দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে বড় অবদান রাখা চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের টার্মিনালগুলো এতদিন দেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালিত হয়ে এলেও গত বছর প্রথমবারের মতো বিদেশি অপারেটর দায়িত্ব পায়।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এর উদ্দেশ্য বন্দরের দক্ষতা বাড়ানো, দেশি অপারেটরদের যাচাই করা এবং সেইসঙ্গে ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ নিশ্চিত করা।
সৌদি আরবের প্রথম বেসরকারিভাবে অর্থায়িত কোম্পানি রেড সি গেইটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) ২০২৪ সালের জুন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন নির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনা শুরু করে। তবে সব মিলিয়ে তেমন সক্ষমতা দেখা যায়নি।
গত বছরের জুন-ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে পিসিটিতে মোট কন্টেইনার উঠানামা হয়েছে মাত্র ৩০ হাজার একক। সবই রপ্তানি কন্টেইনার। এরমধ্যে খালি কন্টেইনারের সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি। সাত মাসে পিসিটিতে জাহাজ ভিড়েছে মাত্র ৩৪টি। সবই মায়ার্স্ক লাইনের জাহাজ। সব জাহাজের সবই রপ্তানি পণ্য বোঝাইয়ের জন্য জেটিতে ভিড়েছিল।
আমদানি পণ্যবাহী কোনও জাহাজ পিসিটিতে ভেড়েনি, সেই সক্ষমতা অবশ্য এখনও তৈরি হয়নি।
ফলে বছরে পাঁচ লাখ একক কন্টেইনার উঠানামার সক্ষমতার কথা দিয়ে তৈরি হওয়া এই পিসিটিকে আপাতত মায়ার্স্ক লাইনের রপ্তানি কন্টেইনার পরিবহন করেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
পিসিটি ও বন্দর কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলতে চাইছে, পুরোদমে যন্ত্রপাতি যোগ হলেই কেবল পুরো সক্ষমতার সমান পণ্য উঠানামা করবে পিসিটিতে। কিন্তু সেই অবস্থার জন্য দরকার বিশাল বিনিয়োগ। সময় লাগবে প্রচুর।
ফলে কবে নাগাদ পিসিটি পুরোদমে চালু হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না কেউ।
এখন বন্দর ব্যবহারকারীদের প্রশ্ন—এত ঢাকঢোল পিটিয়ে পিসিটি বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনায় সুফল মিলল কই? ৩০ হাজার একক কন্টেইনার তো বিদ্যমান সক্ষমতা দিয়ে এনসিটিতেই উঠানামা সম্ভব হতো। পিসিটিতে গিয়ে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে বন্দরের কী লাভ হলো?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চুক্তি অনুযায়ী আমরা আমাদের রাজস্ব পাচ্ছি। সেদিক থেকে আমরা লসে নেই। তবে তারা এখনও স্ক্যানার বসাতে পারেনি, কাস্টমসের অনুমতি না পাওয়ায় আমদানি পণ্যবাহী জাহাজ ভেড়াতে, নামাতে পারছে না। আশা করছি, মাস দুয়েকের মধ্যে সেই অনুমতি মিলবে। ফলে পণ্য উঠানামা আগের চেয়ে বাড়বে।”
কিন্তু পিসিটিতে তো গ্যান্ট্রি ক্রেন নেই, নেই অন্য যন্ত্রপাতি; তাহলে পণ্য উঠানামা বাড়বে কীভাবে—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, কি গ্যান্ট্রি ক্রেন নেই। সেগুলো আসতে দেড় বছর সময় লাগে। ততদিন পর্যন্ত জাহাজের ক্রেন দিয়েই পণ্য উঠানামা চলবে। জিসিবিতে যেভাবে চলে।”
পিসিটি পরিচালনায় কার লাভ
রেড সি গেইটওয়ে টার্মিনালের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের ২২ বছরের চুক্তি অনুযায়ী, একটি রপ্তানি কন্টেইনার জাহাজে উঠালে ১৮ ডলার করে বন্দরকে পরিশোধ করতে হবে। সে হিসাবে পিসিটিতে ৩০ হাজার ৩৩৩ একক রপ্তানি কন্টেইনার জাহাজে উঠানো বাবদ ৫ লাখ ৪৬ হাজার ডলার বা সাড়ে ৬ কোটি কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পেয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। একই পরিমাণ রপ্তানি কন্টেইনার বন্দরের এনসিটি, সিসিটি কিংবা জিসিবিতে জাহাজীকরণ করলে প্রতি কন্টেইনার ৬০ ডলার হিসাবে প্রায় ২২ কোটি টাকা আয় করতো বন্দর।
বন্দরে ভেড়া জাহাজ থেকে যত কন্টেইনার উঠানামা হয়, তার মাশুল সরাসরি জাহাজ কোম্পানি থেকে আয় করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেখানে প্রতি ২০ ফুট দীর্ঘ কন্টেইনার শুধু জাহাজে উঠানোর জন্য ৬০ ডলার আয় হয়। আর সেই আয় থেকে প্রতি কন্টেইনার মাত্র ৮ ডলার বার্থ অপারেটর, টার্মিনাল অপারেটরকে দেয় বন্দর। বাকি ৫২ ডলার বন্দরের কোষাগারে জমা থাকে।
কিন্তু পিসিটির ক্ষেত্রে আয়ের পদ্ধতিই ভিন্ন। পিসিটিতে রেড সি গেইটওয়ে কর্তৃপক্ষ মাশুল সরাসরি আদায় করবে জাহাজ কোম্পানি থেকে। যদি কন্টেইনার উঠানোর জন্য ৬০ ডলারই আয় করে থাকে সেই আয় থেকে প্রতি কন্টেইনার ১৮ ডলার বন্দরকে দেবে বিদেশি অপারেটরটি। বাকি ৪২ ডলার তাদের একাউন্টে জমা হবে। এই ডলার তাদের আয় হিসেবে বিদেশে চলে যাবে। আর এনসিটি, সিসিটি, জিসিবি যেহেতু দেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালিত, তাদের আয় দেশেই থাকার কথা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পিসিটি থেকে তুলনামূলক আয় কম হওয়ার পরও কেন রেড সি গেইটওয়েকে দিয়ে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলো? অনেকেই বলছেন, তাদের দায়িত্ব দেওয়াটা প্রতিযোগিতামূলক হয়নি। আন্তর্জাতিক দরপত্র বা বিদেশি বন্দর অপারেটরদের মধ্য থেকে বাছাই করে যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়াও ছিল না। অনেকটা নির্বাহী আদেশেই এই চুক্তি হয়।
অভিযোগ রয়েছে, টানা দেড় দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে সৌদি আরবকে কাছে টানতেই রেড সি গেইটওয়েকে পিসিটির দায়িত্ব দেয়।
অবশ্য বন্দরের পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলছেন, রাজনৈতিক বিষয় থাকতে পারে, তবে রেড সি গেইটওয়েকে দিয়ে পিসিটি পরিচালনায় একটি গ্লোবাল ইমেজ বিল্ডিংয়ের বিষয় তো ছিলই। সেটির সুফল মিলবে যখন পূর্ণ সক্ষমতায় সে পিসিটি পরিচালনা করবে। আর শুরুতে সে ২৫ মিলিয়ন ডলারের একটি সিকিউরিটি জমা দিয়েছে। ২০৪৫ সালে সেটি ২০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
পিসিটির ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাসেসমেন্ট নির্ধারণী প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টের বরাত দিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, “পিসিটিতে রেড সি নিজের টাকায় যন্ত্রপাতি কিনে পরিচালনা করবে। ফলে প্রতিবছর যন্ত্রপাতির যে ডেপ্রিসিয়েশন সেটি আমাদের হিসাব কষতে হচ্ছে না। আমরা শুধু ১৮ ডলার করে গুনে নিচ্ছি। বাৎসরিক নদী ড্রেজিং তারা করবে। অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট যদি ঠিক হয় তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর লাভেই থাকবে।”
তবে চৌধুরী গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাহেদ সারোয়ার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পিসিটির এখনকার যে অবস্থা তাতে এটা নিয়ে তুলনা করার সময় আসেনি। আর ফুল সুইং অপারেশনে না আসা পর্যন্ত তাদের দক্ষতা যেমন জানতে পারব না, তেমনি বন্দরের খুব একটা লাভ হবে না।”
পিসিটিতে যেতে জাহাজ অপারেটররা, কন্টেইনার অপারটররা আগ্রহী নয়; কারণ, সেখানে সেই সক্ষমতা, অবকাঠামো তৈরি হয়নি বলে উল্লেখ করেন সাহেদ সারোয়ার।
তিনি বলেন, “একটি রপ্তানি কন্টেইনার আমি বেসরকারি অফডক থেকে সরাসরি এনসিটি, সিসিটি হয়ে জাহাজে তুলি, তার তুলনায় পিসিটি থেকে তুলতে খরচ বেশি পড়ছে। আবার জাহাজ মালিকরা পিসিটিতে জাহাজ ভেড়াতে চাইছেন না।
“প্রথমত, সেখানে আমদানি কন্টেইনার ডেলিভারির অনুমোদন মেলেনি।দ্বিতীয়ত, একটি জাহাজ আমদানি কন্টেইনার নামানোর প্রথমে এনসিটিতে যাবে, আর রপ্তানির জন্য পিসিটিতে ভিড়লে ভোগান্তি বাড়তি সময় লাগবে। আবার শিফটিং চার্জ, টাগ বোট চার্জসহ বেশ কিছু মাশুল বাড়তি লাগবে। কিন্তু এনসিটি, সিসিটি থেকেই তো আমি এক খরচে জাহাজ ভেড়ানো এবং ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি।”
