যে আইনে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য হিসাবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাসহ তাদের উত্তরাধিকাররা রাষ্ট্রের বিশেষ নিরাপত্তা পেয়ে আসছিলেন, তা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার তিন সপ্তাহ পর বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আইন বাতিলের এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০০৯ সালে সংসদে আইনটি হয়েছিল। তবে এখন সংসদ কার্যকর না থাকায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আগের আইনটি বিলুপ্ত হবে।
‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ এর খসড়া অনুমোদনের কথা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেছেন, ২০০৯ সালের আইনটি বৈষম্যমূলক বলে সরকারের মনে হয়েছে বলে তা বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জাতির পিতার পরিবার সদস্যগণের নিরাপত্তা আইনের অধীনে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্রীয় কোনও পদে না থাকলেও রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে, তাদের জন্যও সেই ব্যবস্থা ছিল। অর্থাৎ তারা এসএসএফের নিরাপত্তা পেতেন।
এই আইনে রাষ্ট্র কর্তৃক বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ ও সুরক্ষিত আবাসনের ব্যবস্থা করার কথাও বলা ছিল।
আইনে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য বলতে বোঝানো হয়েছিল – তার জীবিত দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাদের সন্তানাদি।
অর্থাৎ এই আইনের অধীনে শেখ হাসিনার দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং শেখ রেহানার তিন সন্তান রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী এই বিশেষ নিরাপত্তা পেতেন।
যে যুক্তিতে এই আইন
বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের হত্যার হাত থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে এই আইন বলে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল।
আইন প্রনয়নের ক্ষেত্রে যুক্তি হিসাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের কথা তুলে ধরে বলা হয়েছিল, যেহেতু তেমন চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় এই পরিবারের অন্যান্য জীবিত সদস্যদেরও একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে এবং সেরকম চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে, তাই তাদের নিরাপত্তায় রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এই আইনটি প্রণীত হয়। তিনি সরকার প্রধান হিসাবেই এই বিশেষ নিরাপত্তা পেতেন। তবে তার বোন শেখ রেহানাসহ অন্যরা এই আইনের অধীনে একই ধরনের নিরাপত্তা পেতেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গঠিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তাদের দুই বোনের সন্তানরা সবাই বিদেশে রয়েছেন।
যে যুক্তিতে বাতিল
প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও কার্যালয় যমুনায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে রিজওয়ানা হাসানের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন আইনটি বাতিল করার কারণ।
তিনি শুরুতে বলেন, “যে বিষয়গুলো কেবিনেটে নির্ধারিত থাকে সিদ্ধান্তের জন্য সেগুলোর ব্যাপারে আমরা বলি না, এটা লিখিত।”
এরপর তিনি বলেন, “আমাদের এই সরকার একটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আউটকাম। সেখানে নিরাপত্তা সংস্থা আদৌ মনে করে কি না যে এরকম দরকার আছে। সেখানে এরকম বলা হয়েছে এরকম বিশেষ নিরাপত্তা দরকার আছে বলে মনে করে না। এটাকে বৈষম্যমূলক মনে করা হয়েছে, সেকারণে সেটার বিরেুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
মন্ত্রিপরিষদের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “কেবল একটি পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য আইনটি করা হয়েছিল, যা একটি সুস্পষ্ট বৈষম্য।”
আরও সিদ্ধান্ত
উপদেষ্টা পরিষদের এদিনের বৈঠকে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে রিজওয়ানা জানান। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে দেশের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের স্বাক্ষরের কথাও জানান তিনি।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়াটি সরকার চালু রাখবে জানিয়ে রিজওয়ানা বলেন, “তাদের কাছ থেকে সংস্কার প্রস্তাব যা আছে, সেগুলো গ্রহণ করব। সে ব্যাপারে একটা পদ্ধতিগত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।”
সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়ী ফুটবলারদের সংবর্ধা দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার।
বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে জানিয়ে পানিসম্পদ ও পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেন, “বন্যার কারণে রপ্তানীমুখী শিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে, তাদের যেন শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।”
মুসলমান সম্প্রদায়ের হজ পালনের খরচ কমিয়ে আনতে সরকার সচেষ্ট বলে জানান তিনি।
এক্ষেত্রে ‘সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে’ খরচ বাড়ছিল দাবি করে রিজওয়ানা বলেন, “প্যাকেজ মূল্য অনেক বাড়তি, এটা যে কমানো সম্ভব, সেটা দেখা গেছে প্রাথমিক বিশ্লেষণে।”