু পরিবর্তন আসা গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলে আইনের দোহাই দিয়ে অপরাধীদের সুযোগ দেওয়া উচিৎ না।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত