কেমন হবে, যদি ছাত্রদলের নেতৃত্বে আসে নিয়মিত কোনও শিক্ষার্থী? সহযোগী ছাত্র সংগঠনটি নিয়ে বিএনপির নতুন উদ্যোগে এই প্রশ্নটি জেগেছে অনেকের মনে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর।
ছাত্রদলের কমিটিগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবারের এই কমিটি সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে তারুণ্যনির্ভর কমিটি। অর্থাৎ আগের চেয়ে কম বয়সী ও নিয়মিত শিক্ষার্থীরাই এ কমিটিতে স্থান পেয়েছেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই এই পদক্ষেপ বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা।
বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আস্তে ধীরে সব কমিটিতেই এটি বাস্তবায়ন করা হবে।”
দেরিতে হলেও বুড়োদের ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব থেকে বাদ দিয়ে তরুণদের জায়গা করে দেওয়ার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন অনেকে।
ছাত্রদলের বর্তমান সভাপতি রাকিবুল ইসলাম এই পদক্ষেপকে যুগান্তকারী অভিহিত করছেন।
তবে সেই সঙ্গে এই প্রশ্নও উঠেছে, দীর্ঘদিনের চর্চার কারণে বয়স বেশি হয়ে গেলেও যাদের ছাত্রদলের নেতৃত্ব পাওয়া এখনও হয়ে ওঠেনি, তাদের কী হবে?
বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত কমিটি
বিএনপির ছাত্র সংগঠন হিসাবে গড়ে ওঠার পর ৪৫ বছর পেরিয়ে আসা ছাত্রদলের ২৬০ সদস্যের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের অধিকাংশেরই বয়স ৩০ বছরের বেশি।
কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে। সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে।
জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবু আফসান ২০০৬-০৭, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মালুম ২০০৭-০৮, সাংগঠনিক সম্পাদক আমানউল্লাহ আমান ২০০৯-১০, জাহাঙ্গীর আলম ২০০৭-০৮ এবং শরিফ প্রধান ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন।
অর্থাৎ ১৪ থেকে ১৭ বছর আগে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন৷ সাধারণ হিসাব ধরলেও তাদের বয়স অন্তত ৩১ থেকে ৩৪ বছর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কোর্সের শিক্ষার্থী হিসাবে এক বা দুই বছর বিরতি দেওয়ার পরও সর্বোচ্চ আট বছরে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করা যায়। সেই সময়সীমা ধরলেও ৬ থেকে ৯ বছর আগে তাদের নিয়মিত ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার কথা। কমিটিতে পদ পাওয়া অন্যদের অবস্থাও কমবেশি এই সাত জ্যেষ্ঠ নেতার মতোই।
অর্থাৎ যারা কমিটিতে পদ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে কনিষ্ঠ, তারাও স্নাতকে ভর্তি হয়েছেন প্রায় এক যুগ আগে। অনেকেরই এখন আর ছাত্রত্বও নেই। তবে কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মিত কোর্সে ভর্তি আছেন। নারীদের মধ্যেও কেউ কেউ অনিয়মিত কিংবা ‘ড্রপ আউট’ (শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়া) শিক্ষার্থী।
মোটাদাগে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটির পদগুলোর প্রায় সবই অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের দখলে।
নেতাদের বয়স বেশি হওয়ার কারণে প্রায়ই সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয় ছাত্রদলকে।
কেন এত বয়সীরা ছাত্রদলের নেতৃত্বে?
সেই প্রশ্ন রাখলে ছাত্রদলের তিনজন নেতা যুক্তি দেখান, দেড় দশক আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসগুলোতে ঢুকতে দিচ্ছিল না ছাত্রলীগ। ফলে নতুন কর্মী সংগ্রহের সুযোগ কম ছিল। পাশাপাশি ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত হলে হামলা-মামলাসহ নানা হয়রানির ভয়ও ছিল। তাই বাস্তব কারণেই ছাত্রদলের নেতাদের বয়স বেশি।
যদিও তার আগেও ছাত্রদলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক যারা হয়েছেন তাদের সবাই ৩০ বছর পার হওয়ার পরই নেতৃত্বে আসেন। এর মধ্যে নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বয়স নিয়ে বেশ আলোচনা ছিল।
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পর্যন্ত আসতে সংগঠনের অনেক স্তর পার হয়ে আসতে হয়। এ ক্ষেত্রে সময়সীমাটা একটু বেড়ে যায়।
“এটি শুধু ছাত্রদল নয়, অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের ক্ষেত্রেও একই রকম হয়ে থাকে। আপনি সদ্য নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কমিটিতেও তা পাবেন।”
তবে ছাত্রদলের কমিটিতে এখন কম বয়সীদের আনার যে প্রক্রিয়া চলছে, তাকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আরও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এনে বাংলাদেশের মানুষকে নতুন রাজনৈতিক চর্চার স্বাদ দেয়ার চেষ্টা করছি আমরা। তাই সেটি প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যা সিদ্ধান্ত নেবে, তা-ই আমরা মেনে নেব।”
নবীনে জোর তারেকের
বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের কার্যক্রম দলের সিদ্ধান্তেই চলতে দেখা যায়।
এক সময় দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদলের একচ্ছত্র দাপট থাকলেও তা এখন আর নেই। শিক্ষার্থীদেরও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা কমেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত আগস্ট েথকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে স্কাইপে একাধিক বৈঠক করেন।
তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং তাদের মতামত গ্রহণের লক্ষ্যে ৬৪ জেলার জন্য ৩৮টি টিম গঠন করেছে ছাত্রদল। প্রত্যেক টিমে সদস্য তিনজন, যার নেতৃত্বে একজন সহ-সভাপতি।
এই বৈঠকগেুলোতেই সিদ্ধান্ত আসে, ছাত্রদলের কমিটিগুলোতে তরুণদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ও নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্বে দেখতে চাওয়ার কথা জানান তারেক।
বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি মনে করি, এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। আমি এই পদ পাওয়ার পর থেকেই ছাত্রদলকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছি। নানা কারণে তা করা সম্ভব হয়নি।
“অবশেষে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে এক এক করে সংস্কারগুলো করা সম্ভব হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।”
এরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪২ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের একাধিক নেতা জানান, ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা এই কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। তবে কমিটির অধিকাংশ নেতাই ২০১৬-১৭ থেকে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষগুলোর।
সেই হিসাবে এ কমিটিই সাম্প্রতিককালে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সবচেয়ে তারুণ্যনির্ভর কমিটি। আগের কমিটিগুলোতে আরও বেশি বয়সীরা ছিলেন।
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ছাত্রদলের অভিভাবক আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার নির্দেশেই আমরা ছাত্রদলকে ঢেলে সাজানো শুরু করেছি।
“এই যে পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধরে জেলা, থানা ও ইউনিট পর্যায় পর্যন্ত আমরা প্রতিষ্ঠা করব।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে নানা নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিয়েছিল। নতুন এই কমিটির মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের পরিবর্তনের সুবাতাস পাওয়া শুরু করেছি।”
বুড়োরা নাখোশ
বয়সী নেতৃত্ব কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু থেকেই নাখোশ দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রদল করে আসা নেতারা। তবে মুল নেতৃত্বের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে তারা মুখ খুলতে চাইছেন না।
তাদের মতে, গত ১৬ বছর ধরে গুম, খুন, হত্যা, হামলা-মামলার মধ্য দিয়ে যাওয়া ত্যাগী নেতাদের বাদ দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রদল নেতা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি অলমোস্ট দুইটা সেশন ক্যাম্পাসেই আসতে পারি নাই। এলাকাতেও থাকতে পারি নাই। যাযাবর জীবন পার করছি।
“আমার একমাত্র অপরাধ ছিল আমি ছাত্রদল করতাম। এই এক অপরাধে আমার শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেল, আমার পুরো জীবনটায় শেষ হয়ে গেল।”
“এত বছরের নির্যাতন শেষে যখন মূল্যায়নের সময় এল, তখন বলল- তোমরা বুড়ো হয়ে গেছ। এত মশকরা ছাড়া কিছুই না,” বলেন নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদপ্রত্যাশী এই নেতা।
আরেক নেতা বলেন, “মামলার ওপর মামলা দিয়েছে আওয়ামী সরকারের সময়। বানোয়াট আর মিথ্যা মামলা। এক রাত এক বাসায় থাকলে পরের দিন আরেক জায়গায় থাকতাম, পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে।
“সামনে থেকে সব মিটিং-মিছিলে ছিলাম। জানের ভয় করি নাই। এখন মুখ চেপে সহ্য করত করতে বয়স বেড়ে গেছে। ছাত্রদলেও জায়গা নেই। যুবদলেও খালি নাই।”
পদপ্রত্যাশী এমন একাধিক নেতা বলছেন, তরুণদের জায়গা দিতে তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু ত্যাগী নেতাদেরও গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।
ত্যাগী নেতাদের বিষয়ে বিএনিপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক বকুল বলেন, “গত ১৫ বছর যারা ছাত্রদল করেছেন, তাদের অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তারা রাজপথে ছিল।
“তারপরও পরিস্থিতির বিবেচনায় কাউকে না কাউকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আমাদের একটি লক্ষ্য ছাত্ররাই ছাত্র রাজনীতি করবে, এটা আমাদের মূলমন্ত্র। এটাকে কেন্দ্র করেই আগামী দিনে নেতৃত্ব তৈরি হবে।”
প্রতিক্রিয়া হবে কী?
২০১৯ সালেও ছাত্রদলে বয়সী নেতাদের বাদ দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া নেওয়া হয়েছিল। তখন কমিটি গঠনের পর বয়সীরা বিক্ষোভে নেমেছিল, বিএনপি কার্যালয়ে তালাও ঝুলিয়েছিল।
২০১৯ সালের ১১ জুন নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা লাগানোসহ ভবনের বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল বয়সী নেতাকর্মীরা।
পরবর্তীকালে দফায় দফায় বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালনসহ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে স্মারকলিপি পাঠানোর পরও কোনও সমাধান পাননি কমিটিতে পদ না পাওয়ারা।
এবারও তেমন অবস্থা তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন দলের অনেক নেতা-কর্মী।
সেবিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ছাত্রদলের ‘বয়স্ক’ যেসব নেতা, বিএনপি ও ছাত্রদলে তাদের অনেক অবদান রয়েছে। অনেকে সংগঠন করতে গিয়ে অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেছেন। কিন্তু অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের মতো ছাত্রদলের কমিটিও নিয়মিত ছাত্রদের নিয়েই হওয়া উচিৎ।”
যদি আগের মতো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাহলে কী করবেন- জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নেতারা জানে ত্যাগ স্বীকার করতে। আমার দিকেই তাকাতে বলব তাদের। আমরা দেশের জনগণের জন্য কাজ করি। সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।”