এ বিষয়ে অবশ্য রেড সি গেইটওয়ে টার্মিনাল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করে না। বাংলাদেশে তাদের একজন কর্মকর্তা গোলাম মাঈনুদ্দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
মায়ার্স্ক লাইনের রপ্তানি পণ্য নিয়েই ৭ মাস পিসিটির
গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালনার সাত মাস পর এসে দেখা যাচ্ছে ‘রেড সি গেইটওয়ে’ তার কোনও দক্ষতাই দেখাতে পারেনি। প্রথমত, টার্মিনালে কোনও যন্ত্রপাতিই যোগ হয়নি। একটি জাহাজ পিসিটিতে ভিড়িয়ে আমদানি পণ্য নামার যে সক্ষমতা সেটিই তৈরি হয়নি। কন্টেইনার স্ক্যানার না বসায় আমদানি পণ্য নামার পর ডেলিভারির সুযোগ তৈরি হয়নি। ফলে সাতমাসে কোনও আমদানি পণ্য নামেনি পিসিটিতে।
সরাসরি রপ্তানি পণ্যবাহী সব জাহাজ পিসিটিতে ভিড়তে পারে না। সেখানে ভিড়তে পারে কেবল মায়ার্স্ক লাইনের জাহাজ। কারণ পিসিটির সঙ্গে কেবল চুক্তি আছে মায়ার্স্ক লাইনের। অন্য শিপিং লাইনের জাহাজ পিসিটিতে ভেড়ার সুযোগ নেই। আবার মায়ার্স্ক লাইনের সব জাহাজ পিসিটিতে ভেড়ে না।
চট্টগ্রাম বন্দরের মূল জেটি জিসিবি, এনসিটি, সিসিটিতে ভেড়ার পর মায়ার্স্ক লাইনের যেসব জাহাজ আমদানি পণ্য নামায় সেগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটি পিসিটিতে ভেড়ার জন্য অনুমোদন পায়। ফলে আমদানি পণ্য নামিয়ে ফেরত যাওয়ার পর জাহাজগুলো পিসিটিতে ভেড়ে রপ্তানি পণ্য এবং খালি কন্টেইনার জাহাজীকরণ করে বিদেশের বন্দরের উদ্দেশে রওনা দেয়।
রেড সি গেইটওয়ের দেখানো পথেই কি হাঁটছে এনসিটি
পিসিটি চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বাধুনিক টার্মিনাল। এই টার্মিনালের অবস্থান সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানে। যেখানে বঙ্গোপসাগর থেকে দূরত্ব কম, পিসিটির পাশে পানির গভীরতা বেশি, একাধিক ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক পেরোতে হয় না।
সেই গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনালটি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সৌদি আরবভিত্তিক রেড সি গেইটওয়েকে দেওয়া হয়। এতে রেড সি তার দক্ষতা যেমন দেখাতে পারেনি, তেমনি কবে নাগাদ সেটি দেখাতে পারবে—তা নিশ্চিত করে বলছে না রেড সি কিংবা বন্দরের কেউই।
রেড সি গেইটওয়ের প্রস্তাবে বলা আছে, পিসিটি পরিচালনায় ২৪ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে প্রতিষ্ঠানটি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসাবে)।
দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিনিয়োগ পেতে বেশি সময় লাগার শঙ্কাও করছে অনেকে। তবুও এ পরিস্থিতিতেও অন্তর্বর্তী সরকার এনসিটিও বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনার জন্য জোর তৎপরতা শুরু করেছে।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিয়ে এনসিটি পরিচালনার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল। এ ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহী ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তবে গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর সেই প্রক্রিয়া থমকে যায়।
এখন অন্তর্বর্তী সরকার সেই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। আর এর বিরোধিতা করে শ্রমিক সংগঠনের পাশাপাশি কিছু রাজনৈতিক সংগঠন নিয়মিত প্রতিবাদ সমাবেশ করে যাচ্ছে। এতে করে বন্দরকেন্দ্রিক শ্রম অসন্তোষ আবারও চাঙ্গা হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিদেশি অপারেটরের বিরোধিতা বন্দর ব্যবহারকারীরা করছেন না। তারা বলছেন, একটি রেডিমেড এবং বন্দরের হার্ট হিসেবে পরিচিত এবং সব যন্ত্রপাতি সংযোজিত এনসিটি কেন বিদেশিদের হাতে দেবে? নতুন একটা টার্মিনাল তৈরি করে সেটি পরিচালনার জন্য বিদেশিদের উম্মুক্ত করা হোক।”