দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জনের পরও আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু চার মাস গড়ালেও কোনও কর্মসূচি গড়ায়নি মাঠে। এই অবস্থায় মিত্র ৩৯টি দলকে নিয়ে বৈঠকে বসে দলটি। ধারাবাহিক সেই বৈঠক শেষ হয়েছে গত ১৮ মে।
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোর আন্দোলনের পরবর্তী গতিপথ ঠিক করতে এই বৈঠক ডাকা হলেও তাতে ঘুরে ফিরে এসেছে জামায়াতে ইসলামীর প্রসঙ্গ। এই আন্দোলন জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে হবে, নাকি বাদ দিয়ে, সেই প্রশ্নের সুরাহা হয়নি।
কোনও কোনও দল জামায়াতকে নেওয়ার কথা বললেও কিছু দল থেকে বিরোধিতাও এসেছে।
বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, জামায়াত নিয়ে কথা ওঠায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিব্রত হলেও বৃহত্তর ঐক্য ও সামনের আন্দোলনের স্বার্থে বিতর্ককে এড়িয়ে এগোতে চান তারা।
১৯৯১ সালে সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দিলেও তাদের সঙ্গে জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে জোট বেঁধেছিল ১৯৯৯ সালে। এরপর ২০০১ সালে জোটগতভাবে নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার সরকারে জামায়াতও যোগ দেয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তাদের জোট ছিল অটুট।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর একাত্তরের যুদ্ধারাধের বিচারে জামায়াতের শীর্ষ নেতার সাজা হয়। তার প্রতিবাদে আন্দোলনে বিএনপিকে পাশে না পাওয়ার অভিযোগ তোলেন জামায়াতের নেতারা।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত কেউই যায়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে বাদ রেখে বিএনপি কামাল হোসেনকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে জোট গড়ে। তবে ভোটে কয়েকটি আসনে জামায়াতকে ছাড় দিয়েছিল সেই জোট। এবছর নির্বাচনে তারা দুই দলই ভোট বর্জন করে।
দীর্ঘদিনের মিত্র দলটির সঙ্গে বিএনপির টানাপড়েন বারবার আলোচনায় এলেও বিএনপি নেতারা কখনও মুখ খোলেননি। তারমধ্যেই গত রমজানে ইফতার পার্টিতে তাদের পারস্পরিক যোগদান সম্পর্ক জোড়া লাগার ইঙ্গিত হিসাবে দেখতে শুরু করেন অনেকেই।
তার এক মাসের মধ্যে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে জামায়াতের প্রসঙ্গ আসে।
কেউ চায়, কেউ চায় না
বিএনপির অন্যতম মিত্র ১২ দলীয় জোট। বৈঠকে তাদের পরামর্শ ছিল, মাঠের আন্দোলন সফল করতে হলে জামায়াতসহ বাম-ডান ও ইসলামী ঘরানার সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামতে হবে। কারণ তারা মনে করে, বিএনপির বাইরে সাংগঠনিকভাবে জামায়াত শক্তিশালী।
১২ দলীয় জোটের একাধিক নেতা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, গত ২৮ অক্টোবরের আগে একমঞ্চ থেকে আন্দোলন পরিচালনার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তা প্রায় বাস্তবায়িতও হচ্ছিল। কিন্তু যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দু-একটি দলের বিরোধিতার কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। ২৮ অক্টোবর জামায়াতসহ সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলেও আন্দোলনের পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত।
১২ দলীয় জোটের প্রধান, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের কাছে জামায়াতের বিষয়ে সকাল সন্ধ্যা জানতে চাইলে তিনি অবশ্য সরাসরি কিছু বলতে চাননি।
তিনি বলেন, “বিএনপির সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা যে যুগপৎ আন্দোলনে অংশীদার হয়েছি, সেই আন্দোলনে আমরা সামনে কী পদক্ষেপ নেব, এ সমস্ত বিষয় নিয়ে (বৈঠকে) আলোচনা হয়েছে।
“বিএনপির পক্ষ থেকে আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, কী ধরনের কর্মসূচি নেওয়া যায়। আমরা সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এ কর্মসূচি গ্রহণ করব।”
১২ দলীয় জোটের পাশাপাশি অলি আহমদ নেতৃত্বাধীন এলডিপিও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে কর্মসুচির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
অলি গত শনিবার ঢাকায় দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “হাল চাষের জন্য ন্যূনতম হলেও গরু দরকার হয়। ছাগল দিয়ে চাষ হয় না। আমরা তো দেখেছি গত ১০-২০ বছরে কী অর্জিত হয়েছে। সুতরাং এখন কী প্রয়োজন (জামায়াতের দিকে ইঙ্গিত করে), সেটা আপনিও বোঝেন, আমরাও বুঝি।”
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতকে সঙ্গে রাখার কথা বলেছিলেন কি না- প্রশ্ন করা হলে অলি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সবকিছু পানির মতো পরিষ্কার। কী বলেছি, আর বিএনপিকে যা পরামর্শ দেওয়ার দিয়েছি বৈঠকে। বৈঠকের আলাপ এখানে করব না।”
জামায়াতকে নেওয়ার বিরোধিতা এসেছে গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে। সেই জোটের পক্ষ থেকে এমনও বলা হয়েছে, জামায়াতকে সঙ্গে রেখে আন্দোলন অসম্ভব।
গণতন্ত্র মঞ্চের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিএনপির নেতৃত্বে আমরা সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের অংশীদার হয়েছি। জোট ধরে রাখতে নিট অ্যান্ড ক্লিন থাকা অপরিহার্য। জামায়াতকে সঙ্গে নেওয়ার সিদ্ধান্তে গেলে জোটে বিভাজন তৈরি হবে। কারণ তাদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন এক কথায় অসম্ভব।”
বিএনপির মনে এলেও মুখে নেই
জামায়াতকে সঙ্গে রাখা, না রাখা নিয়ে বিএনপির আনুষ্ঠানিক কোনও ভাষ্য এখনও পাওয়া যাচ্ছে না।
মিত্র দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রাখার দায়িত্ব বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের কাছে জানতে চেয়ে স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই সরকারের বিরুদ্ধে আমরা যুগপৎ আন্দোলনের যাত্রা আগেই শুরু করেছি। নতুন করে বোঝাপড়া বাড়ানোর লক্ষ্যে এবং তাদের পরামর্শ জানতেই এই সিরিজ বৈঠক করা হয়েছে।
“অনেকেই তাদের মতামত জানাবে, আমরা সেগুলো পর্যালোচনা করব, গুরুত্ব সম্পর্কে জানব। হাইকমান্ডের সাথে তা নিয়ে আলোচনা করব। তারপর সিদ্ধান্ত নেব। কে আছে, কে নেই, তা এই মুহুর্তে ঘোষণা করার সময় আসেনি।”
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিরক্তির সুরে বলেন, “আবার জামায়াত! আপনারা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে তাকান। জনগণের দিকে তাকান। জানার চেষ্টা করুন, তারা কী চায়। তার পরিবর্তন চায়। আমরা জনগণের দাবির পাশে ছিলাম, এখনও আছি।”
তবে জামায়াতকে সঙ্গে রাখার পক্ষে বিএনপির অনেক নেতাই রয়েছেন বলে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা এটা নিয়ে ভাবছি। নীতি-নির্ধারকরাও এটাকে গুরুত্বের সাথে ভাবছে। লাভ-ক্ষতি হিসাব করা হচ্ছে।”
আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীদারত্বের দাবি
গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের যে প্রস্তুতি ছিল, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের পর তাতে ভাটা চলছেই বলা যায়। প্রচারপত্র বিলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ বিএনপির কর্মসূচি।
নির্বাচনের পর ১২ ও ১৩ জানুয়ারি যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির হাইকমান্ডের ভার্চুয়ালি সিরিজ বৈঠক হয়। তা শেষ হয় ১৮ মে এলডিপির সঙ্গে বৈঠক দিয়ে।
এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যুগপৎ আন্দোলনকে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করতেই এই আলোচনায় বসেছি। খুব শিগগিরই আমরা নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামব।”
লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মো. ফারুক রহমানও একই ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, “ঈদের আগে আরেক দফায় বৈঠক হবে। ঈদের পরই যুগপৎ আন্দোলন শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
এদিকে গণতন্ত্র মঞ্চ বৈঠকে আন্দোলনে শরিক হওয়ার শর্ত হিসেবে বিএনপির কাছে দুটি বিষয়ের নিশ্চয়তা চেয়েছে।
মঞ্চের এক শীর্ষ নেতা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভবিষ্যতে যে আন্দোলনে আমরা সঙ্গী হব, সেই আন্দোলনের কর্মসূচির বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তা যেন গণতান্ত্রিক হয়। আর দুই পক্ষের লিয়াজোঁ কমিটিকেই যেন ক্ষমতায়ন ও শক্তিশালী করা হয়।”
মঞ্চের দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যে কোনও বড় আন্দোলনে লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয় খবই গুরুত্বপুর্ণ। কারণ কোনও সিদ্ধান্ত ভুল হলে তা শোধরানোর সুযোগ তো নেই। আগে-পরে আমরা নানাভাবে সেই ভুলগুলো থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। এই ভুল আর করা যাবে না।”