এ যেন গ্ল্যাডিয়েটর সিনেমায় দেখা দৃশ্য! মাঠের মাঝখানে প্রস্তুত লড়াইয়ের মঞ্চ। তা দেখতে গ্যালারি উপচে পড়ছে জনতা।
বনানীর কামাল আতাতুর্ক পার্কের মাঝখানে বসানো বক্সিং রিং দেখে তেমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। বিশাল আকারের রিংয়ের চারপাশে সারি সারি চেয়ারে বসা দর্শক। স্থানীয়রা তো ছিলই। ছিলেন ঢাকায় বসবাসরত কূটনৈতিক পাড়ার বিদেশিরাও।
দুই স্তরের নিরাপত্তা বেস্টনী পেরিয়ে তবেই ঢোকা সম্ভব হলো পার্কে। যেখানে শনিবার রাতে অনুষ্ঠিত হয়েছে পেশাদার আন্তর্জাতিক বক্সিং প্রতিযোগিতা- ‘পাথ টু গ্লোরি হাসোল ইন ঢাকা স্কয়ার।’
রঙিন আলোর রোশনাইয়ে রীতিমতো আলোকিত পুরো এলাকা। কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা হয়েছে পার্কের রেলিং। মাঠের এদিক ওদিক বসানো অস্থায়ী ড্রিঙ্কস বুথ। পার্কের ফেন্সিং দেওয়ালে সাঁটা বক্সারদের ছবি সংবলিত ডিজিটাল পোস্টার।
উঁচু ভলিউমে বাজতে থাকা রক গানের তালে তালে রিংয়ে ঢুকছেন একেক জন বক্সার। টেলিভিশনের পর্দায় রেসলিং শোয়ে যেমনটা দেখা যায়! সেভাবেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে রেসলারদের। মুখোমুখি দাঁড়ানো দুই বক্সারের প্রোফাইল ঠিঁকুজি বৈচিত্র্যময় ইংলিশ উচ্চারণে জানিয়ে দিচ্ছিলেন সঞ্চালক।
মাঠের এক পাশে বসানো দৈত্য পর্দায় প্রতিটি বক্সারের মুভমেন্ট দেখানো হচ্ছিল। বসন্তের রাতে বক্সিং উপভোগ করাতে আয়োজকদের চেষ্টায় যে কোনও কমতি ছিল না, তা বোঝাই যাচ্ছিল। মাঠ লাগোয়া অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দাগুলোতেও কৌতুহলী দর্শকের চোখ। বারান্দায় চেয়ার পেতে অনেকে উপভোগও করেছেন বক্সিং।
প্রতিটি লড়াই শুরুর আগে বেজেছে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। বেজেছে প্রতিপক্ষ বক্সারের নির্দিষ্ট দেশের জাতীয় সঙ্গীতও। এক রাউন্ড শেষ হতেই পরের রাউন্ডের সংখ্যা উল্লেখ করা বোর্ড মাথার ওপর তুলে রিংয়ের চারপাশ ঘুরেছেন লাস্যময়ী তরুণী।
একেক জনের লড়াই শেষে মঞ্চে উঠে আসেন একদল নৃত্যশিল্পী। কখনও ডিজের তালে নেচে দর্শকদের আনন্দ দিয়েছেন এই তরুণীরা। কখনও বাংলার লোকসঙ্গীতের সঙ্গে কোমর দুলিয়েছেন।
পল্টনের নোংরা পরিবেশের অ্যামেচার বক্সিং ফেডারেশন থেকে অলিম্পিকের অন্যতম আকর্ষণীয় খেলাটাকে বাইরে বের করে এনেছেন বাংলাদেশ প্রো বক্সিং ফাউন্ডেশনের সভাপতি আদনান হারুন।
যে খেলাটা এতদিন ছিল খোলস বন্দী। যে খেলাটা শুধু বিভিন্ন সার্ভিসেস সংস্থার বক্সারদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। যারা একটা চাকরির আশায় দিনের পর দিন শুধুই বক্সিং খেলেছেন। সেই বক্সিং এখন পেশাদারিত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মোড়কে। রঙিন আয়োজনে। খেলাকে পেশা হিসেবে নিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন দেশের হাজারো বক্সার।
