“ভারতীয় রান্নার ইতিহাস যদি চার থেকে সাড়ে চার হাজার বছরের হয়, তবে বাটার চিকেন রান্নার চল বড়জোর ৬০-৭০ বছরের হবে। কারণ এই রান্নায় দেওয়া টমেটোর সঙ্গে পরিচয় এর আগে হয়নি। বাটার চিকেন খাওয়া খুব শুরু হয়েছিল ধরা যায় দেশভাগের সময়। ”
বাটার চিকেন রান্না করতে করতে এমন টুকটাক কথা বলছিলেন ভারতের শেফ রণবীর ব্রার। শেফ রণবীর ব্রার ইউটিউব চ্যানেলে বাটার চিকেন রান্নার এই ভিডিও প্রায় ৫০ লাখ ছুঁই ছুঁই ভিউ পেয়েছে।
রেস্তোরাঁয় তো বটেই, ভারতের বিয়ে বাড়িতেও বাটার চিকেন থাকা চাই। বাংলাদেশেও আজকাল বাটার চিকেন রান্নার দেওয়া সব মশলার মিশ্রণ প্যাকেট আকারে পাওয়া যায়। এখানে ভারতীয় খাবার অথবা বুফে রেস্তোরাঁতেও বাটার চিকেন পাওয়া যায়।
যারা রান্না করতে ভালোবাসেন তারা তন্দুরি মুরগীর জন্য টমেটো-মাখন দিয়ে মসৃণ ভুনা বানিয়ে শেষে ক্রিম ছড়িয়ে পরিবেশন করে ভোজন রসিকদের মন জয় করে নেন।
উপমহাদেশের জিভে জল আনা পদ সেই বাটার চিকেন খাবার টেবিল ছাড়িয়ে আদালতে কী করছে তাহলে?
চিটচিটে এক গরমের দিনে দিল্লি শহরের গুলাতি রেস্তোরাঁয় ওয়েটাররা যেন আর কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। হুট করে গ্রাহকের ভিড় লেগে গেলো; তারা প্রায় সবাই এসেছে এই রোস্তোরাঁর সেরা পদ বাটার চিকেন খেতে।
বিবিসির প্রতিবেদক যখন হাজির হলেন তখন কর্মজীবী একদল বাটার চিকেনের মজা নিচ্ছে, আরেকদিকে কয়েকজন জার্মান পর্যটক মেনু ঠিক মতো না দেখেই বাটার চিকেন বলে হাঁক দিলো।
১৯৪৭ সালের আগের কথা; পেশোয়ার শহরে মতি মহল রেস্তোরাঁ চালাতেন মখা সিং। দেশভাগ হলে পেশোয়ার হয়ে যায় পাকিস্তানের অংশ; মখা সিং চলে আসেন দিল্লি শহরে। পেশোয়ারের রেস্তোরাঁয় কাজ করেছিলেন কুন্দন লাল গুজরাল, কুন্দন লাল গুজরালের চাচাতো ভাই কুন্দন লাল জাগগি এবং ঠাকুর দাশ মাগ। এদের সঙ্গে নিয়েই দিল্লির দরিয়াগঞ্জে রেস্তোরাঁ খুলে বসলেন মখা সিং।
পেশোয়ারের রেস্তোরাঁয় একটি বিশেষ পদ ছিল; সেই খাবার চালু হলো দিল্লিতেও। টমেটো দিয়ে ভুনা, চামচ ভরে বাটার ও মশলা এবং রয়ে যাওয়া তন্দুরি চিকেন দিয়ে হতো সেই বিশেষ ব্যঞ্জন।
দিল্লিবাসীর জিভে বাটার চিকেনের স্বাদে মজে গেল। ভারতের মন্ত্রীরা তো ছিলেনই, বাদ যাননি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুও; সবাই এই রেস্তোরাঁ বাটার চিকেন খেয়েছেন। সরকারি খাবার পরিবেশনায় বাটার চিকেন যোগ হয়ে গেল।
গুজরাল মারা গেলে আর্থিক সংকটে মতি মহল বেচে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি দেখা দিল। তার উত্তরসূরিরা মতি মহল ডিলাক্স বলে আরেকটি রেস্তোরাঁ শুরু করে।
