Beta
বুধবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫

চৌদ্দগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্থা : যা জানা গেল

hye-harrasement-choddagram-231224
[publishpress_authors_box]


কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্থা করা হয়েছে সত্তরোর্ধ্ব এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে।

আবদুল হাই ওরফে কানু (৭৮) নামে এই মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগের কৃষক সংগঠন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা শাখার সাবেক সহসভাপতি।

রবিবার দুপুরে উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তাকে জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানোর ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনা ওঠে।

পরিবারের অভিযোগ, স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা আবদুল হাইকে লাঞ্ছিত করে এলাকা ছাড়ার হুমকি দেয়। তবে জামায়াতের স্থানীয় নেতারা এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

ঘটনাটি জানার পর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাইকে নির্যাতনকারীদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। স্থানীয় থানা পুলিশ বলছে, তারা নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।

আব্দুল হাই ঘটনাস্থলের পাশের লুদিয়ারা গ্রামের বাসিন্দা। ঘটনার পর নিরাপত্তাহীনতার কারণে কুমিল্লা ছেড়ে পাশের জেলা ফেনীতে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।

ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন স্থানে দলটির নেতা-কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তার সর্বশেষ নজির আব্দুল হাই। তার বিরুদ্ধে নয়টি মামলা থাকার কথা বলা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে।

আব্দুল হাই কৃষক লীগের নেতা হলেও সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মুজিবুল হকের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে দীর্ঘদিন এলাকায় ফিরতে পারেননি বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।

সরকার পরিবর্তনের পর মুজিবুল হক পালিয়ে যাওয়ায় তিনি এলাকায় ফিরে হেনস্তার শিকার হন।

সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ২০০৯ সাল থেকে টানা ওই এলাকার সংসদ সদস্য। ১৯৯৬ সালেও তিনি আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের একবার ওই আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন।

ভিডিওতে যা দেখা গেল

সোশাল মিডিয়াতে আসা ভিডিওতে দেখা যায়, পাঞ্জাবি ও লাল সোয়েটার পরা আব্দুল হাইয়ের গলায় জুতার মালা পরিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন দুজন। এসময় কিছু একটা বলে নিজের গলায় ঝুলতে থাকা জুতার মালাটি এক হাত দিয়ে নিজেই খুলে ফেলেন হাই। আশপাশে আরও ২০-২৫ জন মানুষের উপস্থিতি দেখা গেলেও কেউ মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে আসেননি।

আব্দুল হাইকে টেনে নিয়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে একজন তাকে প্রশ্ন করেন- “পুরা গ্রামের মানুষের কাছে মাফ চাইতে পারবেননি আফনে? একবারে একজন একজন কইরা।”

তখন মুক্তিযোদ্ধা হাই দুই হাত ওপরে তুলে হাতজোড় করে বলেন- “একদম মাফ চাইলাম।”

পরে পাশে কালো কোট পরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি তাকে বলেন, “আফনে একেবারে এই এলাকা থাইকা চইলা যাবেন।”

আব্দুল হাই এক হাত ওপরে তুলে তা নাড়তে নাড়তে বলেন, “না না, বাড়িত থাইকুম। বাইর হইতাম না।”

এসময় কয়েকজন তাকে বলেন, “না না, অসম্ভব। আমরা বাড়িতে থাকতে পারছি?”
লাল গেঞ্জি পরা আরেকজন আঙুল উঁচিয়ে ওই মুক্তিযোদ্ধাকে বলেন, “এলাকা আউট, এলাকা আউট। এলাকাতে ন থাকি।”

এসময় কালো কোট পরা ব্যক্তিটি বলেন, “আফনে গত ১০ বছর যেখানে ছিলেন, সেখানে চলে যাবেন। আওয়ামী লীগ আমলেও তো আফনে ছিলেন না এলাকায়।”

পরে ওই সবার উদ্দেশে বলেন, “উনি (হাই) আর এলাকায় থাকবেন না।”

আশপাশ থেকে কয়েকজন তখন বলে ওঠেন, “শুধু এলাকা না, পুরা কুমিল্লার বাইরে। কোনও কুমিল্লায় না, একদম কুমিল্লা আউট।”

নির্যাতনের পর এলাকাছাড়া

ঘটনার দিন বিকালেই আব্দুল হাই এলাকা ছেড়ে ফেনীতে গিয়ে আশ্রয় নেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে তিনি এলাকা ছেড়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রবিবার দুপুরে তিনি ওষুধ কিনতে বাড়ির কাছের বাজারে গিয়েছিলেন। এসময় স্থানীয় জামায়াতকর্মী আবুল হাসেমের নেতৃত্বে ১০-১২ জন তাকে ধরে জুতার মালা পরিয়ে দেন। সেই সঙ্গে তাকে দ্রুত এলাকা ছাড়তে বলেন।

পুলিশে অভিযোগ না করার বিষয়ে আব্দুল হাই সাংবাদিকদের বলেন, “বিচার কার কাছে চাইব? মামলা দিয়ে আর কী হবে? এমন বাংলাদেশের জন্যই কি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম?”

