রাশিয়ার কাজান শহরে পর্দা উঠছে ১৬তম BRICS সম্মেলনের। ২২ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছে বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিশীল শীর্ষ ১০টি দেশ।
২০০৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে বিশ্বের ৪টি রাষ্ট্রের— ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন—পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে একটি সাইড লাইন বৈঠকে মিলিত হন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ২০০৯ থেকে প্রতি বছর দেশগুলোর আনুষ্ঠানিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ২০০৯-এর ১৬ জুন রাশিয়ার ইয়েকাতেরিনবার্গে উক্ত ৪টি রাষ্ট্রের একটি পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতে এভাবেই ৪টি রাষ্ট্রের নামের আদ্যাক্ষরের সামষ্টিক রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে BRIC। পরবর্তীকালে ২০১০-এ দক্ষিণ আফ্রিকা যুক্ত হলে নামকরণ হয় BRICS।
গতবছর BRICS-এর ১৫তম সম্মেলনে যুক্ত হয়েছে মিশর, ইথিওপিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান ও আর্জেন্টিনা। পরে আর্জেন্টিনার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই ঘোষণা করেন তার দেশ এই সংস্থায় যোগ দেবে না। এর ফলে, ২০২৪-এর জানুয়ারি থেকে আর্জেন্টিনা বাদে অন্য ৫টি রাষ্ট্র যুক্ত হলে নামকরণ হয় BRICS+। এর মধ্যেই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে আবেদন করেছে আরও ৩৪টি রাষ্ট্র। যা এখন বিবেচনাধীন।
BRICS মূলত রাষ্ট্রসমূহের স্বেচ্ছাভিত্তিক মিতালী। সংস্থাটি ইতোমধ্যে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক সমর্থক এবং সমমনা রাষ্ট্রগুলোকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই আকর্ষণের উৎস কোথায় নিহিত?
স্নায়ুযুদ্ধের কালপর্ব থেকে অদ্যাবধি বিশ্বের অনেক দেশ এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে একেবারে বিধ্বস্ত ও ক্লান্ত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনৈতিকভাবে পুরো বিশ্বে একক আধিপত্য বিস্তার ও একচেটিয়াত্ব বজায় রাখতে অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদকে ক্রমাগত উৎসাহিত করে চলেছে; ডলারে লেনদেন করতে বাধ্য করছে; তাদের নির্দেশনা না মানলে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ নানারকম আর্থিক বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিচ্ছে। এহেন চরম নেতিবাচক বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে BRICS। BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো এসব নেতিবাচকতা নাকচ করতে এর বিপরীতে একের পর এক ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো নিজদেরসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে বহুপাক্ষিকতার ভিত্তিতে নানামুখী সাহায্য-সহায়তা করার জন্য অবাধ প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করছে; কোনোরকম পূর্বশর্ত আরোপ না করে মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়ম-কানুন অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে।
এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল ডিয়াজ-ক্যানেল বলেছিলেন, ‘‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো বহুমেরুকরণ এবং বহুপক্ষবাদ রক্ষা করে, BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো স্নায়ুযুদ্ধের ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং বিশ্বের জন্য প্রয়োজনীয় আরও ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করছে।’’
বিংশ শতাব্দীর ২য় মহাযুদ্ধোত্তর কালপর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর গর্ভে জন্ম নেওয়া একবিংশ শতক, উদ্ভবের প্রথম লগ্নেই যে প্রধান চিন্তা মানব জাতির সামনে উপস্থিত করেছে তা হলো-
১. বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান
২. রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্তভাবে অর্থনীতির শান্তিপূর্ণ বিকাশ।
অন্যদিকে, বিংশ শতাব্দীর শেষ ও একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভকালের যেসব অন্তর্গত তাগিদে BRICS-এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, সংক্ষেপে তা হচ্ছে—
১. সার্বভৌম সমতা
২. উন্নয়নের নির্বাচিত পথের প্রতি সম্মান প্রদর্শন
৩. পারস্পরিক স্বার্থের বিবেচনা
৪. সংরক্ষণবাদের বিপরীতে অবাধ প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ততা
৫. পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ঐকমত্য
৬. বহুমুখী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গঠনের আকাঙ্ক্ষা এবং
৭. ন্যায্যতার ভিত্তিতে বৈশ্বিক আর্থিক ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
কালের যাত্রার প্রধান ধ্বনি ও বৈশিষ্ট্যসমূহকে সামনে রেখে BRICS ইতোমধ্যে ১৫টি বছর অতিক্রম করেছে। প্রারম্ভে যে ৫টি রাষ্ট্রের সম্মিলনে BRICS-এর আবির্ভাব, সেই রাষ্ট্রগুলো বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০% এবং মোট জিডিপির ২৫% ধারণ করত। এখন আরও ৫টি দেশ যুক্ত হওয়ায় BRICS+ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৩% অর্থাৎ ৮২০ কোটি মানুষের মধ্যে ৩৫০ কোটি এবং বিশ্বের মোট জিডিপি’র প্রায় ২৮% অর্থাৎ ১১০ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের অধিকারী। BRICS+ এর মোট জিডিপি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন G-7 এর জোটের মোট জিডিপিকে অতিক্রম করেছে। BRICS+ এর মোট বাণিজ্যের পরিমাণ বিশ্বের মোট বাণিজ্যের ২১ শতাংশ। ২০২২-এর হিসাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকে BRICS ভুক্ত পাঁচটি রাষ্ট্রের ভোটের ক্ষমতা ছিল ১৪.০৬ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে ছিল মোট শেয়ারের ১৪.১৫ শতাংশ। এখন আরও ৫টি রাষ্ট্র BRICS-এ যুক্ত হওয়াতে সেই ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আগামীতে অধিকতর সম্প্রসারিত হবে এটা সুনিশ্চিত।
২০১৫-এর জুলাইতে ‘সার্বভৌম সমতা,’ ‘উন্নয়নের নির্বাচিত পথের প্রতি সম্মান প্রদর্শন,’ এবং ‘পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনা,’ করে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সমতার ভিত্তিতে BRICS ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ গঠন করে। যার মূলধন ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় চীনের সাংহাইতে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে চীনসহ সদস্য দেশগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়ন, সবুজ অর্থনীতি এবং ডিজিটাল অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করেছে এনডিবি। এখন পর্যন্ত মোট ৯০টি প্রকল্প গ্রহণ এবং ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে ব্যাংকটি।
এনডিবি বলছে, ‘‘বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, শহরাঞ্চলের উন্নয়ন, যোগাযাগ অবকাঠামো, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও জনস্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।’’ ২০২৬-এর মধ্যে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ৩০ বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে এনডিবি। এনডিবি’র কৌশলগত ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘‘২০২৬ সালের মধ্যে কার্যক্রমের আরো মানোন্নয়ন করতে চায় ব্যাংকটি।’’
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশবান্ধব জ্বালানিসহ কার্বন নিঃসরণ কমানোর মতো খাতে ঋণ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে এনডিবি। সাধ্যের মধ্যে সবধরণের উৎস ব্যবহার করে পুঁজিবাজারে, বিশেষ করে বেসরকারিখাতে নিজদের উপস্থিতি বৃদ্ধির চেষ্টা থেকে মেধা বিকশিত করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকবে এনডিবি। এনডিবি মনে করে, ‘মানব জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদই মেধা।’
এনডিবি’র আঞ্চলিক শাখা স্থাপনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ইতোমধ্যে ভারতের গুজরাটে এনডিবি’র আঞ্চলিক শাখা স্থাপিত হয়েছে। ভারত, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অবকাঠামো খাত ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগের আগ্রহ রয়েছে এনডিবি’র। বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশ সেই সুযোগ গ্রহণে উদ্যোগী হয়েছিল বটে। তার অন্যতম নমুনা বাংলাদেশ ২০২১-এর জুনে BRICS-এর নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পরিবারে যোগ দিয়েছে এবং BRICS+ এর সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য আবেদনও করেছে। অজ্ঞাত কারণে তা হয়নি। এবছর তা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের মধ্যে এব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নের এই সুযোগ হাতছাড়া কতটা যৌক্তিক হবে তা নীতিনির্ধারকগণ ভেবে দেখতে পারেন।
একবিংশ শতাব্দীর শীর্ষ চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মিলিত সমাধানের সাধনা থেকেই BRICS এর উদ্ভব। সংশ্লিষ্ট সকল রাষ্ট্রের সাথে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সহযোগিতার মাধ্যমেই যেকোনও সমস্যার সমাধান সম্ভব। এব্যাপারে BRICS -এর বর্তমান সভাপতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন—