সুর কৃষ্ণ চাকমা, আল আমিনদের দেখানো পথে হেটে বক্সিং রিংয়ে নেমেছেন মোহাম্মদ ইয়াসিন, রাকিব আহমেদ, শাহরিয়ার শান্ত, আমরানুল ফয়সাল, ইমন তংচঙ্গৈরা।
আদনান হারুনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা বনানীতে। নিজের পাড়ায় বক্সিং টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পেরে খুশি তিনি, “ফুটবল তো প্রতিনিয়ত খেলা যায়। ব্যাডমিন্টনও একটা নির্দিষ্ট সিজনে খেলে। বাংলাদেশে এটার কালচার আছে। কিন্তু বক্সিং তো আমাদের কালচারে নেই। উন্মুক্ত স্থানে প্রচন্ড শীতে আয়োজন করা যায় না। ফেব্রুয়ারি মাসে এটা খেলার সুযোগ থাকে। সেই চিন্তা করেই আমরা এই পার্কে আয়োজন করেছি।”
এর আগে পাঁচ তারকা হোটেলে তিনি আয়োজন করেন প্রো বক্সিং। এবার উন্মুক্ত মঞ্চে আয়োজনের কারণটা ব্যাখ্যা করলেন, “ইন্টারকন্টিনেন্টালে আগে দুটো ইভেন্ট করলাম। ওখানে তো অনেক সীমাবদ্ধতা। আমজনতার কাছে বক্সিংটা তুলে ধরতে পারি না। যেহেতু এখানেই আমার জন্ম। বেড়ে ওঠা। মনের খোরাক মেটাতে বলতে পারেন এই আয়োজন। প্রথমবারের মত এখানে বক্সিংয়ের আয়োজন করতে পেরে খুব ভালো লাগছে।”
জানালেন প্রচুর সাড়া মিলেছে দর্শকদের, “ প্রচুর সাড়াও পাচ্ছি। বনানী সোসাইটি থেকে শুরু করে প্রশাসনের লোকসহ বৃদ্ধ এমনকি শিশুরাও খেলা দেখতে এসেছে। এখানকার বিদেশিরাও উপভোগ করছে বক্সিং।”
কথাটা মোটেও ভুল বলেননি তিনি। প্রথমবারের মতো বক্সিং দেখতে এসে রোমাঞ্চিত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক মেগান। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের এই নারী কর্মকর্তা বলছিলেন, “সত্যি বলতে আমি কখনোই বক্সিং খেলা দেখিনি। এখানে এসে এত মানুষের ভীড়ে বক্সিংটা দারুণ উপভোগ করছি।”
তৃণমূল থেকে সেভাবে বক্সার উঠে আসছে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নেই সাফল্য। সেই ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন বক্সার মোশাররফ হোসেন। এশিয়াডে একক ইভেন্টে বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তিগত পদকও সেটিই।
এসএ গেমসেও বক্সিংয়ে সাফল্যখরা ১৪ বছর ধরে। ২০১০ এসএ গেমসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত গেমসে বক্সিংয়ের লাইটওয়েট ওভার ৫৭ কেজিতে সোনা জিতেছিলেন জুয়েল আহমেদ জনি। লাইট ওয়েল্টারওয়েট ওভার ৬০ কেজিতে সোনা জেতেন আবদুর রহিম।
সেই স্মৃতি রোমন্থন করেই দিন কাটে এদেশের বক্সারদের। নিয়মিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলারও সুযোগ পায় না। এসব বক্সারদের জন্য এমন পেশাদার টুর্নামেন্টের আয়োজন তাই বসন্ত বাতাসের ছোঁয়া।