যে আইনে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার, সেই আইনেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নিষিদ্ধের দিনই ছাত্রলীগের প্রচার-প্রসারে আইনগত বাধা থাকার কথা সাংবাদিকদের মনে করিয়ে দেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
প্রশ্ন উঠছে, গণমাধ্যম কি নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকবে? এমন প্রশ্নে বিভিন্ন মত এসেছে সাংবাদিক গণযোগাযোগের শিক্ষক ও আইনজীবীদের কাছ থেকে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামালের মতে ছাত্রলীগের প্রচার-প্রসারে বাধার বিষয়টি বিভ্রান্তিকর (কনফিউজিং)। গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের যে কর্মকাণ্ড, সে কারণে তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে—একথা উল্লেখ করে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এর আগে তাদের কর্মকাণ্ড ছিল না?”
“স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্রলীগের যে ভূমিকা সেগুলো আমি বলতে পারব না কেন”—প্রশ্ন তোলেন এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
তিনি বলেন, ‘‘আমি আসলে বিভ্রান্ত। ৬৬-র ছয় দফা, গণঅভ্যুত্থ্যান, প্রথম পতাকা উত্তোলন এগুলো সবই তো ছাত্রলীগ করেছে। এগুলো শুনে যে কারও মনে ছাত্রলীগের প্রতি আগ্রহ জন্মাতে পারে। এটা কি আমি করতে পারব না ?’’
দেশের সংবিধানের প্রসঙ্গ টেনে এই সাংবাদিক বলেন, ‘‘সংবিধানে তো জাতির পিতার ছবি রাখার কথা বলা হয়েছে। তারা তো ছবি রাখে না ? বরংচ জাতির পিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা সংবিধান মানে না। সংবিধান মানা বৈধ না হয় তাহলে বিতর্কিত আইন কেন মান্য করব, এটা ক্লিয়ার না।’’
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি মাহফুজ আলমের নির্দেশনার প্রতি ইঙ্গি করে এই সাংবাদিক বলেন, “ওনার নির্দেশনা মানতে গেলে প্রত্যেকটা মিডিয়া কর্মী দ্বিধার মধ্যে পড়বে।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলছেন, সংবাদ প্রকাশ করা মানেই প্রচার-প্রসার নয়।
এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “প্রথম আলো জঙ্গি নিয়ে অনেক রিপোর্ট করেছে, তার মানে কি তারা জঙ্গিবাদের প্রচার প্রসার করেছেন? কোনও নিষিদ্ধ সংগঠনের নিউজ দেওয়া মানেই তার প্রচার প্রসার না।’’
‘‘আমরা দেখতাম শিবির নিষিদ্ধ হয়েছে, জামায়াত নিষিদ্ধ হয়েছে, সেই নিষিদ্ধের সংবাদ কিন্তু দেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হয়েছে। সেই নিষিদ্ধে ছাত্রলীগ কী প্রতিক্রিয়া জানায় সেই সংবাদ ব্ল্যাক আউট করা যাবে না।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ‘‘আমরা যদি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখি লাদেন আইএস তাদের ক্ষেত্রে কোনও বাধা আছে ? আইনে যদি থাকে সেটা একটা বিষয়।’’
উদাহরণ হিসেবে সাইফুল বলেন, ‘‘(ধরা যাক) ছাত্রলীগের একটা ছেলেকে আটক করা হলো। তখন সংবাদ সম্মেলনে সেই আটককৃত কর্মী যে বক্তব্য দেবে, তা মিডিয়া প্রকাশ করলে মিডিয়া কি শাস্তি পাবে? সরকারকে এই বিষয়টি পরিস্কার করতে হবে।’’
আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান উল্লেখ করে সাইফুল আলম বলেন, ‘‘যেকোনো ব্যক্তি সমান বিচার পাওয়ার সুযোগ আছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ কনফ্লিক্ট করেনি। আইনে আছে আদালতের ছবি প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু ছবি প্রকাশ হচ্ছে।’’
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এমন কোনও সিচুয়েশন ক্রিয়েট করা যাবে না যাতে মিডিয়ায় শূন্য অবস্থায় থাকে। এ বিষয়ে সরকারকে আইন অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে হবে।’’
ছাত্রলীগকে ‘নিষিদ্ধ সংগঠন’ উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশ করতে সাংবাদিকদের পরামর্শ দেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমকে প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। আপনারা তো ওদের তথ্য প্রচার করবেন না।’’
ছাত্রলীগের ৬৬ ও ৭১ এর অবদানের বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘‘ন্যায় নীতি এক জিনিস। আইনের ব্যাখ্যা অন্য জিনিস।’’
যেভাবে নিষিদ্ধ হলো ছাত্রলীগ
গত জুলাই মাসে কোটা সংস্কার দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকর্মীদের সংঘাতের পর আন্দোলন জোরদার হয়। ওই আন্দোলনে দমন-পীড়ন, হতাহত বাড়তে থাকলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। তারপর থেকেই আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবি ওঠে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে গঠিত হয় ‘পাকিস্তান ছাত্রলীগ’। পরবর্তীতে সংগঠনের নাম হয় ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। ১৯৪৮ সালেই মাতৃভাষার পক্ষে ছাত্রলীগ আপসহীন অবস্থান তৈরি করে। ১৯৫৬ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায়, ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা’ আন্দোলনে রাজপথের প্রথম সারির ভূমিকায় ছিল ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে ছাত্র গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এরপর একাত্তরে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭২-৭৫ কালপূর্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের সংগ্রামে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। সামরিক শাসনের মধ্যেও ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের ১০ দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
সরকার গত ২৩ অক্টোবর নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে। সন্ত্রাস বিরোধী আইন- ২০০৯ ওই আইনের তফসিল-২ এ ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামের ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের একাধিক কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুম কেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এতৎসম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সকল প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।”
প্রজ্ঞপনে আরও বলা হয়েছে, “গত ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করিয়া শতশত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের হত্যা করেছে এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে।”
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “যেহেতু সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, চলতি বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছে; সেহেতু সরকার সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামীয় ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসাবে তালিকাভুক্ত করল।”