জুলাই আন্দোলন তখন উত্তুঙ্গ; শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ঠিক আগের দিন বিএসএমএমইউতে ঘটেছিল সংঘর্ষ; হাসপাতালের ‘ডি’ ব্লকে (কেবিন ব্লক) ভাংচুর হয়েছিল ব্যাপক, আগুনও ধরানো হয়েছিল হাসপাতাল প্রাঙ্গণের বেশ কয়েকটি মোটরবাইক, গাড়িতে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা সেদিনও ছিল শাহবাগ মোড়ে, তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। আন্দোলনকারীদের ধাওয়ায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পাশের বিএসএমএমইউতে ঢুকে পড়ে। তাদের সঙ্গে বিএসএমএমইউর শিক্ষার্থী চিকিৎসক, কর্মচারীরাও যোগ দিয়েছিল।
প্রবল আন্দোলনে পরদিনই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। সরকারের পতন ও সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে তিন দিন পর গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই সরকার আসার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব বদলে যায়, বিএসএমএমইউ প্রশাসনেও আগের পদধারীদের সরিয়ে নতুনরা আসে।
পাঁচ মাস পর ৪ আগস্টের ঘটনার তদন্ত করে নিজেদের ১৫ জন চিকিৎসক-কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষ। এজন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাদের সুপারিশেই নেওয়া হয়েছে শাস্তিমূলক এই ব্যবস্থা।
সেদিন বিএসএমএমইউতে সংঘর্ষে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তবে বরখাস্তের আদেশে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর।
যে ভিডিও দেখে তদন্ত কমিটি হত্যাকাণ্ড ধরে নিয়ে শাস্তির সুপারিশ করেছে, সেখানে এক যুবককে মারধর করতে দেখা গেছে। নাম না জানা ওই যুবক মারা যাননি বলে প্রত্যক্ষদর্শী একজন দাবি করেছেন।
কে মারা গেছেন, সে বিষয়েও নিশ্চিত হতে পারেননি তদন্ত কমিটির সদস্যরা। কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, সেদিন বিএসএমএমইউতে মারধরে আহত হয়ে বারডেমে একজন মারা গেছেন বলে তারা শুনেছেন।
কিন্তু বারডেমে সেদিন কিংবা তার পরের দিন আন্দোলনে আহত কেউ মারা যাননি কিংবা সহিংসতায় মৃত অবস্থায় কাউকে নেওয়া হয়নি বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
পুলিশের খাতায় সেদিন শাহবাগে এক আন্দোলনকারীকে খুনের কথা লেখা আছে, তবে তা বিএসএমএমইউর ঘটনায় নয় বলে ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
ইসমাইল হোসেন রাব্বি নামে ওই যুবককে বারডেমে নেওয়া হয়নি। গুলিবদ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন, একথা লেখা আছে তার পরিবারের করা মামলার এজহারে।
তাহলে কীসের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি সুপারিশ করল, আর বিএসএমএমইউ সিন্ডিকেটও ব্যবস্থা নিল, সেই প্রশ্ন উঠেছে। চিকিৎসকদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলছেন, দায়সারা এক তদন্তের মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কয়েকজনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
‘হত্যা’র দায়ে বরখাস্ত
গত ৫ জানুয়ারি বিএসএমএমইউর রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলামের স্বাক্ষরে ১৫ জনকে বরখাস্তের আদেশ হয়।
তাতে বলা হয়, গত ১২ ডিসেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৯৪তম সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের সম্মুখে সংগঠিত হত্যার সঙ্গে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত নিম্নলিখিত চিকিৎসক, সিনিয়র স্টাফ নার্স ও কর্মচারীগণকে দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ এর ধারা ২ এর (ছ), (জ), (ঝ) ও (৮) অনুযায়ী তাদের সাময়িক বরখাস্ত (সাসপেন্ড) করা হলো।
বরখাস্তদের মধ্যে দুজন চিকিৎসক রয়েছেন; তারা হলেন- কার্ডিওলজি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. আবু তোরাব আলী মিম, চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. রিয়াজ সিদ্দিকী প্রাণ।
কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছেন- পরিচালক (হাসপাতাল) অফিসের পেইন্টার নিতীশ রায়, মো. সাইফুল ইসলাম, এমএলএসএস কাজী মেহেদী হাসান, সহকারী ড্রেসার শহিদুল ইসলাম (সাইদুল) ও সুইপার সন্দীপ, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অফিস সহকারী উজ্জল মোল্লা, পরিবহন শাখার ড্রাইভার সুজন বিশ্ব শর্মা, বহির্বিভাগে (ওপিডি-১) এমএলএসএস ফকরুল ইসলাম জনি, ল্যাবরেটরি সার্ভিস সেন্টারের কাস্টমার কেয়ার অ্যাটেনডেন্ট রুবেল রানা, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শবনম নূরানী, ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের এমএলএসএস শাহাদাত, কার্ডিওলজি বিভাগের এমএলএসএস মুন্না আহমেদ এবং ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের এমএলএসএস আনোয়ার হোসেন।
তাদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ ৫ জানুয়ারি থেকেই কার্যকর হবে উল্লেখ করে অফিসে আদেশে আরও বলা হয়, সাময়িক বরখাস্তকালীন সময়ে তারা প্রচলিত নিয়মে বেতন ও ভাতা পাবেন। তবে বিধি মোতাবেক তাদের চাকরি নিয়ন্ত্রিত হবে।
মারধরের ভিডিও দেখে তদন্ত
অফিস আদেশে ঘটনার তারিখ উল্লেখ না থাকলেও বিএসএমইমইউর প্রক্টর সহকারী অধ্যাপক ডা. শেখ ফরহাদ সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, গত বছরের ৪ আগস্টের ঘটনা ধরে এই পদক্ষেপ। কেবিন ব্লকের তিন নম্বর গেইটের সামনে এই ঘটনা ঘটেছিল।
শাস্তিপ্রাপ্ত ১৫ জনকে ভিডিও দেখে মারামারি, পেটানো, ভাংচুর ও হত্যাচেষ্টায় জড়িত হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
“তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। আমরা পরে ভিডিও ফুটেজ, পথচারীসহ অন্যদের মোবাইল ফোনের ভিডিও এবং গণমাধ্যমের কাছে থাকা ভিডিও ফুটেজ দেখি। তাতে এই ১৫ জনকে শনাক্ত করা যায়।”
চার সদস্যের এই তদন্ত কমিটিতে সদস্য সচিব ছিলেন শেখ ফরহাদ। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের বেসিক সাবজেক্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ও তৎকালীন ডিন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু সালেহ মোহাম্মদ (তিনি এক মাস আগে মারা যান), কার্ডিওলজি বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. শাফিউদ্দিন।
প্রক্টর শেখ ফরহাদ বলেন, “তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট সব কিছু পর্যালোচনা করে এর সত্যতা পেয়েছে। রিপোর্ট দিয়েছে শৃঙ্খলা কমিটির কাছে। সে অনুযায়ী তারা এই বহিষ্কারাদেশ দিয়েছে।”
কে মারা গিয়েছিলেন- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “ছেলেটি বহিরাগত ছিল। গেইটের অপরপ্রান্ত থেকে তাকে টেনে আনার ভিডিও্ দেখেছি। এরপর তাকে মারধর করা হয়।
“কিন্তু তাকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি অথবা ভর্তি রাখা হয়নি। কারণ তখন বিশ্ববিদ্যালয় কেন কোনও হাসপাতালই এই শিক্ষার্থীদের বা আন্দোলনকারীদের ভর্তি করাতে নিষেধ করেছিল।
পরে ছেলেটাকে বারডেমে ভর্তি করা হয়। তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তার মৃত্যু হয়।”
বিএসএমএমইউর শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য ও রেজিস্ট্রার নজরুল ইসলামও নিশ্চিত করতে পারেননি যে ওই যুবকের মৃত্যু কোথায় হয়েছে।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শৃঙ্খলা কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাদের কি হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, নাকি মারধরে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে- সেই প্রশ্নে রেজিস্ট্রার ‘মারধরের ঘটনা’র কথা বললেও অফিস আদেশে কেন ‘হত্যার’ উল্লেখ, তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।
তিনি বলেন, “সাময়িক বরখাস্ত কোনও শাস্তি নয়। বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই এ ঘটনায় আইনি পথে আগাবে।”
হত্যাকাণ্ড তো ফৌজদারি অপরাধ, সেক্ষেত্রে বিএসএমএমইউ কী ব্যবস্থা নেবে- জানতে চাইলে প্রক্টর শেখ ফরহাদ বলেন, এজন্য আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন তারা। সেই পরামর্শ নিয়েই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মারধরের শিকার ব্যক্তি ‘মরেননি’, বারডেমেও ভর্তি হয়নি
গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে ৪ আগস্টের বিএসএমএমইউতে সংঘর্ষের ঘটনার কয়েকটি ভিডিও পাওয়া গেছে। একটি ভিডিওতে ৩ নম্বর গেইটের ভেতরে এক যুবককে লাঠিসোঁটা দিয়ে মারধর করতে দেখা যায় গোটা দশেক ব্যক্তিকে।
শার্ট-প্যান্ট পরা ওই যুবককে যখন টেনে-হিঁচড়ে ভেতরে আনা হচ্ছিল, তখন তার মাথায় ছিল লাল রঙের হেলমেট। হামলার মধ্যেই মাথায় হেলমেট ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তাকে লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছিল, শার্ট টেনে ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছিল। বাঁশের লাঠি হাতে থাকা হামলাকারীদের কারও কারও মাথায়ও ছিল হেলমেট।
শুয়ে পড়া ওই যুবককে টেনে হাসপাতালের ভেতরে ঢোকানো পর্যন্ত দেখা গেছে ওই ভিডিওতে; তারপর আর কিছু দেখা যায়নি ভিডিওতে।
সংঘর্ষে কারা কারা ছিল, তা স্পষ্ট হওয়া না গেলেও ধারণা করা যায়, ওই যুবক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের কেউ একজন। কারণ শাহবাগ থেকে তাদের আসা ঠেকাতে ফটক বন্ধ করে দিয়েছিল বিএসএমএমইউর ভেতরে থাকা ব্যক্তিরা। বন্ধ ফটকের বাইরে থেকে ঢিল ছোড়া হচ্ছিল, ভেতরের জড়ো হওয়া ব্যক্তিরা পাল্টা ঢিল ছুড়ছিলেন।
সেখানে কারা ছিল, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ায় যায়নি। তবে ভিডিও ধারণকারীর পাশে থাকা কেউ বলছিলেন, ছাত্রলীগ পেটাচ্ছে আন্দোলনকারী ছাত্রদের।
সেদিনের ঘটনা নিয়ে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছিলেন ইসমাইল হোসেন নামে এক ব্যক্তি। তবে তিনি মামলাটি করেন বিএসএমএমইউতে ভাংচুরকারীদের বিরুদ্ধে।
সেদিন ঘটনাস্থলেই ছিলেন জানিয়ে ইসমাইল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, মারধরের শিকার ওই যুবক মারা যাননি।
“ঘটনা তো আমার চোখের সামনে। তারে কিল, ঘুষি, চড়, থাপ্পড় দেওয়া হইছে, টাইনা-হেঁচড়াইয়া নিতেছিল কর্মচারীরা। অবস্থা দেইখা আমি তাদের নিষেধ করছি।”
ওই যুবকের পরে কী হলো- জানতে চাইলে ইসমাইল বলেন, “ছেলেটা ছিল ফর্সা, বেশ স্বাস্থ্যবান। যখন অনেক লোক সেখানে জড়ো হইল, তখন তো দেখলাম সে দৌড়াইয়া চইলা গেল। এ ঘটনা তো আমার চোখের সামনেই। মইরা তো যায় নাই।”
বিএসএমএমইউতে ভাংচুরের ঘটনায় আপনি মামলা করলেন কেন- প্রশ্নে ইসমাইল বলেন, “গণ্ডগোল হইছে, গাড়ি পোড়াইছে। আমি গ্রামের মানুষ, কিন্তু রাজনীতি আমার রক্তে। এই হাসপাতাল দেশের, দেশের মানুষের। তাইলে যে হাসপাতালটার ক্ষতি হইছে, সেইটা তো আমার দেশের ক্ষতি। সেজন্য আমি মামলা করছি।”
বিএসএমএমইউর প্রক্টরের কথার সূত্র ধরে সড়কের অন্য পাশের হাসপাতাল বারডেমে বৃহস্পতিবার খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৪ আগস্ট সহিংসতায় আহত কারও মৃত্যু হয়নি।
ইসমাইল হোসেন রাব্বি নামে যে একজন মারা গেছেন, তিনি বারডেমে ছিলেন কি না- জানতে চাইলে বারডেমের রোগী নিবন্ধন শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই নামে ৪ কিংবা ৫ আগস্টে কেউ ভর্তি হয়নি এখানে। অ্যাডমিশন লিস্টেও এই নামে কেউ নেই। আপনাকে ‘রং তথ্য’ দেওয়া হয়েছে।”
পুলিশ যা বলছে
৪ আগস্ট বিএসএমএমইউর কেবিন ব্লকের মারামারিতে কারও মৃত্যুর তথ্য শাহবাগ থানায় নেই।
শাহবাগ থানার ওসি মোহাম্মদ খালিদ মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হিসাবে একটা মামলা হয়েছে। তবে সেটা হত্যা মামলা না। বিএসএমএমইউর ভেতরে যে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে, সেই ঘটনায়।”
তবে সেদিন শাহবাগে ইসমাইল হোসেন রাব্বির মৃত্যুর ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে, তার তদন্ত করছেন ওই থানার এসআই মো. আবুল কালাম।
সেটা বিএসএমএমইউর ভেতরের ঘটনা কি না- জানতে চাইলে এসআই কালাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা তো বিএসএমএমইউর কোনও ঘটনা না, ওটা শাহবাগ মোড়ের ঘটনা।”
এই হত্যা মামলা হয়েছে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে।
তবে পুলিশ কর্মকর্তা কালাম জানান, এর আগে ইসমাইল হোসেনের দায়ের করা অগ্নিকাণ্ড, ভাংচুরের ঘটনার থানার মামলায়ও হত্যা মামলার অভিযোগটিও সংযুক্ত করা হয়েছে।
রাব্বির মৃত্যুর ঘটনায় যে মামলা হয়েছে, তার এজাহারে বলা হয়েছে, ৪ আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা শাহবাগে অবস্থান নিলে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, হামলা-পাল্টা হামলা, সংঘর্ষ চলে। এসসময় পথচারীরা দিগ্বিদিক দৌড়াতে থাকে এবং গুলি চালালে অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়। রাব্বির কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
রাব্বির ময়নাতদন্ত হয়নি বলে ধারণা করছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম। তবে এবিষয়ে জানতে তিনি ঢাকা মেডিকেলে চিঠি দিয়েছিলেন।
“আমি পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের জন্য ঢাকা মেডিকেলে কাগজ পাঠিয়েছি, কিন্তু তারা কোনও ফিডব্যাক দেয়নি।”
ময়নাতদন্ত হয়নি বলে ধারণা করার কারণ হিসাবে তিনি বলেন, “তখনকার ঘটনা আমরা সবাই জানি। সেসময় অনেক মৃতদেহের পোস্ট মর্টেম হয়নি। সে অবস্থা ছিল না। আবার পরিবারগুলোও নানান ঝামেলার ভয়ে মৃতদেহ নিয়ে চলে গেছে।”
জুলাই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের দমন নীতির কারণে সহিংসতায় হাজারের মতো মানুষ নিহত হয়। তার মধ্যে ৪ ও ৫ আগস্টও অনেকে মারা যান।
রাব্বির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
‘এক গুলিতেই তো শেষ’
১৭ বছর বয়সী রাব্বি শরীয়তপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি তার বাবা-মার একমাত্র ছেলে ছিলেন, তার বড় দুই বোন রয়েছে।
রাব্বির বোন মিম আক্তার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে শরীয়তপুরে সক্রিয় হন রাব্বি। নিরাপত্তার শঙ্কা থেকে ভাইকে তারা ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন।
মিম ঢাকার সরকারি কবি নজরুল কলেজে স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। ৪ আগস্ট ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে ঢাকা মেডিকেল মর্গে গিয়ে লাশ পেয়েছিলেন তিনি।
মিম বলেন, “আমি ওকে পেয়েছি ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। ভাইটা আমার খুব সুন্দর ছিল। একদম কপালের মিডেলে গুলি লেগেছিল।”
আবেগতাড়িত মিম বলেন, “ছোটবেলায় মা ওকে কাজলের টিপ দিত। আমি তো বড়, তাই ওর বড় হওয়াটা আমার চোখের সামনেই। মর্গে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, আম্মুর সেই ছোট ছেলেটাই; কেবল কালো কাজলের বদলে লাল রঙের টিপ পরে আছে।
“ওর একদম কপালের মাঝে গুলি লেগে মাথার পেছন দিয়ে মগজসহ বের হয়ে গিয়েছিল।”
রাব্বির দেহে পেটানোর কোনও দাগ ছিল কি না- প্রশ্ন করলে মিম বলেন, “নাহ, কোনও দাগ ছিল না পেটানোর।
“আর পেটানোর প্রয়োজন তো পড়েনি, এক গুলিতেই তো সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর কি পেটানোর দরকার ছিল?” কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন তিনি।
রাব্বির একটা ছবি চাইলে তার বোন বলেন, “ওর ছবি দেখার মতো মানসিক শক্তি আমাদের কারও নেই। অনেক পত্রিকায় ওর ছবি রয়েছে, সেখান থেকে একটা আপনি নিয়ে নেবেন প্লিজ।”