খুন, গুমসহ অতীতের বিভিন্ন অভিযোগে দেশে-বিদেশে দুর্নাম ছড়ানোয় র্যাব বিলুপ্তির দাবি তুলেছে বিএনপি, যাদের আমলেই এই বাহিনী গঠন করা হয়েছিল।
বিএনপি গঠিত পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক হাফিজ উদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার গুলশানে দলটির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ-সংক্রান্ত সুপারিশ তুলে ধরেন। সেখানে তিনি জনবান্ধব-মানবিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে ‘পুলিশ কমিশন’ গঠনের কথাও বলেন।
যেভাবে গঠিত হয় র্যাব
পুলিশের একটি ইউনিট হিসাবে র্যাব গঠন করা হয় ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে। ২০০১ সালে ওই সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর সন্ত্রাস দমনে প্রথমে সেনাবাহিনীকে দিয়ে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচালনা করা হয়েছিল। সেই অভিযানে অনেক মৃত্যু ব্যাপক সমালোচনা তৈরি করেছিল।
এরপর ২০০৩ সালে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বাদ দিয়ে পুলিশের মধ্যে একটি ইউনিট গঠন করা হয়, নাম দেওয়া হয় ‘র্যাপিড অ্যাকশন টিম- র্যাট’। কিন্তু এর নামের সংক্ষিপ্ত রূপ র্যাট বা ইঁদুর নিয়ে হাস্যরস হলে সরকার পরিকল্পনা বদলায়।
এরপর গঠন করা হয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব। এটি পুলিশের অধীন হলেও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদেরও এতে যুক্ত করা হয়।
র্যাব গঠনের পর থেকে ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটি পরিচিত হয়ে ওঠে। নানা অভিযানে সন্দেহভাজন অপরাধীর মৃত্যুর খবর র্যাব পরিবেশিত করত এভাবে- অভিযানে গেলে ওঁৎ পেতে থাকা অপরাধীরা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধের পর অপরাধীরা পালিয়ে গেলে একজনের লাশ পাওয়া যায়।
প্রায় সবগুলো ঘটনার একই বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছিল কিছুদিন পরই; এমন অনেক ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, র্যাব সদস্যরা গুলি চালিয়ে হত্যার পর তাকে ক্রসফায়ার বলেছিল।
আবার নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মতো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও র্যাব কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা বেরিয়ে আসে।
২০২২ সালে সেন্টার ফর গভর্ন্যাস স্টাডিজ (সিজিএস) জানায়, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলোয় র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। ৭১টি গুমের ঘটনার মধ্যে ২১টি অভিযোগ ছিল র্যাবের বিরুদ্ধে, যা শতকরা হারে ৪০ দশমিক ৩৮।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে র্যাবকে সহায়তা দিয়ে এলেও বিস্তর অভিযোগের পর গুরুতর মানবাধিকার লংঘনে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২১ সালে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
দেশটির অর্থ দপ্তরের সেই নিষেধাজ্ঞা র্যাবের সঙ্গে বাহিনীর সাবেক-বর্তমান (ওই সময়কার) সাতজন কর্মকর্তার ওপরও আসে। তারা হলেন- বাহিনীর সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ, তৎকালীন প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক তোফায়েল মুস্তাফা সরওয়ার, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান ও র্যাব-৭ এর সাবেক কর্মকর্তা মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী।
নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তর বলেছিল, র্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ৬০০’রও বেশি লোকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী।
সেই নিষেধাজ্ঞা তুলতে আওয়ামী লীগ সরকার বার বার আহ্বান জানালেও তাতে কাজ হয়নি।
র্যাব বিলুপ্ত চায় বিএনপি
র্যাবকে সংস্কার না করে কেন বিলুপ্তির দাবি করা হচ্ছে—এ প্রশ্ন করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “এটা মেডিকেল বিদ্যাতেও আছে যখন একেবারে গ্যাংরিন (দেহে পচনশীল ক্ষত) হয়ে নষ্ট হয়ে যায়, তখন কেটে ফেলা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না।
“সেজন্য আমরা মনে করেছি, র্যাব বাহিনী আন্তর্জাতিকভাবেই এমনভাবে নিন্দনীয় হয়েছে, আর দেশের মধ্যে তো র্যাব মানেই একটা দানব সৃষ্টি করেছে তারা (আওয়ামী লীগ); যত ধরনের খুন-গুম, যত এক্সট্টা জুডিশিয়াল কিলিং অধিকাংশই এই র্যাব বাহিনীর মাধ্যমে হয়েছে। সেজন্য আমরা এটিকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছি। র্যাব বিলুপ্ত হলে র্যাবের দায়িত্ব আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ান এবং থানা পুলিশ যেন পালন করতে পরে সেলক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
“তবে র্যাব যে ধরনের কাজ করে- যদি সামাজিক কোনও কাজে তাদের ব্যবহার করা হয়, আমাদের বর্তমানে আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ান আছে, এছাড়া আমরা অন্য স্পেশালাইজড ফোর্স গঠন করতে পারব তাদের টেনিং দিয়ে।”
“এই মুহূর্তে যদি র্যাবকে বিলুপ্ত করে, জনগণের কাছে একটা ভালো সিগন্যাল যাবে বলে আমরা মনে করছি” বলেন মেজর (অব.) হাফিজ।
‘পুলিশ কমিশন’ গঠন
হাফিজ আহমেদ বলেন, “পুলিশকে বাদ দিয়ে কোনও রাষ্ট্র বা সমাজ কল্পনা করা কাম্য নয়। অতএব প্রায় গণশত্রুতে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও এই বাহিনীকে ছেঁটে ফেলার কোনও সুযোগ নাই। এটিকে আবার সংশোধন করে দাঁড় করাতে হবে। রাষ্ট্রের এই অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিসের সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
“বাংলাদেশকে পতিত সরকারের আমলে একটা পুলিশ স্টেটে পরিণত করা হয়েছিল। এই পুলিশ স্টেটের আওতা থেকে বের করে এই পুলিশ বাহিনী যাতে জনগণের প্রতি সংবেদনশীল হয়, জনগণকে মান্য করে। তাদের মগজে যেন এই ধারণাটি প্রথিত হয় যে, দেশের মালিক জনগণ, তারা জনগণের প্রভু নয় সেবক—এই ধারণাটি তাদের মধ্যে প্রবিষ্ট করার জন্যে আমরা বিভিন্ন সুপারিশ করেছি। এর একটি হলো তাদের (পুলিশ) ক্লোজড মনিটরিং করার জন্য পুলিশ কমিশন থাকবে; এই কমিশন ওয়াচডগ হিসেবে কাজ করবে।”
“উপজেলা পর্যায়ে নাগরিক কমিটি থাকবে, সেখানে স্থানীয় জনগণ মিলে পুলিশের কর্মকাণ্ডকে দেখবে এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে। সর্বশেষে গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি ইউনিয়নে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের জন্য আমরা সুপারিশ করেছি।”
হাফিজ বলেন, “পুলিশ বাহিনীর এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে সুপারিশমালা তৈরি করা হয়েছে। আশা করা যায়, এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে পুলিশ বিভাগের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নানাবিধ অসঙ্গতি ও অনিয়ম দূর হয়ে যাবে।”
সংস্কারের মাধ্যমে পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে এবং প্রত্যাশিত সেবা পাওয়া সহজতর হবে বলে উল্লেখ করেন বিএনপির এই নেতা।
তিনি বলেন, “পুলিশ বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতপূর্বক মানবাধিকারের প্রতি আরও সচেতন করা এবং দুর্নীতিমুক্ত দক্ষ করে এই বাহিনীকে গড়ে তোলার জন্য আমরা বিভিন্ন সুপারিশমালা তৈরি করেছি, যা পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনকেও দিয়েছে। শুধুমাত্র উন্নতর সার্ভিস প্রাপ্তির জন্য নয়, ভবিষ্যতে বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক নিষ্ঠুর আচরণের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই লক্ষ্যে পুলিশ বিভাগের সংস্কার জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে।”
পুলিশ কমিশনের কার্যপরিধি
গত ৫ ডিসেম্বর অন্তবর্তীকালীন সরকারের গঠিত পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেনের কাছে বিএনপির সংস্কার প্রস্তাবনা জমা দেয় বিএনপি।
পুলিশ কমিশনের কার্যপরিধি কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন সংসদ থাকলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান। সংসদ না থাকলে অন্তবর্তীকালীন সময়ের জন্য কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক।
৮ সদস্যের এই কমিশনে সরকার দলীয সংসদ সদস্য, বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উচ্চ আদালতের আইনজীবী, সমাজের বিশিষ্ট নাগরিক এবং স্বরাষ্ট্র সচিবের মনোনীত অতিরিক্ত সচিব। আইজিপির মনোনীত একজন অতিরিক্ত আইজি এই কমিশনের সদস্য সচিব হিসাবে কাজ করবেন।
সরকার বিধি-বিধান দ্বারা এই কমিশনের সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি, কাজের পরিধি ও কর্মকাল নির্ধারণ করবেন।
নাগরিক কমিটি
নাগরিক কমিটি স্থানীয় পর্যায়ে পুলিশকে অপরাধ দমনে সহায়তা প্রদান, জনসাধারণ পুলিশ সম্পর্ক উন্নয়নে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পরামর্শ প্রদানের জন্য প্রতিটি উপজেলাথানায় এই নাগরিক কমিটি গঠন করা হবে। স্থানীয় গণ্যমান্য, সুশিক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠিত হবে।
কমিটির সভাপতি হবেন একজন স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি। সদস্য সচিব হবেন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এছাড়া ২ জন ইউপি সদস্য, ১ জন শিক্ষক, ১ জন ব্যবসায়ী, ১ জন পেশ ইমাম এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রতিনিধি কমিটির সদস্য হিসাবে থাকবেন। সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শ করে ২ বছর সময়কালের জন্য এই নাগরিক কমিটি কাজ করবেন।
কমিউনিটি পুলিশিংয়ের উদ্দেশ্য হলো জনগণের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অপরাধ দমন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সামাজিক সমস্যাদি সমাধানে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে সমাজে বিবিধ অপরাধ প্রবণতা এবং সামাজিক অস্থিরতা কমবে, পুলিশ-জনসাধারণের মধ্যে দূরত্ব হ্রাস পাবে, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করবে এবং আইনের শাসন জোরাল হবে।
গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি ইউনিয়নে এবং শহরাঞ্চলে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ১ জন অবসরপ্রাপ্ত কম্যুনিটি পুলিশ অফিসার (সাব-ইন্সপেক্টর পদের নিম্নে নয়) নিয়োজিত হবেন। সংশ্লিষ্ট এলাকায় তার একটি অস্থায়ী দপ্তর থাকবে। পুলিশ অফিসার নিয়মিতভাবে এলাকার গণপ্রতিনিধি, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, ইমাম, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, মহিলা সমাজ, কৃষক ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সংগে নিয়মিত বৈঠক করবেন।
কমিউনিটি পুলিশ অফিসারের বেতন-ভাতা সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ বহন করবে।
প্রতিবছর পুলিশ সদস্যদের সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল এবং প্রতি জেলায় পূর্ণাঙ্গ পুলিশ হাসপাতাল এবং বিভাগ ও মেট্রোপলিট শহরে ঢাকার রাজারবাগ কেন্দ্রীয় হাসপাতালের মতো পুলিশ হাসপাতাল নির্মাণের সুপারিশ করেছে বিএনপি।
সংবাদ সম্মেলনে সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব এসএম জহিরুল ইসলাম, সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম, আশরাফুল হুদা, সাবেক উধর্তন কর্মকর্তা সা্ঈদ হাসান খান ও আনসার উদ্দিন খান পাঠান উপস্থিত ছিলেন।