শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সম্পাদিত সব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি জানিয়েছে বিএনপি।
বৃহস্পতিবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির পক্ষ থেকে এই দাবি তুলে ধরেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
‘গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লুটপাট ও পাচার’ শীর্ষক বিশ্লেষণ তুলে ধরতেই এই সংবাদ সম্মেলন ডাকেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ খাতে যে ম্যাজিক দেখাতে চেয়েছিল, ম্যাজিক করতে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পকেট কেটে নিয়ে গেছে। এখানে আপনারা প্রত্যেকে বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করেন, সবাই ভুক্তভোগী। আসলে তারা (আওয়ামী লীগ) এটা (বিদ্যুৎ) একটা ব্যবসার খাত বানিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, এই খাত থেকে কুইক মানি বানানো যায় কোনও হিসাব না দিয়ে। কারণ, বিদ্যুৎ তো ‘হাওয়া’, এটি দেখা যায় না।
“ক্যাপাসিটি চার্জ- এই ক্যাপাসিটি চার্জে কোন মেশিনে কত ক্যাপাসিটি? কে এটাকে আইডেন্টিফাই করেছে এবং সেই মেশিনগুলো এফিসিয়েন্সি কি- এগুলো কেউ বিশ্লেষণ করেও না, দেখেও না। এই ক্যাপাসিটির নামে তারা ১৫ বছরে অনেক টাকা নিয়ে গেছে। প্রায় এক লাখ কোটি টাকা নিয়ে চলে গেছে।”
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি করব যে, বিদ্যুৎ খাতের প্রত্যেকটা চুক্তি তারা (আওয়ামী লীগ) তো কোনও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল মানে নাই, তারা আইন করে নিয়মনীতি বন্ধ করে দিয়ে ইচ্ছামতো ক্লোজ টেন্ডারে এসব চুক্তি করেছে। জনগণের অধিকার আছে এসব বিষয় জানার।
“উই মাস্ট সি দ্য কন্ট্রাক্ট। তারা কীভাবে কন্ট্রাক্টগুলো করেছে- এটা পাবলিক হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম কাজ হলো জনগণের কাছে এই কন্ট্রাক্টগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া। প্রত্যেকটা চুক্তি সুড বি পাবলিক, জনসমক্ষে প্রকাশ করা।”
বিদ্যু খাতের দুর্নীতি-লুটপাট
দুর্নীতির পরিসংখ্যান তুলে ধরে টুকু বলেন, “বিদ্যুৎ খাতে ১৫ বছরে মোট খরচ হলো ২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার; বর্তমান বিনিময় হারে তা হলো ৩ লক্ষ ৩৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জে লুটপাট হয়েছে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা।
“২০০৮-০৯ অর্থবছরে হয়েছে ১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং ২০২২-২৩ এ হয়েছে ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। তার অর্থ হলো- এই যে প্রাইভেট সেক্টরে পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো দিয়েছে সেগুলো চলে নাই এবং এই টাকাগুলো তাদেরকে (কোম্পানি) প্রেমেন্ট করেছে। এভাবে দেশের মানুষের কাছ থেকে জাস্ট লুট করে নেয়ে গেছে আরকি।”
সাবেক বিদ্যু প্রতিমন্ত্রী টুকু বলেন, “ক্যাপাসিটি চার্জ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগের মেশিনগুলো খারাপ। খারাপ মেশিন এসে টাকা কামাই করে চলে গেছে।
“আর এই লুটপাটের অংশে কারা কারা ছিল? ক্যাপাসিটি চার্জের শীর্ষ পাঁচ কোম্পানির কথা আমি বলছি। এরা হলো- সামিট নিয়েছে ১০ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা, অ্যাগ্রো ইন্টারন্যাশনাল নিয়েছে ৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা, আল্ট্রা পাওয়ার হোল্ডিংস নিয়েছে ৭ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা, ইউনাইটেড গ্রুপ নিয়েছে ৬ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা, আরপিসিএল নিয়েছে ৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।”
তিনি বলেন, “কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট আসে সাধারণত আপদকালীন বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের জন্য। এই প্ল্যান্ট দু্ই বছরের, সেটা ১৫ বছর পর্যন্ত চালাচ্ছে এবং এসব কুইক রেন্টালে ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে উইথ আউট রিটার্ন। বোঝেন কী অবস্থা।
“ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির নামে ৯ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা।”
সব কিছু রিভিউ করা হবে
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, আমরা পুরো বিষয়গুলো রিভিউ করব। এগুলো করে যেটা প্রয়োজনীয় সেটা আমরা করব।”
টুকু বলেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে রিভিউ মানে বাতিল না। আমরা দেখব যে, কোন কোন জায়গায় দুর্বলতা ছিল।”
যেকোনো সময় মুখ থুবড়ে পড়বে
সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুতে যেসব উন্নয়ন করা হয়েছে, এই বিদ্যুৎ উন্নয়ন টেকসই না, সাসটেইনেবল না। যেকোনো সময়ে মুখ থুবড়ে পড়বে।
“বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির ধরণ দেখার পর বোঝা যায় যে, তারা বিদ্যুৎ খাতকে ফোকলা করে দিয়েছে, কিছু নাই আরকি। একটা উদাহরণ বলি, প্রতি মিটারের জন্য গড়ে অতিরিক্ত খরচ করেছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা, ক্রয় করেছে ৬ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে।
তাহলে দেখা যায়, অতিরিক্ত এক হাজার ৭২০ টাকা প্রতি মিটারে… তাহলে দেখেন কত টাকা নিয়ে বোঝেন তারা এবং এনআইসি কার্ডের দাম ২ হাজার টাকা, তারা ধরেছে ৫ হাজার ২১৫ টাকা। এভাবে দেখবেন, এই খাতের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি। কোনও দুর্নীতির শেষ নাই।”
টুকু বলেন, “উনারা তো বিল পেমেন্ট করছেন। আমি যতটুকু জানি বকেয়া বেশি নাই। সবই তো পেমেন্ট করছে এই সরকার এসে। কিন্তু আলটিমেটলি ২০২৭ সালে এসে ধরা খাবে।
“আমরা মনে করি, এখন যদি আমরা টাইট না করি, তাহলে ২০২৭ সালে আমরা বিপদে পড়ে যাব। ফরেন এক্সচেঞ্জ ঘাটতি হয়ে যাবে। টাকা ছাপানো হবে। এতে ইনফ্লুয়েশন বাড়বে। বুঝতেই পারি কী হবে?”
রূপপুর প্রকল্পের দুর্নীতি
টুকু বলেন, “রূপপুরে পারমাণবিক প্রকল্পের ৫০০ বিলিয়ন ডলার তারা (শেখ হাসিনাসহ তার পরিবার) নিয়ে গেছে। সেটা নিয়ে আরও তদন্ত হচ্ছে লন্ডনে টিউলিপের (যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক) ব্যাপারে এবং আরও দুর্নীতি আছে আরকি।”
প্রিপেইড মিটার বাণিজ্যে সিন্ডিকেট
টুকু বলেন, “এটা তাদের একটা সিন্ডিকেট। ৭১ লক্ষ ২০ হাজার গ্রাহকের কাছে তারা মিটার পৌঁছাবে এবং সেখানে বিরাট অঙ্কের একটা দুর্নীতি- প্রায় ৩৬ কোটি টাকা পাচার করেছে। ১ হাজার ২৩৫ কোটি অতিরিক্ত খরচ করেছে; এর মধ্যে দুর্নীতি করেছে ৬১৭ কোটি টাকা। মিটার সরবারহ ও স্থাপন, বাস্তবায়নে ছিল ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা; সেটা ১২ হাজার কোটি টাকা করেছে।
“স্মার্ট প্রিপেইড মিটার প্রকল্প- এটার যে নেটওয়ার্ক তৈরি করছে… এই নেটওয়ার্কটা হচ্ছে কিছু ব্যক্তির নেটওয়ার্ক। যেখানে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় স্বজনরা আছে, তাতে তারা কোটি কোটি টাকা লাভবান হবে এই প্রকল্পে।”
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুক অভিযোগ করেন, তরলীকৃত প্রাকিৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি করেছে সাবেক বিদ্যু প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর কোম্পানিসহ একটি চক্র।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রতিরোধে এই খাতে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানো, দুর্নীতি রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন, বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, নিয়মিত বিদ্যুৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।