দেড় দশক আগে ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদরদপ্তরে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ দাবি করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
শেখ হাসিনার পাশাপাশি তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার এই অভিযোগ জমা হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরের মাসেই সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিডিআরে বিদ্রোহ হয়েছিল। তাতে পিলখানায় সদর দপ্তরে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হয়।
পিলখানায় সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলায় রায়ও হয়েছে। বিচারিক আদালতের পর হাই কোর্টের রায়েও ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়, যাবজ্জীবন সাজা হয় ১৮৫ জনের।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পাঁচ মাস পর এখন একই ঘটনায় গণহত্যার অভিযোগ দায়ের হলো ট্রাইব্যুনালে।
নিহত সেনা পরিবারের ২৫ জনের বেশি সদস্যদের উপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের দপ্তরে এ অভিযোগ দিয়েছেন বলে প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম জানিয়েছেন।
নিহত সেনা পরিবারের সদস্যদের পক্ষে অভিযোগটি প্রস্তুত করেন অ্যাডভোকেট এস এম তাসমিরুল ইসলাম।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “১৫ বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ৫৭ জন নেতা কর্মকর্তা ওপর যে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ, একই সঙ্গে গণহত্যার সঙ্গে সামঞ্জ্যতা রয়েছে বলে আমরা মনে করি।
“এখানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার দোসররা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে সংকটের মুখে ফেলার জন্য এবং তার স্বৈরশাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য দুটি শক্তিশালী বাহিনীকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে এই গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন।”
তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনায় পিলখানায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল দাবি করে তাসমিরুল বলেন, “সেখানে তাদের লাশে আগুন দেওয়া হয়েছে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে দেহ ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের আটক করে, জিম্মি করে লুটপাট চালানো হয়েছে, তাদের ওপর আঘাত করা হয়েছে। এ সবকিছুই মানবতাবিরোধী অপরাধে গণ্য হয়।”
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেকে চরিতার্থ করার জন্য এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হয়েছে উল্লেখ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেই সময়ের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
তাসমিরুল বলেন, “শেখ হাসিনাসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা (অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক), তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (প্রয়াত), তৎকালীন আইনমন্ত্রী (শফিক আহমেদ), তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান (মইন ইউ আহমেদ), তৎকালীন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধান।
“অভিযোগে আরও অনেকের নাম রয়েছে। যারা এই হত্যাকাণ্ড এড়াতে পারতেন, কিন্তু তারা তা না করে আসামিদের পার পাওয়ার জন্য সহযোগিতা করেছেন।”
পিলখানায় নিহত বিডিআরের মহাপরিচালক জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূইয়া সাংবাদিকদের বলেন, “পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ষড়যন্ত্র হয়েছে, এই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ৫৭ অফিসারকে হত্যা করার জন্য। শুধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ রাইফেলস ধ্বংস করার জন্য নয়, দেশের সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করার জন্য এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
“আমার বাবা-মাকে কীভাবে মেরেছে, বলতে আমার বুকটা ফেটে যায়। আমাকে অফিসাররা বলেছিল- বাবা তুমি তোমার বাবা-মায়ের লাশ দেখ না, তুমি তোমার বাবা-মায়ের লাশ নিতে পারবনা না। দেখতেই পারিনি। যে নির্মমতা, বর্বরতা, আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না।”
বাবা-মাসহ পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার চেয়ে রাকিন আহমেদ বলেন, “গত ১৫ বছর একা একা বড় হয়েছি। কী যে কষ্ট বলে বোঝাতে পারব না। আমরা চাই একটা সুষ্ঠু বিচার হোক।”
পিলখানায় নিহত কর্নেল কুদরত এলাহীর ছেলে অ্যাডভোকেট সাবিক রহমান বলেন, “আমি আইন পড়েছি একটা কারণেই যে, আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই, আমার হত্যার বিচার করেই ছাড়বো। আমরা এতদিন বিচার পাইনি, এখন আমরা অভিযোগ দায়ের করেছি, আমরা আশাবাদী সঠিক বিচার পাব।”
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও। এ বাহিনীর নাম এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি।
বিদ্রোহের বিচার বিজিবির আদালতে হলেও হত্যাকাণ্ডের মামলা বিচারের জন্য আসে প্রচলিত আদালতে। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে মুক্তি আটকে আছেন ৪৬৮ বিডিআর সদস্যের।
হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন।
২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাই কোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরো ২২৮ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন। বর্তমানে এ মামলাট আপিল বিভাগে বিচারাধীন।