১০ বছর আগে নাক গহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন ভুটানের তরুণী কার্মাডেমা (২৩)। ভুটানে সেই চিকিৎসা না থাকায় সুস্থ হওয়ার আশায় তিনি চিকিৎসা নিতে যান থাইল্যান্ড ও ভারতে। সেখানেও সুস্থ হতে না পেরে আসেন বাংলাদেশে।
ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ওই ভুটানি তরুণী কার্মাডেমা। এখন নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
শনিবার ঢাকার জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে কার্মডেমার পুরো চিকিৎসাসফর তুলে ধরেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। এসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন কার্মাডেমা নিজেও। জটিল এই চিকিৎসার পুরো বিষয়টি দেখভাল করছেন বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন।
সেখানে জানানো হয়, ১০ বছর আগে নাক গহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন ভুটানের কার্মাডেমা। সুস্থতার আশায় চিকিৎসার জন্য কয়েক দেশ ঘুরে তিনি আসেন বাংলাদেশে।
পেছনের গল্পটা শোনান কার্মাডেমার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের নেতৃত্বদানকারী ও বার্ন ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ চন্দ্র দাস। তিনি জানান, কার্মাডেমার চিকিৎসা ভুটানে সম্ভব ছিল না। সুস্থ হওয়া আশায় তিনি ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে যান। সেখানে তাকে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে তার নাকের ভেতরে পচন দেখা দেয় এবং নাকের আকার-আকৃতি অস্বাভাবিক হয়ে যায়।
নাকের আকার ঠিক করার জন্য নতুন করে টাটা মেমোরিয়ালে ভর্তি হন কার্মাডেমা। প্রদীপ চন্দ্র দাস বলেন, “তার নাকে দুইবার অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু তিনি আর আগের স্বাভাবিক চেহারা ফিরে পাননি। পরে ভুটান চলে যান কার্মাদেমা।”
বাকিটা গল্পটা শোনান কার্মাডেমা নিজেই। বাংলাদেশের চিকিৎসক, সরকারসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, “সার্জারির আগে আমার পরিস্থিতি নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম। সার্জারির পর অনেক ভালো অনুভব করছি। এখানে চিকিৎসা অনেক ভালো ছিল। আমি সুস্থবোধ করছি।
“যখন আমি সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম, তখন বাংলাদেশের চিকিৎসক ও বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন, সফল চিকিৎসাও দিয়েছেন।”
যেভাবে বাংলাদেশে কার্মাডেমা
গত বছরের সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভুটান সরকার যৌথভাবে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে একটি প্লাস্টিক সার্জারি ক্যাম্পের আয়োজন করে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন ছিলেন সেই ১৪ সদস্যের চিকিৎসক দলের প্রধান।
সে বিষয়ে প্রদীপ চন্দ্র দাস বলেন, সেখানে সাতদিনের বিশেষ ক্যাম্পেইনে ১৬টি জটিল অস্ত্রোপচার হয়। সেখানেই এসেছিলেন কার্মাডেমা। কিন্তু বিদেশিদের এনে দেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু আইনি জটিলতা আছে। সব মিলিয়ে এরপর বাংলাদেশ ও ভুটান সরকার কার্মার চিকিৎসার বিষয়ে একমত হয়। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর তাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কার্মার নাকে অস্ত্রোপচার হয় গত নয় জানুয়ারি। চিকিৎসকদের তিনটি দল যৌথভাবে প্রায় নয় ঘণ্টা ধরে নাক পুনর্গঠনের সার্জারি করে। তার শরীরের তরুণাস্থি ও হাতের চামড়া নিয়ে নাক পুনর্গঠন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনের পরে সামন্ত লাল সেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা যখন ভুটানে গিয়েছিলাম, তখন আমি সবগুলো আউটডোরেই ছিলাম। তখনই এই মেয়েটা সম্পর্কে আমাদের আলাপ হয়। আমরা চিন্তা করলাম তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে হবে।”
“তাৎক্ষণিক আমি ভুটানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বললাম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও একটা মেসেজ দিলাম যে, আমরা একজন রোগী নিয়ে আসছি। উনি বললেন, ঠিক আছে, তুমি নিয়ে আসো।”
তবে কার্মার আরও অস্ত্রোপচার দরকার হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আপাতত আমরা তাকে ছেড়ে দিচ্ছি। পরে সে আবার আসবে এবং আমরা তার নাকটা সুন্দর করে একটা পর্যায়ে নিয়ে যাব।”
বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার মান বিশ্বের কোনও দেশের তুলনায় কম নয় উল্লেখ করে সামন্ত লাল সেন বলেন, “শুধু সুযোগের অভাবে চিকিৎসকরা সেটি তুলে ধরতে পারেন না। দেশের চিকিৎসকদের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো সুযোগ দেওয়া গেলে তারা তাদের যোগ্যতা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারবেন।
“কার্মডেমার সফল চিকিৎসা করে বাংলাদেশি চিকিৎসকরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, বিদেশ থেকেও খুব শীঘ্রই দলে দলে মানুষ বাংলাদেশে চিকিৎসা নিতে আসবেন এবং বিদেশিদের উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা দেবার সেই সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। কার্মার এই চিকিৎসা যেখানে ‘সম্ভব নয়’ বলে ভারত ও অন্যান্য অনেক দেশ ফিরিয়ে দিয়েছিল। সেই চিকিৎসা আমরা সফলভাবে করতে সক্ষম হলাম। রোগী সুস্থ অবস্থায় এখন ভুটান চলে যেতে পারবেন।”
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “এই রোগীর চিকিৎসা করা ছিল অত্যন্ত কঠিন ও জটিল কাজ। এর আগে ভারতে ও ভুটানে তার অপারেশন হয়েছিল, থাইল্যান্ডেও সে চিকিৎসা নিয়েছিল। কিন্তু তার এরআগের অপারেশনগুলো সাকসেসফুল না হওয়ায় পরবর্তী অপারেশন করাটা ছিল ভীষণ জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ কারণে অনেক দেশই তার নতুন করে আরেকটি অপারেশন করার সাহস করতে পারেনি।”
আমরা এটিকে দেশের ভাবমূর্তির প্রশ্ন ধরে নিয়ে চিকিৎসা বোর্ড করে এই অপারেশন কাজে হাত দেই- মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দীর্ঘ সময় ধরে শরীরের অন্য জায়গা থেকে রক্তসহ মাংস, হার কেটে নাকে লাগিয়ে দেওয়া এবং নাকের রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখাটা ছিল রীতিমতো চ্যালেঞ্জের কাজ। সেই কঠিন কাজটি আমাদের চিকিৎসকরা সফলতার সঙ্গে করে দেখিয়েছেন।”
এটি দেশের চিকিৎসা সেবার জন্য বিরাট এক অর্জন জানিয়ে তিনি বলেন, “এরকম সফলতার পর ভুটানেও ১৫ শয্যার বার্ন ইনস্টিটিউট করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। নেপালসহ অন্যান্য সার্কভুক্ত দেশগুলোতেও এরকম জটিল চিকিৎসা সেবা আমাদের চিকিৎসকদের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়াসহ বিদেশি রোগীদের দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে আলাপ আলোচনা করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে ভুটানের রাষ্ট্রদূত রিং চেং কুইং সিল বলেন, “এই জটিল অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন করে বিশ্বের অন্য দেশ যা পারেনি, বাংলাদেশ সেটিই করে দেখিয়েছে। বিশ্বের অন্য দেশগুলো যখন বলেছিল এই অপারেশন সম্ভব নয়, তখন বাংলাদেশ বলেছিল সেটি সম্ভব, এবং বাংলাদেশ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।”