Beta
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

দিন বদলের পরিবর্তে লোক বদল

চিররঞ্জন সরকার। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

প্রকৃতিতে মাঘ মাস চলছে। মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে বলে প্রবাদ আছে। কিন্তু বাঘ কাঁপা তো দূরের কথা, এবার মাঘে শীতই উধাও। রাজধানীতে এখন ফ্যান চালিয়ে ঘুমাতে হয়। এমন মাঘ আমাদের জীবনে বড় বেশি আসেনি। প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনার সঙ্গে আমাদের চলমান রাজনীতিরও অনেকটা মিল আছে। সর্বগ্রাসী সংকট আমাদের আস্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। আমাদের জীবনে এমন রাজনৈতিক সংকটও আর আসেনি। মাঘের শীতের চরিত্রের মতো আমাদের রাজনীতির চরিত্রও যেন বদলে গেছে। যা হবার কথা, যা ঘটার কথা তা হচ্ছে না। দেশের রাজনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের যে অসীম সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই উবে গেছে। ঠিক কোথায় যে পরিবর্তন বা সংস্কার হচ্ছে, বা সংস্কারের চেষ্টা চলছে, তা ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। গর্জন যতোটা শোনা গিয়েছিল, তুলনায় বর্ষণ নেই বললেই চলে। কার্যকর পরিবর্তন বা সংস্কারের আগ্রহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে না। সব চলছে আগের মতো। মাঝখান থেকে দাঁত দেখাচ্ছে আইয়ূব-ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মারা। তাদের ইচ্ছায় কিনা জানি না, পুরো দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে এমনকি মুক্তিযুদ্ধকে পর্যন্ত আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপের অপচেষ্টা চলছে।

দেশের রাজনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের যে অসীম সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই উবে গেছে। ঠিক কোথায় যে পরিবর্তন বা সংস্কার হচ্ছে, বা সংস্কারের চেষ্টা চলছে, তা ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, “স্বাধীনতা তুমি/ বাগানের ঘর, কোকিলের গান/ বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা/যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।” কবিতাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গভীর থেকে উঠে আসা, যেন স্বাধীনতার এক সর্বজনীন ইস্তেহার। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স চুয়ান্নর দোরগোড়ায়। কিন্তু কোথায় সেই কোকিলের গান? কোথায় সেই যেমন ইচ্ছে লেখার কবিতার খাতা? প্রতিহিংসার দাপট দেখে কোকিল বিষণ্ণ, বটের ঝিলিমিলি পাতা শকুনের ছায়ায় বিবর্ণ, আর কবিতার খাতা হঠাৎ ‘রাজা’ সাজা ‘ফেরার’দের শ্যেন দৃষ্টির কবলে!

স্বাধীনতা মানে সবার আগে অবশ্যই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস। সে ইতিহাসে জানা-অজানা ছোট-বড় অসংখ্য গৌরবময় অধ্যায়, অগুনতি মানুষের মহান আত্মত্যাগ। সে ইতিহাসের অনেকটাই কিন্তু আজও লোকচক্ষুর আড়ালে, অথচ এই ইতিহাসকে ধরেই আজকের বাংলাদেশের গড়ে ওঠা। আমাদের আজকের ভৌগোলিক ঐক্য ও জাতীয় চেতনার উৎস এই ইতিহাস। ফকির-সন্ন্যাস ও সিপাহী বিদ্রোহ, জমিদারপ্রথা বিরোধী আন্দোলন, কৃষক-প্রজা আন্দোলন, টঙ্ক আন্দোলন, আঠারো ও উনিশ শতকের বিভিন্ন আদিবাসী বিদ্রোহের গৌরবগাথা, তারই ধারাবাহিকতায় স্বদেশী আন্দোলন, বিয়াল্লিশের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন, এরপর পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন থেকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধসহ অগুনতি স্থানীয় প্রতিরোধে হাজার হাজার মানুষের শহীদি মৃত্যুবরণ— এ বহুমাত্রিক ইতিহাসই বাংলাদেশের ভিত্তি।

আমরা সাধারণভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন বলতে বুঝি পাকিস্তানি সামরিক শাসকের হাত থেকে প্রশাসনিক মুক্তির ইতিহাস। কিন্তু দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের সংগ্রাম কখনও তেমন আলোচনায় আসে না। ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে আদিবাসী বিদ্রোহ ও কৃষক আন্দোলন জমিদারি ও মহাজনি ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, শাসকদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পথ দেখিয়েছে। স্বাধীনতার পর আইনত জমিদারি, মহাজনি, রাজতন্ত্র সবই বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু থেকে গিয়েছে অবশেষ। আর আজ সব কিছু ছাপিয়ে উঠেছে এ যুগের নতুন জমিদার, নতুন মহাজন, নতুন রাজা— কর্পোরেট প্রভুদের রাজত্ব।

স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জাতীয় চেতনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক উন্নয়ন ও ন্যায়সঙ্গত আর্থিক বণ্টনের প্রশ্ন উঠে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় ভূমি সংস্কার, গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ও আর্থিক সম্পদের জাতীয়করণ এবং একচেটিয়া পুঁজির উপর আংশিক নিয়ন্ত্রণের সাধারণ দিশায় দেশ এগোতে থাকে। কয়লা-সহ বিভিন্ন খনিজ সম্পদ এবং ব্যাংক ও বিমা শিল্পের জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু গত শতকের আশির দশক থেকে উল্টোরথ। সেই উল্টোরথ আজ বলতে গেলে দেশের অর্থনীতিকে গুটিকয়েক ব্যক্তি ও সংস্থার হাতে তুলে দিয়েছে। জাতীয়করণকে নস্যাৎ করার পাশাপাশি পরিবহন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক পরিষেবার দায়িত্বও আজ ক্রমেই ব্যক্তিগত মালিকানা ও ভিন্ন দেশের এজেন্টদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এক দেশের প্রভাব খর্ব করার জোর দাবি ওঠে— ওদিকে তলে তলে আরেক দেশের কর্তৃত্বকে বরণ করা হয়। রাজনীতিতে কথায় কথায় দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতিতে সর্বব্যাপী লুটপাট ও কোম্পানি-রাজ। নতুন যুগের ভোর আনার কথা বলে কিছু মানুষ ঝিমুচ্ছে, এদিকে তাদের চোখের সামনে অন্য আরেক দল তছনছ করছে দেশের শান্তি-স্থিতি, ইতিহাস ঐহিত্য ও সংস্কৃতি।

রাজনীতিতে কথায় কথায় দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতিতে সর্বব্যাপী লুটপাট ও কোম্পানি-রাজ। নতুন যুগের ভোর আনার কথা বলে কিছু মানুষ ঝিমুচ্ছে, এদিকে তাদের চোখের সামনে অন্য আরেক দল তছনছ করছে দেশের শান্তি-স্থিতি, ইতিহাস ঐহিত্য ও সংস্কৃতি

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, পাকিস্তানি শাসনশোষণ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য আজ বহুমুখী বিভাজনের কবলে। ধর্মে ধর্মে বিভাজন। দলে দলে বিভাজন। এমনকি ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, চিন্তা ও মতাদর্শের ক্ষেত্রেও বিভাজন। এই বিভাজন অনেক ক্ষেত্রেই হিংসা ও সশস্ত্র সংঘাতের রূপ নিচ্ছে।

স্বাধীন দেশের এই অভূতপূর্ব সঙ্কটলগ্নে কয়েকটি কথা আমাদের আরও এক বার দ্ব্যর্থহীনভাবে উচ্চারণ করতে হবে। স্বাধীন দেশ মানে স্বাধীন, অধিকারসম্পন্ন নাগরিক, পরাধীন প্রজা নয়— এ কথা আবার জোরের সঙ্গে ঘোষণা করতে হবে; বাংলাদেশের ঐক্য বৈচিত্রের মধ্যে, সেই বৈচিত্র ও বহুত্বকে পূর্ণ সম্মান জানাতে হবে; সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশী নাগরিকের ধর্মীয় পরিচিতি এবং মুষ্টিমেয় ষড়যন্ত্রকারীর হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে এই বৈচিত্রকে কারারুদ্ধ করে রাখা যাবে না। কিন্তু এই কথাগুলো স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে না। 

দিন বদলের নামে বদল হচ্ছে দলের, লোকেরও বদল হচ্ছে। অনেকে ভয়ে দল বদলাচ্ছে। অনেকে লাভের আশায়। একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, সুযোগ বুঝে বোল পাল্টাচ্ছেন। সর্বত্র এক অস্থিরতা এবং অনিশ্চিয়তা। প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতায় স্থিতিশীল আনুগত্যে টান পড়ছে। নেতা কর্মীবৃন্দ ভয়ে এ দল ও দল করছেন। আর সঙ্গে রয়েছে নিরাপদ জীবনের হাতছানি। দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও মুক্তি আছে, যদি শাসক দলে যোগ দেওয়া যায়। শাসকদল যেন ‘ওয়াশিং মেশিন।’ এর মধ্যে ঢুকলে সব পাপ সাফ হয়ে যায়।

আমরা সাধারণ মানুষেরা সামগ্রিক সচেতনতার দিকে এগিয়ে না গিয়ে স্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছি নিজেদের। আর চারপাশের ব্যবস্থা বা ‘সিস্টেম’ ক্রমে পরিবর্তন হতে হতে এমন এক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়াচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের শিকার হলেও আমাদের বিরোধিতার সুর ক্রমে কমে আসছে। যাচাই করে বাজার করলেও সামাজিক জীবনে, পারিপার্শ্বিকতায় যাচাই করতে ভুলে যাচ্ছি আমরা। দু’চারটে ব্যতিক্রম সব সময় থাকে। তাদের চেঁচিয়ে ওঠাকে আমরাই ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু স্বপ্নেও তাদের পরিস্থিতির মুখোমুখি ভাবতে চাই না নিজেদের।

দিন বদলের নামে বদল হচ্ছে দলের, লোকেরও বদল হচ্ছে। অনেকে ভয়ে দল বদলাচ্ছে। অনেকে লাভের আশায়। একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, সুযোগ বুঝে বোল পাল্টাচ্ছেন। সর্বত্র এক অস্থিরতা এবং অনিশ্চিয়তা।

নতুন এই ‘বন্দোবস্তে’ দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত জনসাধারণ চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। এই অনিশ্চিতির কালে, যা ‘অমৃতকাল’-এর ঠিক বিপরীত, কে জনগণকে বাঁচাবে? কে জীবনের নিরাপত্তা দেবে? কে বলবে, আমরা এই প্রশাসনের পক্ষ থেকে তোমাদের পাশে আছি? যে রাজনৈতিক শক্তি কালের এই প্রয়োজনের উপযুক্ত ভাষা জোগাবে, জনসাধারণ সেই রাজনৈতিক শক্তিকেই আঁকড়ে থাকবে তাদের রক্ষক রূপে। পরিস্থিতির এই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সেই স্বর কোথায়?

আমরাই তো ভেবে এসেছি যে, পৃথিবীটা একটা ঘর। আমরা কোথাও না কোথাও জুড়ে আছি প্রত্যেকে, একে অপরের সঙ্গে। আমরা একটা যৌথ পরিবার। কোনও এক জোৎস্না রাতে যৌথ যাপনে এক থালায় ভাত খাবার স্বপ্নও দেখছেন হয়ত আমাদেরই কেউ কেউ। মানে, সকলে মিলে বাঁচা। এই সুন্দর পৃথিবীতে স্বল্প আয়ুর জীবন নিয়ে এসে ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ির উপর হইহই করে বেঁচে থাকা একটা জীবনের মাঝে যে ঢিল ছুড়ে দিচ্ছি আমরাই, তা তো দেওয়া উচিত সন্ত্রাসবাদের দিকে। অনৈতিকতার দিকে। সমস্ত অন্যায় অপরাধের দিকে। কু ও কুটিলতার দিকে। তা হলে কেন তা উড়ে আসছে আমাদের দিকে? থুতু উপরে তাকিয়ে ছুড়তে নেই, আমরা জানি। এতে নিজের গায়ে এসে লাগে। তারপরও আমরা এই অভ্যাস ছাড়তে পারছি না। আর এর ফলে, হয়ত এই প্রবণতার ফলে খানিকটা হলেও রাজনীতির পরিসরে অসুস্থ রাজনীতি সহজ হয়ে যাচ্ছে। রণনীতি বদলে যাচ্ছে। গঠনমূলক উদ্যোগের পরিবর্তে উঠে আসছে উন্মাদনা।

আমরা দিস্তার পর দিস্তা সুবচনের মহাকাব্য রচনা করছি। দেশ ওদিকে শেয়াল-শকুনের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। তারাই শাঁসাচ্ছে, মারছে, পেটাচ্ছে।

নিজেকে বদলানো সহজ নয়। বারবার আঘাত দিয়েই নিজেকে বা নিজেদের বদলানো সম্ভব। প্রত্যেকে যদি নিজেকে বদলাতে চান শান্তির জন্য, তবেই সম্ভব বদল। চিন্তা চেতনার বদল। কিন্তু তা না করে নিজেরা মহাপ্রভু হয়ে কেবল নসিহত দিচ্ছি। নিজেরা বাঘের মতো হুঙ্কার ছাড়ছি। আমরা দিস্তার পর দিস্তা সুবচনের মহাকাব্য রচনা করছি। দেশ ওদিকে শেয়াল-শকুনের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। তারাই শাঁসাচ্ছে, মারছে, পেটাচ্ছে।

মাত্র ছয় মাস আগেই আমরা স্লোগান উচ্চারণ করেছিলাম, দেয়ালে দেয়ালে লিখেছিলাম, দেশটা কারো বাপের না! না মিথ্যে কথা। দেশটা আসলেই কারো কারো বাপের! তা না হলে কর্তব্য বাদ দিয়ে দেশটাকে নিয়ে কেউ এমন ছিনিমিনি খেলে?

লেখক: লেখক ও কলামিস্ট।
ইমেইল: chiros234@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত