মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা; তিনি চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) পদে যোগ দেন ২০২২ সালের নভেম্বরে। মূল দায়িত্বের বাইরে তখন থেকেই স্থানীয় সরকার বিভাগের চট্টগ্রামের পরিচালক পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের সব জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করে। তখন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের প্রশাসকের দায়িত্বও চাপে আনোয়ার পাশার ওপর।
এরপর একদল ব্যবসায়ীর আন্দোলনের মুখে চট্টগ্রাম চেম্বারের নেতৃত্ব পদত্যাগ করলে ৯ সেপ্টেম্বর সেই পদে প্রশাসক হিসাবে আনোয়ার পাশাকেই নিয়োগ দেয় সরকার। তার পদের সংখ্যা দাঁড়ায় চারটি।
সর্বশেষ সরকারি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণের পর সেই পদে ৩১ অক্টোবর নিয়োগ দেওয়া হয় আনোয়ার পাশাকেই। অর্থাৎ যুগ্ম সচিব পদ মর্যাদার এই কর্মকর্তাকে এখন একাধারে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলাতে হচ্ছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী সংগঠন এবং সরকারি সেবা সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে যখনই কাউকে সরাচ্ছে, তখনই একজন আমলাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দিচ্ছে। এভাবে আনোয়ার পাশার মতো অনেকের কাঁধ হয়েছে ভারী।
এতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের গতি ধীর হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা।
আনোয়ার পাশাকে উদাহরণ টেনে তারা বলছেন, যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে সামাল দেওয়া অসম্ভব একটি ব্যাপার! এর ফলে তার মূল দায়িত্ব চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রশাসনে কাজে যেমন বিঘ্ন ঘটছে। আবার অন্য পদে তিনি যথেষ্ট সময় দিতে না পারায় সেই কাজেও গতি আনা যাচ্ছে না।
পাঁচটি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে কাজের গতি কমে যাচ্ছে কি না- সকাল সন্ধ্যার এই প্রশ্নে সরাসরি উত্তর দিতে চাননি আনোয়ার পাশা।
তিনি বলেন, “সরকারই আমাকে নিয়োগ দিয়েছে প্রশাসক হিসাবে। সেই দায়িত্ব পালন করাই আমার কাজ। কেন আমাকে এত দায়িত্ব দিয়েছে, সেটা সরকারই ভালো বলতে পারবে।”
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগরের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আগে সার্বক্ষণিক সময় দিয়ে প্রতিনিধিরা চালাতেই হিমশিম খেতেন। এখন পার্ট টাইম কর্মকর্তা দিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব না। এতে বরং জটিলতা বাড়ছে।
“আমলাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে কিন্তু ডেপুটেশনে পাঠানো হচ্ছে। তার মূল দায়িত্ব কিন্তু বিভাগীয় প্রশাসনে। ফলে তিনি কখনোই চাইবেন না তার মূল দায়িত্বে কার্পণ্য করতে। বাকি সময়টা তিনি অন্য প্রতিষ্ঠানে ভাগ করে দেবেন। ফলে সেখানে কী সুফল মিলবে, বুঝতেই পারছেন।”
চট্টগ্রাম ওয়াসার মতো একটি ‘হাইলি টেকনিক্যাল’ প্রতিষ্ঠানে আমলা না বসিয়ে একজন ‘টেকনিক্যাল পারসন’কে দায়িত্ব দিলে ভালো হতো বলে মনে করেন প্রকৌশলী মজুমদার।
অন্যগুলো নিয়ে তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম চেম্বারে সুষ্ঠু ভোটার তালিকা করে দ্রুত একটি নির্বাচন দিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া দরকার। এসব যত দ্রুত করা যাবে, জনগণের ভোগান্তি তত দ্রুত লাঘব হবে।”
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক ব্যবসায়ী নেতা হাবিবুর রহমানও একাধিক দায়িত্ব একজনকে দেওয়ার বিরোধী।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা অস্বীকার করার উপায় নেই রাষ্ট্রযন্ত্র এখন ক্রিয়াশীল না। ধরুন অর্থ উপদেষ্টা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। কোনোটির দায়িত্বই তিনি সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না। এর প্রমাণ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা।
“একজনকে একাধিক দায়িত্ব দেওয়ার কালচার এখন উপদেষ্টা থেকে নিচের স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান। এতে প্রশাসনকে সঠিক পথে আনা যাচ্ছে না। আবার সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রাহক সুফল পাচ্ছে না।”
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বাদ দিয়ে সরকার চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল আহমদকে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছিল ২০ আগস্ট। নগরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি রুটিন কাজ ছাড়া কিছুই করতে পারেননি। এই অবস্থায় আদালতের রায় নিয়ে মেয়র পদে যোগ দিচ্ছেন বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অবশ্যই আমলার চেয়ে একজন রাজনীতিবিদ ভালোভাবে সেবা সংস্থা পরিচালনা করতে পারেন। কারণ দিনশেষে তাকে নিজের এলাকায় যেতে হয়, প্রতিবেশী-আত্মীয়-স্বজন, এলাকাবাসীর মুখোমুখি হতে হয়। তার দায়বদ্ধতা বেশি থাকে। বিপরীতে একজন আমলা এলাকায় অপরিচিত, তিনি পদায়ন পেয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আসেন। ফলে তার সেই দায়বদ্ধতা কম থাকে।
চট্টগ্রাম চেম্বারে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয় ৯ সেপ্টেম্বর। বাণিজ্য সংগঠন আইন ২০২২-এর ১৭ ধারা অনুযায়ী, প্রশাসক ১২০ দিনের মধ্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবেন।
চট্টগ্রাম চেম্বারে ভুয়া ভোটার শনাক্ত, প্রকৃত-তৃণমূল ব্যবসায়ীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি সাধারণ ব্যবসায়ীদের। কিন্তু প্রশাসকের নিয়োগের পর প্রায় দুই মাস পার হলেও এসব ক্ষেত্রে কোনও অগ্রগতি হয়নি।
১২০ দিনের মধ্যেই প্রশাসককে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের বাধ্যবাধকতা আছে। এই অবস্থায় মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে মেয়াদ আরও ৯০ দিন সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন প্রশাসক। ফলে এখন আগামী ৫ মাসের মধ্যে তাকে নির্বাচন করতে হবে।
আনোয়ার পাশা বলেন, “আমি বাড়তি সময়ের মধ্যেই নির্বাচন করতে পারব বলে আশাবাদী। সেজন্যই আজ শনিবার সরকারি ছুটির দিনও চট্টগ্রাম চেম্বারে অফিসে কাজ করছি।”
নিজের কাজের গতি নিয়ে সরকারি এই কর্মকর্তা বলেন, “বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোও আমি সেভাবেই সামাল দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। চট্টগ্রাম ওয়াসাতে আমি এখনও কাজ শুরু করিনি। রবিবার থেকে কাজ শুরু করব।”
একজনকে একাধিক পদে দায়িত্ব দেওয়ার সমালোচনা উঠলেও বিষয়টিকে একটু ভিন্নভাবে দেখছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক আমীর মোহাম্মদ নসরুল্লাহ।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার তাদের সাময়িক সময়ের জন্য নিয়োগ দিয়েছে এবং দিচ্ছে। আমাদের দেখতে হবে, এসব শূন্য পদ তো আর অনির্দিষ্টকাল বন্ধ রাখা যাবে না। আর যেই পদে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে সেই মানের কর্মকর্তা সেই জেলা-বিভাগে আছে কি না, তাও দেখতে হবে।”
স্থানীয় সরকার এবং প্রশাসন নিয়ে কাজ করা এই অধ্যাপক মনে করেন, এখানে যাদের প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেখানে মূলত তারা রুটিন কাজ এবং তদারকিই করবেন। ফলে সেই আমলা কতটা আন্তরিক, দক্ষ ও সক্ষম তার ওপর নির্ভর করছে সেই প্রতিষ্ঠানের সফলতা।