ফেনীতে গিয়ে একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে রয়েছেন তার ছেলে গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া।

মোস্তফা সাংবাদিকদের বলেন, “হামলাকারীরা সকলেই স্থানীয় জামায়াত ও শিবিরের চিহ্নিত নেতা-কর্মী। তারা ২০ জনের বেশি ছিল। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে লাঞ্ছিত করা হলো!”

গোলাম মোস্তফা দাবি করেন, পুলিশকে জানিয়েও ফল পাননি তারা।

“ঘটনার পর থেকে চৌদ্দগ্রাম থানার ওসিকে অন্তত পাঁচবার কল করেছি। একবার তিনি কল ধরেছেন, কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেননি। এরপর আবারও কল করলে তিনি ধরেননি। যেখানে ওসি কলই ধরেন না, সেখানে আমরা কার কাছে আইনগত সহায়তা চাইব?”

মোস্তফা বলেছেন, ওই ঘটনার পর তারা বাবা-ছেলেই শুধু নয়, গোটা পরিবারই এলাকা ছেড়েছেন।

কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সফিউল আলম বাবুল এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আব্দুল হাই কানু স্বাধীনতা যুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল অগ্রণী। তাকে যারা এভাবে লাঞ্ছিত করেছে, তাদের প্রতি ধিক্কার জানাচ্ছি।”

এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার না করা হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

যাদের বিরুদ্ধে হাই ও তার ছেলে অভিযোগ করেছেন, তাদের কোনও বক্তব্য জানা যায়নি।

তবে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতের আমির মাহফুজুর রহমান এই ঘটনার সঙ্গে তার দলের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেছেন।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এটি ওই এলাকার ইস্যু, সেখানকার প্রতিটি পরিবারের সাথে তার (হাই) ঝামেলা আছে। আওয়ামী লীগের লোকেরাও আগে তার বাড়িঘর ভেঙেছে। তাকে মেরেছে। এখন সম্ভবত তার আশেপাশের যারা থাকে, তারাই ক্ষোভ থেকে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।”

জড়িতদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাইকে নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে সোমবার বলা হয়, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় পুলিশকে উদ্ধৃত করে প্রেস উইং জানায়, আব্দুল হাই ৯টি মামলার আসামি, তার মধ্যে হত্যামামলাও রয়েছে।

কী বলছে পুলিশ

আব্দুল হাইয়ের নিরাপত্তায় পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি এ টি এম আক্তার উজ জামান।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ঘটনার পর আমি নিজে কয়েকবার তার সঙ্গে কথা বলেছি। সব শেষে গতকাল রাতেও তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি তার নিরাপত্তার পূর্ণ আশ্বাস দিয়েছি; বলেছি দেশের একজন সন্মানিত নাগরিক হিসেবে নিরাপত্তা পাওয়া তার অধিকার। কিন্তু আজ সকাল থেকে তিনি আর আমার ফোন রিসিভ করছেন না।”

তিনি বলেন, “ঘটনা জানার পর আমরা তাকে অভিযোগ দিতে বলেছি। কিন্তু তিনি কোনও অভিযোগ করতে রাজি হননি। এরপরও আমরা নিজ উদ্যোগে ঘটনার তদন্ত করছি। জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।”

তবে রবিবারের এই ঘটনায় সোমবার রাত পর্যন্তও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেছে বলে খবর পাওয়া যায়নি।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে নয়টি মামলার কথা বলা হলেও চৌদ্দগ্রাম থানায় খবর নিয়ে দুটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।

২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আবু বকর ছিদ্দিক ওরফে রানা নামের এক যুবলীগকর্মীকে কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে তার ছেলে গোলাম মোস্তফা বিপ্লবও আসামি।

এছাড়া আব্দুল হাইয়ের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের আরেকটি মামলা পাওয়া গেছে। তা ছিল মারামারির ঘটনা।

মামলার সংখ্যার বিষয়ে ওসি আক্তার উজ জামান বলেন, “আব্দুল হাইয়ের নিজের ভাষ্যমতেই তার বিরুদ্ধে ৯টি মামলা আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অফিশিয়ালি ২টা মামলার কথা জানতে পেরেছি আমরা। বাকিগুলোর বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত