ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি। মল চত্বর হিসেবে পরিচিত এলাকায় দেখা যাচ্ছে এই চিত্র। হাকিম চত্বর, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে, ডাকসু ও মধুর ক্যান্টিনের সামনে, কলা ভবনের বিপরীতে এবং আরও কিছু পয়েন্টেও গাছে বেঁধে দেওয়া হয়েছে হাঁড়িগুলো।
হাঁড়িগুলো বেঁধেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। তারা বলছেন, এগুলো পাখির জন্য ‘নিরাপদ বাসা’। পরিবেশবান্ধব কর্মসূচির অংশ হিসেবে এটি করেছেন তারা।
শুধু পাখির বাসাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে ভবিষ্যতে ফলের বাগান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ এরকম নানা কর্মসূচি রাখতে চায় ছাত্রদল। সেজন্য তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামতও নিচ্ছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নতুন পরিস্থিতিতে এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে কী বার্তা দিতে চান তারা—প্রশ্ন উঠেছে।
ছাত্রদল বলছে, নতুন ধারার ইতিবাচক রাজনৈতিক চর্চা করতেই তাদের এই উদ্যোগ।
পকেট খরচ দিয়ে বেঁধেছে ‘পাখির বাসা’
‘পাখির জন্য নিরাপদ বাসস্থান’ বানানোর এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. নাছির উদ্দিন শাওন।
এই কার্যক্রমে অংশ নেন সৈকত মোর্শেদ, ইমাম আল নাসের মিশুক, ফাহিম ফয়সাল, সাইফ খান, আকিব জাবেদ রাফি, মানিউল পাঠান শান্ত, মাহমুদুল হাসান, আবদুল্লাহ আল কাফি, রুহুল আমিন সবুজ, সাকিবসহ প্রায় পঞ্চাশের মতো নেতা-কর্মী।
এই উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদল নেতা নাছির উদ্দিন শাওন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেখেন, আমরা একসময় ক্যাম্পাসে একপ্রকার নিষিদ্ধই ছিলাম। কোনও ধরনের এক্টিভিটিস আমাদের করতে দেওয়া হয় নাই। এক্টিভিটিস দূরের কথা, আমরা ক্যাম্পাসেই আসতে পারতাম না। আমি নিজে ঢাবি ছাত্রলীগ দ্বারা পাঁচবার হামলার শিকার হয়েছি।
“গত পাঁচ আগস্টের পর ফ্যাসিবাদের যে রাজনৈতিক চর্চা, সেই চর্চার পরিবর্তনে একটি পটভূমি তৈরি হয়েছে। আমরা সেই পটভূমিতে ‘নতুন ধারার ইতিবাচক রাজনৈতিক চর্চা’ করতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, পাখিদের জন্যেও নিরাপদ আশ্রয়স্থল হবে, এমন আশা নিয়েই আমাদের এই উদ্যোগ।”
নাছির বলেন, “আমি যখন ফার্স্ট ইয়ারে ছিলাম, এই ক্যাম্পাসে…বিশেষ করে মল চত্বর পাখির কল-কাকলিতে সবসময় মুখরিত ছিল। আর এখন দেখেন অবস্থা…কাক ছাড়া তেমন কোনও পাখিই দেখা যায় না। সেদিক থেকে জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটি পাখিদের জন্য এখনও সুন্দর পরিবেশ রয়েছে।
“ঢাবিকে নিয়ে আমাদের এরকম ভাবনা আগেও ছিল। কিন্তু করার সুযোগ ছিল না। তাই এক এক করে আমরা আমাদের এমন সব কার্যক্রম পরিচালনা করছি।”
প্রাথমিকভাবে পুরো ক্যাম্পাসে ২০০ মাটির হাঁড়ি বাঁধার উদ্যোগ নিয়েছে ছাত্রদল। বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দেড়শো হাঁড়ি তারা বেঁধেছে। বাকিগুলোও শিগগিরই হবে।
এই উদ্যোগের অর্থ কীভাবে আসছে—জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “এর আলাদা কোনও ফান্ড নেই। আর বেশি খরচও হচ্ছে না, একেকটা হাঁড়ি ত্রিশ টাকারও কম পড়েছে কিনতে। আমরা যারা ছাত্রদলের নেতা-কর্মী আছি…আমরা আমাদের পকেট মানি থেকে সেভ করে সামান্য যে খরচটা হচ্ছে সেটি জোগাচ্ছি।
“শুধু এই পাখির বাসা স্থাপন করাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না আমাদের কার্যক্রম। আমাদের প্ল্যানে আছে আমরা ক্যাম্পাসে ফলের বাগান করব। ক্যাম্পাসে ওয়াইফাই জোন করব। কোনটার পরে কোনটা করব—সেটা এখনও ঠিক করিনি। তবে আমরা এসমস্ত আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করছি।”
নতুন ধারার রাজনৈতিক চর্চা
প্রচলিত রাজনৈতিক চর্চা বাদ দিয়ে নতুন ধারার মানবিক ও ইতিবাচক রাজনৈতিক চর্চার উদাহরণস্বরূপ ‘পাখির বাসা’ স্থাপন করার মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতারা।
আর এমন সব কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানান ছাত্রলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন।
তিনি বলেন, “আমরা আসলে পূর্বে দেশে চলমান যে রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা ছিল, সেই ধারণাকে পালটে দিতে কাজ করছি। আগের সময়ে ছাত্রলীগের যে চর্চা ছিল…আমি অস্বীকার করব না, সেরকম কিছু চর্চা ছাত্রদলেরও ছিল…ভুল-ঠিক যেটাই হোক। এই চর্চা থেকে বেরিয়ে দেশের মানুষকে আমরা নতুন কিছু উপহার দিতে চাই।
“এই ধরেন, ক্যাম্পাসে আগে আমরা শোডাউন দিতাম…মোটরসাইকেল শোডাউন ছিল ছাত্ররাজনীতির একটা অংশ। কিন্তু এবার আমরা এসব কিছু করছি না। আমি নিজে বিভিন্ন এলাকায় যাই, দুয়েকজন নিয়ে যাই। সাথে কোনও বহর নিই না, আসতেও দিই না। এই চর্চা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের কর্মীদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। আর তারই অংশ হিসেবে আমরা পাখিদের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের মতো কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।”
সারাদেশে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ইতিবাচক কার্যক্রমের বিষয়ে মতামত নিচ্ছে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা। প্রয়োজন ও গুরত্ব বিবেচনায় ধারাবাহিকভাবে নানা সামাজিক ও মানবিক কার্যক্রমের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে তারা।
নাছির বলেন, “গত পাঁচ আগস্টের পর কক্সবাজারে আমাদের ছাত্রদল নেতা-কর্মীরা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এলাকা দুই দিনব্যাপী পরিষ্কার করে। আমরা এই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সামনে কর্মসূচি দেব।
“এই উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে মানুষের যেই ভয় এবং খারাপ ধারণা জন্মেছে, তার সমাপ্তি ঘটিয়ে নতুন বাংলাদেশে নতুন কিছু উপহার দিতে চাই।”