ভারতের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং বিশ্বের অন্যতম ধনী গৌতম আদানি বর্তমানে এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) অভিযোগ তোলে, ভারতের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেওয়ার জন্য আদানি গ্রুপ ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের ২৬৫ মিলিয়ন ঘুষ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। ওই প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কোম্পানিরও বিনিয়োগ করার কথা।
নভেম্বরের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিকিউটররা গৌতম আদানি, তার ভাগ্নে সাগর আদানি এবং আরও পাঁচজনের বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগপত্র প্রকাশ করেন। তবে আদানি গ্রুপ তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে।
এতো কিছুর মাঝেও আদানি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। গত রবিবার জয়পুরে এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আদানি বলেন, “আমাদের এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া এবারই প্রথম নয়। প্রতিটি আক্রমণ আমাদের আরও শক্তিশালি করে এবং প্রতিটি বাধা একটি নতুন সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়।”
যুক্তরাষ্ট্রে অভিযোগপত্র দেওয়ার পর সেদিনই প্রথম জনসম্মুখে উপস্থিত হন আদানি।
অভিযোগপত্র ও বিচার প্রক্রিয়ার জটিলতা
যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড জুরির অভিযোগপত্র মানে হলো, বিচারকরা নিশ্চিত যে তদন্ত চালিয়ে যাওয়া এবং সম্ভবত বিচার শুরু করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির দুর্নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ইরফান নূরুদ্দিন ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টকে একথা বলেন।
তবে ভারতীয় অপরাধে যুক্তরাষ্ট্রের বিচারের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন ও জটিলতা রয়েছে।
ভারতের সিনিয়র অপরাধ আইনজীবী বিকাশ পাহওয়া আল জাজিরাকে বলেন, “প্রিভেনশন অফ করাপশন অ্যাক্ট (পিসিএ) অনুযায়ী ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘুষ লেনদেনের তদন্ত শুধু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যেমন সিবিআই (কেন্দ্রীয় অনুসন্ধান ব্যুরো) করতে পারে। বিচারের এখতিয়ারও ভারতের।”
তবে, যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন করাপ্ট প্র্যাকটিসেস অ্যাক্ট (এফসিপিএ) আইনে দেশটির সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানে ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় সেদেশের সরকারকে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থা ব্যবহার করা বা আমেরিকান বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দেশটির সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে।
আদানিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ঘুষ বিরোধী বিধির লঙ্ঘন করেছেন। এ ছাড়া ৬০০ মিলিয়ন ডলারের একটি বিনিয়োগ চুক্তির সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করেছেন। অভিযোগ প্রকাশের পর ওই বিনিয়োগ চুক্তিটি হয়ে যায়।
পাহওয়া বলেন, এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের এখতিয়ার থাকলেও এমন মামলা আন্তর্জাতিক আইনগত নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে এবং ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একাধিক পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি (এমএলএটি) রয়েছে। তাই তাদের প্রমাণের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে।
পাহওয়া বলেন, “আদানি গ্রুপ যুক্তি দিতে পারে যে, অভিযুক্ত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। এক্ষেত্রে তারা ভারতীয় দুর্নীতি বিরোধী আইন মেনে চলার কথা উল্লেখ করতে পারে।”
তার মানে তদন্তের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যদি আদানি ও তার সহযোগীদের নির্দোষ ঘোষণা করে, তবে সেটি যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করতে পারে।
পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতীয় সরকারকে একটি আনুষ্ঠানিক প্রত্যার্পণ অনুরোধ পাঠাতে হবে, যাতে অভিযুক্তদের বিচার করার জন্য সেদেশে নেওয়া যায়।
এ মাসের শুরুতে নয়া দিল্লি জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের এমন কোনোও অনুরোধ পায়নি। তারপর থেকে ভারত সরকার এই বিষয়ে নতুন করে আর কিছু বলেনি।
আদানি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাইলে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা তুলতে হবে। তবে, তিনি কি করবেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। তিনি যদি যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে দ্রুত বিচার চান, তাহলে ৭০ দিনের মধ্যেই বিচার হবে।
ভারত আদানিকে প্রত্যার্পণ না করলে কী হবে
ওয়াশিংটন ভিত্তিক আধিকারি ল নামের আইন ফার্মের ব্যবস্থাপনা আইনজীবি নিরঞ্জন অধিকারী বলেন, “অভিযুক্তরা যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে উপস্থিত না হন, তাহলে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরু করা হতে পারে। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ‘লুকআউট নোটিস’ জারি করা হতে পারে।”
যুক্তরাষ্ট্রের আদালত আদানি ও তার সহঅভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন। এমন কোনো লুকআউট নোটিস বা আন্তর্জাতিক পরোয়ানা থাকলে, তাদের ভারত থেকে বাইরে গেলে গ্রেপ্তার করা হতে পারে (ভারতের ভেতরে ইন্টারপোলের কোনো এখতিয়ার নেই)। এতে তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অপরাধী প্রত্যার্পণ চুক্তি থাকায় ভারতকে অবশ্যই তাদের অনুরোধটি বিবেচনা করতে হবে, যদি তা আসে। প্রক্রিয়াটি ভারতীয় আদালত পরিচালনা করবে, যা বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করবে।
যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে যে অপরাধের জন্য অভিযোগ আনা হয়েছে, তা কি ভারতেও অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। অভিযোগগুলো কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। অথবা আদানি যুক্তরাষ্ট্রে অমানবিক আচরণের শিকার হতে পারেন কিনা।
তবে, প্রত্যার্পণ মামলাগুলো প্রায়শই দীর্ঘস্থায়ী হয়। তাই আদানি এটি মোকাবিলা করতে পারেন।
আদানিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত বলে ধরা হয়। এই সম্পর্কের প্রভাবে ভারতীয় আদালতে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নাও টিকতে পারে।
তবে, মোদী সরকার নিজেকে এই বিষয় থেকে দূরে রেখেছে এবং বলেছে, “এটি একটি আইনি বিষয়, যার সঙ্গে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ব্যক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ জড়িত। আমরা বর্তমানে এতে কোনোভাবে অংশ নই”।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাধীর জৈশওয়াল গত ২৯ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ১২ সদস্যের একটি জুরি বা বিচারক প্যানেল আদানিকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য একমত হতে হবে, এবং আদানি তাদের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলও করতে পারবেন।
দোষী সাব্যস্ত হলে আদানির কয়েক দশক জেল হতে পারে। তবে তাকে সম্ভবত আরও কম সময় সাজা দেওয়া হবে। তিনি আর্থিক জরিমানারও সম্মুখীন হতে পারেন। সাজার বিষয়টি আদালতের বিচারকের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা