Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

ভর্তির পর ডোপ টেস্ট করছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সফলতা নিয়ে সংশয়

ctg university
[publishpress_authors_box]

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ‍শুরুতে কথা ছিল, ডোপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তির সুযোগ পাবেন। কিন্তু, তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। বরং এখন ভর্তির সব প্রক্রিয়া শেষ করে ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার পর ডোপ টেস্ট করতে শুরু করেছে প্রশাসন।

ফলে এই টেস্টের সফলতা নিয়ে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ কোনও শিক্ষার্থীর টেস্ট না করালে বা এড়িয়ে গেলে কী হবে তার নির্দেশনা দেয়নি প্রশাসন। কেউ যদি চিকিৎসকের পরামর্শে ঘুমের ওষুধ সেবন করেন, তাহলে রিপোর্ট পজেটিভ এলে তার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে, তারও সুস্পষ্ট ধারণা নেই সরকারের কাছে।

আবার সাড়ে ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর টেস্ট করানোর মতো সক্ষমতা প্রশাসনের আছে কিনা, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।  

বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্টের মাধ্যমে শুরু হয়েছে এই কার্যক্রম। পর্যায়ক্রমে সবগুলো আবাসিক হল এবং হোস্টেলে চলবে ডোপ টেস্ট, প্রক্রিয়াটি শেষ হবে আগামী ৭ জানুয়ারি।

একজন শিক্ষার্থী কোনও ধরনের মাদকের নেশায় আসক্ত কিনা তা পরীক্ষা করা হয় ডোপ টেস্টের মাধ্যমে।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম ডোপ টেস্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির উদ্যোগ নেয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৯ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এই পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে।

এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও ডোপ টেস্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়।

ভর্তি পরীক্ষার আগেই ডোপ টেস্টের সিদ্ধান্ত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের উপাচার্য ড. আবু তাহেরের সময়। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, নতুন উপাচার্য দায়িত্ব নিতে দেরি হওয়াসহ নানা কারণে সেটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ার পরই ডোপ টেস্ট করছে প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করতে আমাদের অনেক সময় লেগে গেছে। এরইমধ্যে আমরা মেধার ভিত্তিতে বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষার্থীদের হলে ওঠা নিশ্চিত করেছি। ফলে এবার দেরিতে ডোপ টেস্ট কার্যক্রম শুরু করতে হয়েছে। আগামী বছর থেকে আমরা উদ্যোগটি এগিয়ে আনব।”

প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষার্থীরা তো ভর্তি হয়েই গেছে। এখন ডোপ টেস্টের ফলাফল যদি পজেটিভ আসে বা কারও মাদকাসক্তের প্রমাণ মেলে; তাহলে কী করবে প্রশাসন?

এ বিষয়ে জানতে চাই উপউপাচার্য বলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে আবাসিক হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্টের আওতায় আনছি। এতে কোনও শিক্ষার্থীর টেস্ট পজিটিভ হলে আমরা তার আবাসিক হলের আসন বাতিল করবো, বাকি শাস্তি দেশের আইন অনুযায়ী হবে।

“পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্টের পরীক্ষা করা হবে। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, আমাদের নিরাপত্তাকর্মীসহ অনেকেই মাদকাসক্ত। আমরা পর্যায়ক্রমে সব ক্ষেত্রে হাত দেব।”

ডোপ টেস্টের খরচ

শুরুতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে শিক্ষার্থীরা নমুনা দেবেন, সেখান থেকে উত্তীর্ণ সনদ পেলে তবেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বিবেচিত হবেন। কিন্তু এই পরীক্ষার জন্য ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা খরচ হবে বলে জানিয়েছিল মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু এই অর্থ বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর জন্য অতিরিক্ত বলে মনে করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখন সিদ্ধান্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির তহবিল থেকে এই খরচ বহন করা হবে।

পরে সিদ্ধান্ত হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে। এতে খরচ কমে যাবে অর্ধেকের বেশি। তখন শিক্ষার্থীরাই তা বহন করতে পারবে।

ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, “ডোপ টেস্টের খরচ কমিয়ে আনার জন্যই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ল্যাবে টেস্ট করছি। এই টেস্টে আমরা কোনও মুনাফা করছি না। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসোর্সগুলো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমরা খরচ কমানোর চেষ্টা করেছি। বাকি টাকা আমরা শিক্ষার্থীদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তুকি দেবো।”

অবশ্য কত টাকা ভর্তূকি দিতে হবে তা জানাতে পারেননি তিনি।

পরীক্ষার ফলাফল থাকবে গোপন

নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আবাসিক শিক্ষার্থী ডোপ টেস্টের জন্য সাড়ে তিনশ টাকা নির্ধারিত ব্যাংকে জমা দিয়ে রশিদ নেবেন। সেই রশিদ দেখিয়ে তিনি ডোপ টেস্ট করাবেন। টেস্টের ফলাফল দুদিনের মধ্যে শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছবে।

কেবলমাত্র একজন শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানবে ডোপ টেস্টের ফলাফল। পজেটিভ রিপোর্ট এলে আবাসিক হলে বরাদ্দ হওয়া সিট বাতিল হবে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার ছাত্রত্ব বাতিল হবে না।

ডোপ টেস্ট কমিটির সমন্বয়ক ও জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমান বলেন, “ডোপ টেস্টে পজেটিভ এলে একজন শিক্ষার্থীর আবাসিক হলের আসন বাতিল হবে। সেই শুন্য আসন অপেক্ষমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে পূরণ করা হবে।”

শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্তি থেকে উত্তরণের জন্যই এই উদ্যোগ জানিয়ে তিনি বলেন, “কাউকে ছোট বা হেয় করার জন্য এই পরীক্ষা নয়। মান নিশ্চিতে আমেরিকান কিট দিয়ে ডোপ টেস্ট করা হবে। টেস্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে যাতে কোনও সন্দেহ না থাকে, সেভাবেই মান নিশ্চিত করা হবে। এ সংক্রান্ত সব তথ্য শিক্ষার্থীকে সরবরাহ করা হবে।”

টেস্টের বিষয়ে বা এ প্রক্রিয়ায় কোনও ত্রুটি চোখে পড়লে তা প্রশাসনকে জানাতেও অনুরোধ করেছেন এই শিক্ষক।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীরা মাদকাসক্ত কিনা তা যাচাইয়ে চারটি ক্যাটাগরিতে টেস্ট করছে। এর মধ্যে বেনজুডাইয়াজিপাইন অন্তর্ভুক্ত স্লিপিং পিল, মারিজুয়ানা (গাঁজা), ইয়াবা ও আফিম। স্লিপিং পিলের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী গ্রহণ করা হলে, তা মেনে নেওয়া হচ্ছে। কেউ মাত্রাতিরিক্তি স্লিপিং পিল সেবন করলে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে মেডিকেল টিমের কাছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও একই ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে বা নেবে কিনা; তা অবশ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

যেহেতু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটি নতুন, তাই বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা।

শাহ আমানত হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, “ভালো কিট দিয়ে পরীক্ষা করা হবে। পজিটিভ রিপোর্ট এলে সেটি ঘষামাজা করে নেগেটিভ করার জন্য তদবির-লেনদেন হচ্ছে কিনা, সেদিকে নজরদারী বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা বা আন্তরিকতা কতটুকু, সেটিও এখানে দেখার বিষয়।”

চিকিৎসকরা কী বলছেন

বাংলাদেশে সাধারণত প্রস্রাব বা ইউরিন দিয়েই নির্ধারিত ল্যাবরেটরিতে ডোপ টেস্ট করা হয়।

বর্তমানে পুলিশের চাকরিতে প্রবেশের সময় এবং গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে অবশ্যই ডোপ টেস্ট প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সেগুলো করা হয় সরকারি হাসপাতালে।

চট্টগ্রামের বেসরকারী এপিক হেলথ কেয়ারের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. দীপন চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা অবশ্যই যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু কেউ যাতে ভুল রিপোর্টে পড়ে ভর্তি বঞ্চিত না হন অবশ্যই সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে।”

তিনি বলেন, “ইউরিন নমুনা থেকে দেওয়া পরীক্ষায় নেগেটিভ এলে সে যোগ্য হিসেবে ভর্তি হতে পারবে। কিন্তু ‌‘ফলস পজিটিভ’ বলে একটি কথা আছে। এটি এলে, নতুন করে পরীক্ষা করে ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। একই সঙ্গে রিপোর্ট তৈরির সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে তদারকির মধ্যে রাখতে হবে, যেন কেউ অসততা করার সুযোগ না পায়।”

শিক্ষার্থীরা অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শে ডিপ্রেশন বা হতাশা কাটাতে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খান। এই ওষুধ খাওয়ার পর ডোপ টেস্ট করলে অনেক সময় ‘ফলস পজিটিভ’ রিপোর্ট আসে। কিন্তু আসলে তারা মাদকাসক্ত নন। ফলে এসব ওষুধ খাওয়ার কতদিন পর ডোপ টেস্ট করা যাবে তার সুষ্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। যাতে একটি ছাত্রও ভুল রিপোর্টের ফাঁদে পগে শিক্ষাজীবন নষ্ট না করেন।

কোন হলে কবে ডোপ টেস্ট

বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত সূচি অনুযায়ী, স্যার এএফ রহমান হলে ১২ থেকে ১৪ ডিসেম্বর, আলাওল হল ১৫ থেকে ১৭ ডিসেম্বর, শহীদ আব্দুর রব হলে ১৮থেকে ২০ ডিসেম্বর, মাস্টার দা সূর্যসেন হলে ২১ থেকে ২৩ ডিসেম্বর, শাহ আমানত হলে ২৫ থেকে ২৯ ডিসেম্বর, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর এবং ১ ও ২ জানুয়ারি, শাহজালাল হলে ৩ থেকে ৬ জানুয়ারি এবং শিল্পী রশিদ চৌধুরী হোস্টেলে ৭ জানুয়ারি চলবে ডোপ টেস্ট।

তবে ছাত্রীদের কোনও হলে ডোপ টেস্টের কথা জানায়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

সবারই হবে টেস্ট?

২ হাজার ৩০০ একরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার ৫০০ জন। এছাড়া এবার প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে হল রয়েছে ১৪টি। এর মধ্যে চালু আছে ১২টি। চালু থাকা হলের মধ্যে ছাত্রদের সাতটি, বাকি পাঁচটি ছাত্রীদের। এসব হলে মোট আসন আছে ৬ হাজার ৩১৫টি। এখন শুধুমাত্র আবাসিক হলে থাকা শিক্ষার্থীদেরই ডোপ টেস্টে নজর দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

নতুনবর্ষে ভর্তি হওয়া পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীদের সবাইকে কীভাবেম কখন ডোপ টেস্টের আওতায় আনা হবে তার কোনও নির্দিষ্ট সূচি জানায়নি প্রশাসন। ফলে বেশ বড় একটি অংশ টেস্টের বাইরে থেকে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট এক শিক্ষক বলেন, “সব শিক্ষার্থীকে ডোপ টেস্টের আতায় আনা চ্যালেঞ্জিং কাজ, অনেক কঠিন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়ার শুরুতেই ডোপ টেস্ট নিশ্চিত করা গেলে ভোগান্তি কমে যাবে।”

এফ রহমান হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী প্রশ্ন তোলেন উদ্যোগের সফলতা নিয়ে।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কোনও আবাসিক শিক্ষার্থী যদি ডোপ টেস্ট না করেন কিংবা অনুপস্থিত থেকে ডোপ টেস্ট এড়িয়ে যান তার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে? এখানে এখনও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। ফলে ডোপ টেস্ট নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। তাহলেই কেবল সঠিক পরীক্ষা ও সবার পরীক্ষা নিশ্চিত যাবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত