প্রতি বছরের মে মাসে ভূমধ্যসাগরের নীল জলের সৌন্দর্যে যেন বসন্ত ভর করে। বিশেষ করে দক্ষিণ ফ্রান্সের কান শহর সেই সৌন্দর্যের সবটুকু গায়ে মেখে অপেক্ষা করে সারা বিশ্ব থেকে আসা সেলুলয়েড তারকাদের জন্য। এ মাসেই যে বসে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সেরা আসর কান চলচ্চিত্র উৎসব!
কানের পরিচিত ঝলমলে আকাশটায় সূর্যের দেখা নেই গেল দুই দিন ধরে। কানের চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় ‘অননুমেয়’ চরিত্রটা যেন এবার ভর করেছে শহরটির আবহাওয়ায়। না হলে, ইউরোপে গ্রীষ্মের শুরুটা এমন বৃষ্টিময় হবে কেন?
তবে ‘শো মাস্ট গো অন’। আলো ঝলমলে উদ্বোধন হয়েছে উৎসবের। তাতে তিনবারের অস্কারজয়ী যুক্তরাষ্ট্রের অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপকে দেওয়া হয়েছে সম্মানসূচক ‘স্বর্ণপাম’। উদ্বোধনী আয়োজনে ‘থিয়েটার দ্য লুমিয়েরে’ উজ্জ্বল মেরিল স্ট্রিপ হয়েছেন আবেগতাড়িত। পাশে ছিলেন ‘বার্বি’-র পরিচালক গ্রেটা গারউইগ। তিনি এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবের নয় সদস্যের জুরি দলের প্রধান।
উদ্বোধনের আগে প্রেসরুম সরগরম হয় সিনেমা ছাপিয়ে মিটু হ্যাশট্যাগ ও ফ্রিল্যান্সার কর্মীদের ধর্মঘটসহ বেশ কিছু বিতর্কিত ইস্যুতে।
উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হিসেবে দেখানো হয় ফরাসি নির্মাতা কোয়ান্তা দ্যুপিয়ো পরিচালিত ‘দ্য সেকেন্ড অ্যাক্ট’। এটি প্রতিযোগিতায় নেই। প্রতিযোগিতা বিভাগে রয়েছে ২২টি ছবি।
২৯ বছর পর এবার প্রতিযোগিতা বিভাগে ঠাঁই করে নিয়েছে ভারতীয় ছবি ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’। পায়েল কাপাডিয়ার এই নিয়ে উচ্ছ্বসিত ভারতীয়রা।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন ইন্টারন্যাশনাল প্যাভিলিয়নে উদ্বোধন হয় ভারতীয় প্যাভিলিয়নের। সেখানে যোগ দেওয়া ভারতীয় চলচ্চিত্রজনদের মধ্যে আলো করে ছিলেন সঞ্জয় লীলা বানসালি পরিচালিত ‘হিরামান্ডি’-র অভিনেতা তাহা শাহ বাদুশা।
পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলাম। সানন্দে রাজি হলেন হিরামান্ডিতে তাজদার চরিত্রে অভিনয় করা তাহা শাহ। কানে প্রথম আসার অভিজ্ঞতা ভাগ করে বললেন, “এটা দারুণ অভিজ্ঞতা। এত এত ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট চারপাশে। ফিল্ম ডিরেক্টর, অভিনেতা, প্রডিউসার।
“আমি খুবই সম্মানিত। শুধু হিরামান্ডি নয়, আমার আরও একটি ছবি আসছে খুব শিগগির। তা এখানে জানান দিতে পেরে খুব ভালো লাগছে। অবিশ্বাস্য লাগছে। আমি এখানে বারবার আসতে চাই।”
জানতে চাইলাম, ২৯ বছর পর প্রতিযোগিতা বিভাগে ভারতীয় ছবি; একজন ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে কেমন লাগছে? উত্তরে ৩৬ বছরের এই অভিনেতা বলেন, “ভারতীয় ছবি যে সীমানা পাড়ি দিয়ে বিশ্বের কাছে পৌঁছাবার শক্তিমত্তা অর্জন করেছে, এটা তার প্রমাণ। আমি পায়েল কাপাডিয়াকে অভিনন্দন জানাতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, আগামী বছর আরও আরও ভারতীয় ছবি জায়গা পাবে।”
রেড কার্পেটের রোমাঞ্চের জন্য অপেক্ষা করা তাহা শাহ বাদুশার কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাইলাম। বললাম, “বাংলাদেশের ছবি দেখার সুযোগ কখনও হয়েছে?”
তাহা বললেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের কোনও ছবি আমি দেখিনি। তবে বাংলা ভাষায় নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের কয়েকটি ছবি দেখেছি।”
বাংলাদেশি ছবি না দেখলেও বাংলাদেশের দর্শকদের ভালোবাসা জানানোর সুযোগ মিস করেননি তাহা। খাঁটি বাংলায় বললেন, “কেমন আছো? তোমাদের জন্য ভালোবাসা।”
একইরকমভাবে ভালোবাসার কথা জানান অভিনেত্রী অরোশিখা দে। কানে তিনি এসেছেন উৎসবের সেকেন্ড টায়ার আঁ সার্তে রিগায় নির্বাচিত ছবি ‘দ্য শেমলেস’ নিয়ে। বুলগেরিয়ান নির্মাতা কনস্তানতিন বোজানোভার ছবিটিতে অভিনয় করেছেন বাঙালি এই অভিনেত্রী।
‘দ্য ওয়ারিওর কুইন অব ঝাঁসি’-র অভিনেত্রী অরোশিখা কানে আসতে পেরে দারুণ উচ্ছ্বসিত। বললেন, “প্রথমবারের মতো আমার কোনও ছবি এত প্রেস্টিজিয়াস উৎসবে দেখানো হচ্ছে। আমি খুব সম্মানিত। আমি খুব খুশী।
“আমার বুলগেরিয়ান পরিচালক দারুণ গল্পে ছবিটি নির্মাণ করেছেন। এক কথায় ছবিটিকে আমি বলবো, রোমান্টিক ড্রামা। আমি সবসময় চেয়েছি, এমন চরিত্রে অভিনয় করতে, যে চরিত্র আমার চেয়ে আলাদা। তাতে কাজটি অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়। ‘দ্য শেমলেস’-এ একটু শেডস অব গ্রে আছে। এটা দারুণ আনন্দের যে, আমার অভিনীত ছবিটি গ্লোবালি রিপ্রেজেন্ট করা হচ্ছে।”
অরোশিখা বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজের দারুণ ভক্ত। স্মৃতি হাতড়ে মনে করলেন চঞ্চল চৌধুরীকে। বললেন, “চঞ্চলের অভিনয় দারুণ ভালো লাগে।”
এবছর কানের ৭৭তম আসরে অফিসিয়ালি বাংলাদেশের কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই। গত বছর কানের ফিল্ম মার্কেটে বুথ নেওয়া হয়েছিল। নানা কেলেঙ্কারিতে সে বুথ শেষ পর্যন্ত ফাঁকা থেকে যায়। এবার কোন বুথই নেওয়া হয়নি।
তাই অরোশিখার মুখে চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় প্রশংসা শুনে হাপিত্যেশ করলাম। তাতে কানের মেঘলা আকাশটা যেন আরও এক প্রস্থ অন্ধকার ঠেকল আমার কাছে।