‘‘অতীতের বছরগুলোতে BRICS-এর অর্জিত অভিজ্ঞতার দ্বারা পরিচালিত হয়ে আমরা এর কার্যক্রমের সমস্ত ফর্ম্যাটে নতুন অংশগ্রহণকারীদের সুরেলা একীকরণের সুবিধা প্রদান করি। অবশ্যই, আমরা বিবেচনা করব যে অন্যান্য অনেক দেশ, তাদের মধ্যে প্রায় ৩০টি, BRICS এর বহুমাত্রিক এজেন্ডায় যোগদানের জন্য ইতোমধ্যে প্রস্তুত। এই লক্ষ্যে, আমরা BRICS এর অংশীদার দেশের একটি নতুন ক্যাটাগরির রূপরেখা নিয়ে কাজ শুরু করব।’’
সাধারণভাবে, BRICS অংশীদারত্বের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে রাশিয়া কাজ করে যাচ্ছে—
১. রাজনীতি এবং নিরাপত্তা
২. অর্থনীতি ও মুদ্রাব্যবস্থা
৩. সাংস্কৃতিক ও মানবিক যোগাযোগ।
প্রথমত, প্রায়ই দেখা যায় ঋণদাতা উন্নত রাষ্ট্রগুলো ঋণগ্রহীতা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতির উপর রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব চাপিয়ে দেয়। যা প্রকারান্তরে বিনিয়োগ, উৎপাদন ও বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এক্ষেত্রে BRICS-এর দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণ বিপরীত। BRICS মনে করে, রাজনীতি হবে অর্থনীতির মুখাপেক্ষী। অর্থাৎ অর্থনীতির চাহিদা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় নীতি গৃহীত ও বাস্তবায়িত হবে। যে বা যারা স্বীয় অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে, অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে দেশে-দেশে বা স্থানীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ে যুদ্ধ বা সংঘাত সৃষ্টি করতে চায়, সেসব ক্ষেত্রে পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদানের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে BRICS বদ্ধপরিকর। এব্যাপারে BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে BRICS Army গঠনের চিন্তা-ভাবনাও চলছে।
দ্বিতীয়ত, এবারের ১৬তম সম্মেলনের প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, অর্থনীতি ও মুদ্রাব্যবস্থাকে রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত রাখা এবং BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্থানীয় মুদ্রায় যাতে বিনিময় করতে পারে তা নিশ্চিত করা। এছাড়া BRICS-এর একটি একক মুদ্রা ও বৈদেশিক মুদ্রার নিজস্ব রিজার্ভ গড়ে তোলার আলোচনাও চলমান রয়েছে। যাতে করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে কৃত্রিম সংকটকালে ডলারের তেলেসমাতিতে মুদ্রা দামের অনাকাঙ্ক্ষিত হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো সমস্যায় না পড়ে।
রাশিয়ার অর্থমন্ত্রী আন্তন সিলুয়ানভ বলেছেন, ‘‘BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজস্ব আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম তৈরির জন্য কাজ করছে। কারণ পশ্চিমা অবকাঠামো ব্যবহার করে কাজ করে এমন প্ল্যাটফর্মগুলি ক্রমবর্ধমান রাজনীতিকরণ হয়ে উঠছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মস্কোর বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞার প্রচারণা রাশিয়া এবং ভূ-রাজনৈতিক ব্লকের অন্যান্য সদস্যদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজতে বাধ্য করেছে। BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো রাজনীতির ঊর্ধ্বে, যেকোনও চাপ ও বিধিনিষেধের ঊর্ধ্বে। এর লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করা এবং আমাদের নাগরিকদের আয় বৃদ্ধি করা। নতুন সিস্টেমে জাতীয় মুদ্রা এবং ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহার করা।’’
রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন গত মাসে ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘‘BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যে ব্যবহার করার জন্য যৌথভাবে একটি অর্থপ্রদান এবং নিষ্পত্তি কাঠামো তৈরির কাজ চলছে।’’ অর্থাৎ পশ্চিমা SWIFT Code ব্যবহারের মতো করে দ্রুত বিনিময়যোগ্য নিজস্ব পদ্ধতি যুক্ত করতে চলেছে BRICS ।
তৃতীয়ত, BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পরস্পরের মধ্যে নিয়মিত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অর্থাৎ জনসাধারণের মধ্যে মানবিক যোগাযোগ বৃদ্ধির সম্ভাব্য উপায়গুলো খুঁজে বের করে তা কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে চীনে BRICS Universities League গঠিত হয়েছে। BRICS+ রাষ্ট্রগুলো সম্মিলিতভাবে বিশ্বের জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক মূলধনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এজন্য দেশগুলোর মধ্যেকার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাসোসিয়েশন গঠনের মাধ্যমে শিক্ষা, গবেষণা এবং উদ্ভাবনে বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ব্রাজিলের ৯টি, চীনের ১৫টি, ভারতের ১২টি, রাশিয়ার ১২টি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ১২টি সর্বমোট ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে BRICS Universities League।
BRICS Universities League হলো BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নেতৃস্থানীয় গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি কনসোর্টিয়াম। ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়, সাংহাই-এ ২০১৩-এর ৬ জুলাই এর সূচনা। BRICS Universities League-এর লক্ষ্য-একাডেমিক এবং বিশেষজ্ঞ সহযোগিতা, তুলনামূলক গবেষণা, এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষামূলক প্রকল্পগুলোর জন্য একটি কমন প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা।
২০১৫-এর অক্টোবরে BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৪০টি অসামান্য বিশ্ববিদ্যালয় বেইজিং নর্মাল ইউনিভার্সিটি, বেইজিং-এ BRICS ইউনিভার্সিটিস প্রেসিডেন্ট ফোরামের আয়োজন করতে সমবেত হয়। পরবর্তীকালে এই ফোরামে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘বেইজিং ঐকমত্য ঘোষণা’ করে এবং তারা BRICS Universities League প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। BRICS Universities League এর সচিবালয় বেইজিং নরমাল ইউনিভার্সিটিতে অবস্থিত। বেইজিং নরমাল ইউনিভার্সিটি চীনের উচ্চ শিক্ষা এবং একাডেমিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি নেতৃস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়। BRICS Universities League-এর কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য আরও অধিকসংখ্যক অসামান্য BRICS বিশ্ববিদ্যালয়কে আকৃষ্ট করতে এর পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। আদতে BRICS Universities League, BRICS রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মেধাবৃত্তিক সহযোগিতার কৌশলগত স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছে।
BRICS রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ‘‘স্বাভাবিকভাবেই, আমরা সদস্য দেশগুলির মধ্যে বৈদেশিক নীতির সমন্বয় বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার চ্যালেঞ্জ ও হুমকির বিরুদ্ধে যৌথভাবে কার্যকর প্রতিক্রিয়ার সন্ধানে মনোনিবেশ করব। আমরা জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থায় BRICS-এর ভূমিকা বৃদ্ধিতে, আন্তঃব্যাংক সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং বিস্তৃতির জন্য BRICS-এর অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব ২০২৫ এবং BRICS-এর উদ্ভাবন সহযোগিতা ২০২১-২০২৪-এর কর্মপরিকল্পনার ব্যবহারিক বাস্তবায়নে অবদান রাখব এবং পারস্পরিক বাণিজ্যে জাতীয় মুদ্রার ব্যবহার নিশ্চিত করব। আমাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞান, উচ্চ প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ সুরক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, যুব বিনিময় এবং নাগরিক সমাজে সহযোগিতার লাগাতার বিনিময় ও প্রচার।’’
BRICS ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে আগ্রহী সমস্ত দেশের প্রতিনিধিদের স্ব স্ব দেশের জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য উৎসাহিত করে। BRICS প্রতিষ্ঠিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইতোমধ্যে তা প্রমাণ করেছে। এনডিবি এমন সব খাতে অর্থ ছাড় করেছে যা তাৎক্ষণিক মুনাফা সৃষ্টি করে না, তবে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পগুলো জনস্বার্থের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, BRICS-এর সহযোগিতার প্রভাবে সদস্যভুক্ত পাঁচটি দেশের আর্থসামাজিক বিকাশ প্রবলভাবে বেগবান করেছে। যা বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার উন্নতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধিকতর গণতন্ত্রীকরণে একটি গঠনমূলক ও মানবিক শক্তি হয়ে অন্যান্য দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
এটা ঠিক যে, BRICS-এর কক্ষপথে আবর্তিত সদস্য রাষ্ট্রগুলো উৎপাদনশীলভাবে কাজ করার জন্য উন্মুখ। তারা একে অপরের অর্থনীতিতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিল BRICS। বিগত দেড় দশকে BRICS-এর অগ্রযাত্রায় যে সাড়া পড়েছে তাতে বিশ্বব্যাপী সবল-সমর্থ ও বেগবান আর্থিক বিকাশের গতিপথকে নির্বিঘ্নে অগ্রসর করে নেওয়া ও তার সুফল সমগ্র মানব জাতিকে ভাগ করে দেওয়ার জন্য BRICS-এর জন্য বৈশ্বিক পর্যায়ে তৈরি হয়েছে একটি অনন্য সুযোগ।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও লেখক।
ইমেইল: [email protected]