ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে দেড় মাস হতে চলল।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। এসব কমিশন এখনও গঠিত না হলেও বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে। সংস্কারের পরই নির্বাচন, এমন কথা এসেছে উপদেষ্টাদের কাছ থেকে।
নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চিন্তাধারা নিয়ে আলোচনাও জোরাল হচ্ছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এরইমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। সংস্কারের জন্য এই সরকারকে সময় দিতেও অরাজি নন তিনি।
বিএনপি মনে করছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ। মৌলিক এই সংস্কার শেষেই দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া দরকার।
বিএনপি সময় দিতে রাজি হলেও খানিকটা অনুরোধের সুরে নির্বাচনের তাগাদা দিচ্ছে। দলটির শীর্ষ নেতারা বলছে, ‘যৌক্তিক সময়ের মধ্যে’ নির্বাচন দিতে হবে।
তবে সেই যৌক্তিক সময়টি কত দিন, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনও ধারণা না পেয়ে ক্ষুব্ধ বিএনপির তৃণমূল পর্যায়। ভোটের জন্য মুখিয়ে থাকা এই নেতারা ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন চাইছেন।
শীর্ষ নেতারা যাচ্ছেন এড়িয়ে
যৌক্তিক সময় কত দিন চাইছেন- প্রশ্ন করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সরাসরি উত্তর এড়িয়ে যান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ছাত্র-জনতার অভ্যুথানের মাধ্যমে যারা এখন সরকারে এসেছেন, তাদের ওপর মূল দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। কীভাবে জনগণের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার আগে, জনগণের অধিকার…যেটি কিনা নির্বাচনের মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব…সেই অধিকার ফিরিয়ে দিবেন, আর সেটি কত দ্রুত সময়ের মধ্যে হওয়া উচিৎ, সেটা তাদের বিবেচনা করতে হবে। আমরা সেই বিবেচনাকে ‘যৌক্তিক সময়’ বলছি।”
মির্জা আব্বাসের মতো একই সুরে যৌক্তিক সময়ের ব্যাখ্যা দেন স্থায়ী কমিটির আরও তিন সদস্য নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান ও মুহাম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার।
তারাও কেউ সরাসরি সময় সুনির্দিষ্ট করেননি। তবে নির্বাচনের আগে প্রাথমিক যে সংস্কার, তা করতে বেশি দিন লাগার কথা নয় বলে মনে করেন তারা।
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ কিছুটা ভিন্ন সুরে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশটার যে হাল, তাতে প্রাথমিক সংস্কারে কিছুটা সময় প্রয়োজন, এটা আমরাও বুঝি। তবে আমরা বলতে পারি যে অন্তত রোডম্যাপটা ঘোষণা করা হোক। তাহলে অন্তত ধারণাটা ক্লিয়ার হবে।”
তৃণমূল নেতারা কী চাইছেন
শীর্ষ নেতাদের বলা ‘যৌক্তিক সময়’ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে তৃণমূেলর অনেক নেতার। তবে বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি নন।
উপজেলা পর্যায়ের এক নেতা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তিন মাস থেকে ছয় মাসের মধ্যেই নির্বাচন দিতে হবে। অন্তত ডিসেম্বরের মধ্যে এসব বিষয় খোলাসা করতে হবে।”
গাজীপুর জেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, “স্বৈরাচার থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। এখন নির্বাচন দিয়ে জনপ্রতিনিধিত্ব নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত পানি খাওয়াও পাপ। এটি ডিসেম্বরের আগেই হতে হবে।”
অন্তর্বর্তী সরকার যদি এক বছর পর নির্বাচন দিতে চায়, সেই এক বছরকে যৌক্তিক সময় মনে করবেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “না, তা তো আমরা যৌক্তিক বলব না। তারা জনগণের মধ্যে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দায়িত্বে বসেছেন। বেসিক যে সংস্কার সেগুলো দ্রুত করে জনগণের ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্ব নিয়ে আসবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যে সরকার আসবে, তারা বাকি সেই সংস্কার করবে।”
“তবে সেটা যৌক্তিক সময়ের বেশি হয়ে গেলে তো আমরা আর চুপ করে বসে থাকব না,” বলেন তিনি।
যৌক্তিক সময় বলতে সর্বোচ্চ ছয় মাস হতে পারে বলে মনে করেন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি শিকদার শহীদুল ইসলাম লেলিন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ছয় মাসের বেশি হলে সেই সময়কে আমরা যৌক্তিক মনে করব না।”
এমন মত বরিশাল দক্ষিণ জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক তসলিম উদ্দিনেরও। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা জনগনের কাছে জবাবদিহিমূলক সরকার চাই। আর তার জন্য সর্বোচ্চ ছয় মাস থেকে এক বছর হতে পারে। নয়ত জনগণ বিদ্রোহ করবে।”
ভোলা জেলা যুবদলের সভাপতি জামাল উদ্দিন লিটনের মতও তসলিমের মতো।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং মহাসচিব সাহেব দুজনেই ইতিমধ্যে
তিনি সেই সঙ্গে বলে এই বিষয়ে কথা বলেছেন। ‘যৌক্তিক সময়ের’ মধ্যে দ্রুত নির্বাচনী রোড ম্যাপ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
“সেই সময়টা কতদিন হবে, এটা তো আমার সিদ্ধান্ত না। তারা যেভাবে বলবেন, সেভাবেই হবে। তবে, অবশ্যই সেটা দ্রুত সময়ের মধ্যে হোক, এই প্রত্যাশাই আমাদের সবার।”
আমিনুলের মতো সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সভাপতি ইফতেখারুল ইসলামও তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাতেই যৌক্তিক সময় নির্ধারণের ভার দেন।
নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দীর্ঘ সময় নিলে তাদের নিয়ে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনকে আন্দোলনের ‘হাফ বিজয়’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “ফুল বিজয় পেতে নির্বাচন দিতে হবে। আর নির্বাচন না দেওয়া পর্যন্ত আমরা মাঠে থাকব।”
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য বলেন, “আমরা শীর্ষ নেতাদের আদর্শ মনে করি। জাতীয়তাবাদ আদর্শে আমরা দেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। ফ্যাসিস্ট সরকার চলে গেলেও দেশে এখনও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। আর তা না করা পর্যন্ত নমনীয় হওয়ার সুযোগ নেই। ভয়েস রেইজ করতে হবে। (নির্বাচনের জন্য) তাগাদা দিতে হবে।”
তারেক আর ফখরুল কি ভিন্ন পথে
গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, অবিলম্বে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঠিক তার এর একদিন পরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ঢাকায় এক জনসভায় দেওয়া বক্তব্যে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।
ফখরুল নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আনলেও তারেক সে বিষয়ে কোনও তাগাদা দেননি; যদিও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছেন তিনি।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, এ বক্তব্যের মাধ্যমে তারেক রহমান নির্বাচনের সময় নিয়ে নমনীয় মনোভাব পোষণ করেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের দিক থেকে কোন রাজনৈতিক দল গঠন করা হবে কিনা এই বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ বিএনপির কাছে। যদিও ছাত্র সমন্বয়করা বলেছেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে আপাতত কোনো চিন্তা নেই তাদের। তবে এই বিষয়টি নিয়েও তারেক রহমান ও ফখরুলের বক্তব্যে ভিন্নতা পাওয়া গিয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গড়ার সম্ভাবনা নিয়েও বিএনপির শীর্ষ দুই নেতার বক্তব্য দুই রকম।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ফখরুল বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের মধ্য থেকে বলা হচ্ছে, নতুন দল তৈরি করতে হবে। নতুন দল তৈরি করার কথা বললে জনগণ কীভাবে বুঝবে তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছেন?”
অন্যদিকে তারেক রহমান ১৭ সেপ্টেম্বরের সমাবেশে বলেন, “কেউ যদি মনে করেন একটি উন্নত এবং নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য আরও নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে, তাতেও দোষের কিছু নেই। কারণ, শেষ পর্যন্ত জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে সমর্থন জানাবে কিংবা কাকে সমর্থন দেবে না।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএনপি নেতা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের শীর্ষ দুই নেতার ইঙ্গিত ঠিক বুঝে উঠ্তে পারছি না। আমরা সুনির্দিষ্ট ইশারা চাই।
“আমার শরীরজুড়ে আওয়ামী স্বৈরাচারের নির্যাতনের চিহ্ন। তাও মনে কষ্ট নেই। আশা এটাই যে দেরিতে হলেও আমরা স্বাধীনভাবে ঘর থেকে বের হতে পারছি। আমি এখনও আমার প্রথম ভোট দিতে পারিনি। অতি শিগগিরই নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানাই।”
তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল মনে করেন না যে তাদের বক্তব্যে কোনও অস্পষ্টতা রয়েছে।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের বক্তব্যের সারমর্ম একই। এখানে কোনও ভিন্নতা নেই। কন্টেক্সটের কারণে এমন মনে হতে পারে।
“এখানে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যা বলছেন, আমিও তাই বলেছি যে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া হোক। পার্লামেন্টের মাধ্যমে সংবিধান বিষয়ক সমস্যার সমাধান করা হোক।”