কোরবানির ঈদের ছুটিতে দেশের সড়কগুলোয় প্রাণ গেছে ৪৫৮ জনের। তবে রেল ও নৌপথ দুর্ঘটনা হিসাব করলে এই সংখ্যা হবে ৪৮৮ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ১ হাজার ৮৫০ জন; এর মধ্যে সড়কে আহতের সংখ্যা ১ হাজার ৮৪০ জন।
বুধবার ঢাকায় বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ পরিসংখ্যান জানায় বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ-২০২৪ প্রকাশ করে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক জানান, ঈদযাত্রা শুরু হিসেবে ১০ জুন তারিখকে ধরা হয়েছে। ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরার সবশেষ দিন ধরা হয়েছে ২৪ জুন। সে হিসেবে এই ১৫ দিনে দেশের সংবাদপত্রগুলোয় প্রকাশিত খবরের সন্নিবেশ করে দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বের করা হয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) ও বিশ্বব্যাংকের তথ্যও যুক্ত করা হয়েছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মনিটরিং সেলের পর্যবেক্ষণ বলছে, গত বছরের কোরবানির ঈদের ছুটির চেয়ে এবার মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এবারে ঈদযাত্রায় ৩০৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন নিহত ও ৭৬২ জন আহত হয়েছে। অন্যদিকে, পঙ্গু হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী ঈদের আগে পরে ১৪ দিনে ১ হাজার ৭৮ জন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী ভতি হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীর ১৫ শতাংশ হাসপাতালে অথবা বাসায় চিকিংসারত অবস্থায় মারা যায়। সেই হিসেবে সব মিলিয়ে এবারের ঈদে ৪৫৮ জন নিহত ও ১ হাজার ৮৪০ জন আহত হয়েছে।
২০২৩ সালের এই ঈদযাত্রায় ২৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত ও ৫৪৪ জন আহত হয়েছিল।
যার সঙ্গে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ, প্রাণহানী ৫৩ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং আহত ২৩৮ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়েছে।
এছাড়া, এবার রেলপথে ২২টি দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও চার জন আহত হয়েছেন। নৌ-পথে ছয়টি দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত, ছয় জন আহত ও ছয় জন নিখোঁজ রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে যাত্রী কল্যাণের পক্ষ থেকে বলা হয়, এবারের ঈদে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও পরিবহন ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫-২০ শতাংশ মানুষ কম যাতায়াত করেছে। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোর অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভাল ছিল। ঈদের আগে তিন দিন সরকারি ছুটি থাকায় যাত্রীর চাপ কিছুটা ভাগ হয়েছে।
দেশে ঈদযাত্রায় মোট যাতায়াতের প্রায় ৭ থেকে ৯ শতাংশ মোটরসাইকেলে যাতায়াত হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার তৎপরতা ছিল লক্ষ্যনীয়। তবুও ছোট ছোট যানবাহন বিশেষ করে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা ব্যাপকহারে বাড়ার কারণে, এসব যানবাহন হঠাৎ করে জাতীয় মহাসড়কে উঠে যাওয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়াও সড়কে চাঁদাবাজি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল, পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহনসহ নানা কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে। একই সঙ্গে সড়কে ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে নিম্ন আয়ের লোকজন ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও খোলা ট্রাকে যাতায়াতে বাধ্য হয়েছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়।
দেশে প্রায় ৯ হাজার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে জানিয়ে এসব হাসপাতালে ঈদের আগে-পরে ১৫ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত কতজন রোগী ভর্তি হয়েছে সেই তথ্য জানাতে বিআরটিএ’র কাছে দাবিও জানায় যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
সংগঠনটির প্রতিবেদন অনুযায়ী দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ১৩২ মোটরসাইকেল দুঘটনায় ১৩০ জন নিহত, আহত হয়েছে ৫৯৯ জন । যা মোট দুর্ঘটনার ৪২ দশমিক ৭১ শতাংশ, মোট নিহতের ২৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং মোট আহতের ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
নিহতদের মধ্যে ৫১ জন চালক, ১১ জন পরিবহন শ্রমিক, ৪৮ জন পথচারী, ৬১ জন নারী, ২৪ জন শিশু, ১৪ জন শিক্ষার্থী, এক জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, তিন জন শিক্ষক, দুজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তিন নেতাকর্মীর পরিচয় মিলেছে।
সংগঠিত দুর্ঘটনার ২৫ দশমিত ২৪ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৫১ দশমিক ১৩ শতাংশ গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা, ২১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায়, শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ ট্রেনের সঙ্গে যানবাহনের সংঘর্ষের ঘটনা, চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং ১ দশমিক ৬১ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে দুর্ঘটনা হয়েছে।
মোট দুর্ঘটনার ৪০ দশমিক ১২ শতাংশই ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে। ২২ দশমিক ৯৭ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ৩১ দশমিক ৩৯ শতাংশ ফিডার রোডে ঘটেছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “সরকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদাসীন, তাই ছোট যানবাহন বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। গণমাধ্যমে এখন সংঘঠিত দুর্ঘটনার সঠিক চিত্র আসে না। এবারের ঈদে আমরা গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে সারাদেশের হতাহতের সংখ্যা পেয়েছি মাত্র ১ হাজার ৯৮ জন। অথচ ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ১৪ দিনে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৭৮ জন। সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি ৯ হাজার হাসপাতালে চিত্র অনেক ভয়াবহ।
নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হলেও কেন সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না, সে ব্যাপারে সরকারিভাবে অডিট হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, সংগঠনের সহ-সভাপতি তাওহীদুল হক লিটন, যুগ্ম মহাসচিব মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল, সমাজকর্মী মোহাম্মদ মহসিনসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ঈদে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সাতটি কারণের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
এর মধ্যে রয়েছে, জাতীয় মহাসড়কে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চলাচলের নিষেধাজ্ঞা অমান্য। সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ইজিবাইক ও অটোরিকশার অবাধ চলাচল। অতিরিক্ত গতি, মহাসড়কের নির্মাণত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতার মতো কারণ।
এছাড়া উল্টোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাদাঁবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন, অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, দ্রুতগতির বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধীরগতির পশুবাহী ট্রাক-পিকআপ চলাচল ও সড়কের পাশে পশুরহাটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিরোধে আটটি সুপারিশও করেছে সংগঠনটি।
যেখানে মোটরসাইকেল, অটোরিক্সা, ইজিবাইকের মত ছোট ছোট যানবাহন আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা, দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া, ডিজিটাল পদ্ধতিতে যানবাহনের ফিটনেস দেওয়া, গতি ভেদে যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়েছে।