গুজরালের উত্তরসূরিরাই শুধু এই বিশেষ পদ খাইয়ে পয়সা কামিয়ে চলেছিল তা নয়। ২০১৯ সালে জাগগির নাতি দরিয়াগঞ্জ নামে একটি রেস্টুরেস্ট খুলে বসে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতেই যেন এই রেস্তোরাঁর স্লোগান দেওয়া হয় ‘বাটার চিকেন রেসিপি উদ্ভাবকদের রেস্তোরাঁ’।
এই বছরের গোড়ার দিকে মতি মহল ডিলাক্স এবং গুজরালের নাতি মনিষ শেষ পর্যন্ত মামলা ঠুকে দিলেন দরিয়াগঞ্জ রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে। অভিযোগে লেখা হয়, দরিয়াগঞ্জের ওই দাবি সত্য নয়; বরং তাদের প্রয়াত দাদাই এই ব্যঞ্জনের উদ্ভাবক ছিলেন।
দরিয়াগঞ্জ রেস্তোরাঁর প্রধান নির্বাহী হলেন অমিত বাগগা; কুন্দন লাল জাগগির নাতি রাঘব জাগগি তার সতীর্থ এখানে।
বাগগা পরিবারের বিশ্বাস, এই রেস্তোরাঁই বাটার চিকেনের আসল দাবিদার। এই স্লোগান নিয়েই তারা রেস্তোরাঁর নিবন্ধনও পেয়েছে ২০১৮ সালে।
অমিত বাগগা বলেন, অতীতের দলিল থেকেও এটা স্পষ্ট গুজরাল ও জাগগি দুজনেই পুরনো রেস্তোরাঁর অংশী ছিলেন।
এখন কার দাদা ওই সময় নিজ হাতে বাটার চিকেন বানিয়েছিলেন তা প্রমাণ করা কষ্টকরই হবে।
বাগগা বিশ্বাস করেন, গুজরাল-জাগগি দুজনে মিলেই এই রেসেপি উদ্ভাবন করেছিলেন।
“অনেক তন্দুরি মুরগী রয়ে যেত, এসব নিয়ে কী করা হবে তাই ছিল ভাবার বিষয়।”
“তারা ঠিক করলেন এই রয়ে যাওয়া তন্দুরি মুরগী দিয়ে আরেকটা খাবার বানানো যাক। এজন্য তারা তাজা টমেটো নিলেন, আরও দিলেন বাটার ও মশলা।”
“কুন্দন লাল জাগগি মারা যাওয়ার আগে আমি তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তখন তার কাছে এই রেসিপির পেছনের গল্প জানতে চেয়েছিলাম। আর তিনি তখন বলেছিলেন, এটা নেহায়েত কাকতালীয় ভাবে ঘটে গেছে, হুট করেই।”
দেশভাগের পর স্বাদ গ্রন্থিকে কাবু করে ফেলা বাটার চিকেন রেসিপিতে টুকটাক বদল তো হয়েছেই।
গত বছর মুম্বাই শহরের এক রেস্তোরাঁ বাটার চিকেন ককটেল করেছিল অ্যালকোহল দিয়ে।
দিল্লিতে কত কত রেস্তোরাঁয় বাটার চিকেন পিজা পরিবেশন করা হয় তা চিন্তা করে নিশ্চিত হতে পারেননি বিবিসির প্রতিবেদক।
তার মনে পড়ে যায়, সাংগ্রি-লা এরোস হোটেলের লবির ক্যাফে বাটার চিকেন দেওয়া সমুচা খেয়েছিলেন তিনি।
“টমেটোর স্বাদ এই রেসিপিতে খুবই জরুরি,” বললেন ওই হোটেলের বাবুর্চি গগণদীপ সিং সাহনি।
রেসিপিতে নিরিক্ষা নিয়ে তার মত হলো, “শেফ কখনই খাবার নষ্ট করতে চায় না; তবে যদি আদি স্বাদ ঠিক রেখে কিছু করা হয় তা ঠিক আছে।”
এরপর দরিয়াগঞ্জ অ্যারোসিটি রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মেরেছিলেন বিবিসি প্রতিবেদক। সেখানে কাঠ ও পিতল দিয়ে ভারতীয় নকশা মুগ্ধ করেছিল তাকে। এই রেস্তোরাঁর দেওয়ালে বড় বড় পপ তারকা আর রাজনীতিকদের ছবি বাঁধাই করে ঝোলানো আছে; এরা সবাই খেতে এসেছিলেন।
দরিয়াগঞ্জ অ্যারোসিটি রেস্তোরাঁয় বাটার চিকেনের ভুনা ছিল ঘন আর মসৃণ।
বাগগা মনে করিয়ে দিলেন, “৪৭ সালে কোনো ব্লেন্ডার ছিল না। আমাদের আজকের বাটার চিকেন রান্না কিন্তু সেই আদি রেসিপির মতোই।”
“আজকাল অনেক রেস্তোরাঁয় সসের মতো ভুনা করা হয়; আমাদের বাটার চিকেন একেবারে আগের সেই ঘন ভুনা।”
বিবিসি প্রতিবেদক মতি মহল ডিলাক্সে গিয়েও বাটার চিকেন পাতে তুলে নেন। এখানে রান্না ভীষণ সুস্বাদু এবং তাজা টমেটো ও মরিচের সুগন্ধে ভুর ভুর করছিল। এই রেস্তোরাঁয় বাটার চিকেনের ভুনা যেন আরও বেশি সমৃণ মনে হলো বিবিসি প্রতিবেদকের কাছে।
কৌতুহলী প্রতিবেদক রেসিপির কাহিনী জানতে উঠেপড়ে লাগলেন। মতি মহল ডিলাক্সের মালিক শুরু কথা বলতে রাজিও হয়েছিলেন। পরে অবশ্য তিনি রেস্তোরাঁ থেকে বার হয়ে যান। রেস্তোরাঁর একজন মুখপাত্র বলেন, কোর্টে মামলা চলমান থাকায় এ নিয়ে তারা কোনো বক্তব্য দেবে না আর।
বিবিসির কাছে তখন মনে হয়েছে, এই মামলা জেতা সম্ভবত অসম্ভব হয়ে উঠবে।
একই কথা বলছেন দক্ষিণ এশিয়া এবং খাবারের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ দ্য ইউনিভার্সিটি অব শেফফিল্ডের শিক্ষক নেহা ভারমানি।
“কেউ এককভাবে কোনো ব্যঞ্জন উদ্ভাবন করার দাবিদার হতে পারে না।”
এমনকি টমেটো ফসলের সঙ্গে পরিচয় না হলে বাটার চিকেন কখনও বানানোই হতো না বলেও মন্তব্য করেন এই সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ।
এসবের মধ্যে দরিয়াগঞ্জের বাগগা ইতিবাচক দিকটি দেখতে চান।
“মামলাটি হচ্ছে কেউ একজন বলছেন, তাদের দাদা এই বাটার চিকেন বানিয়েছিল। কিন্তু কেউ কি জানে আসলে কে তখন এই রেসিপি উদ্ভাবন করেছিল?”
“মামলার পর বিশ্বে বড় বড় শিরোনাম হচ্ছে। এতে তো আমাদের বিক্রি আরও বেড়ে গেছে। আমাদের নিয়মিত গ্রাহকরা এসব মামলা নিয়ে ভাবছে না। খবর পড়ে আরও অনেকে এখন আসছে, তবে বাটার চিকেনে স্বাদ না থাকলে কিন্তু তারা পরের বার আসবে না।”
কুন্দন লাল গুজরাল না কি কুন্দন লাল জাগগি – তাহলে কে এই ব্যঞ্জনের পেছনের জাদুকর?
মামলা কোনদিকে গড়াবে তা হয়তো শিগগিরই জানা যাবে, অথবা অপেক্ষা দীর্ঘ হবে। তার আগে বসে না থেকে রুটি বা ভাতের সঙ্গে পাতে বাটার চিকেন তুলে খাবারের স্বাদে মজে থাকুন।