চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে ওমান এয়ারের ফ্লাইটে আসা দুই যাত্রীর কাছ থেকে শনিবার বিদেশি ব্র্যান্ডের ৪৯০ কার্টন সিগারেট জব্দ করেন শুল্ক কর্মকর্তারা। ওই দুজনকে আটক করে স্বীকারোক্তি নিলেও পরে সিগারেট রেখে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
এভাবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সিগারেট আনার সময় প্রায়ই যাত্রীরা ধরা পড়েন। সেই সিগারেট কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জব্দ করে সরকারি কোষাগারে জমা দেন ঠিকই, কিন্তু যাত্রীদের আইনের আওতায় আনেন না।
বিমানবন্দর দিয়ে সোনার বার অবৈধভাবে আনার পর মামলা হলেও গত এক বছরে সিগারেট আটকের ঘটনাগুলোতে কোনও মামলার নজির নেই।
কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছে, সিগারেটের ঘটনায় মামলা করার রেওয়াজ নেই।
“সিগারেট ধরা পড়ার পরিমাণ সামান্য হলে আমরা সিগারেট আটক করেই যাত্রীদের ছেড়ে দিই। কারণ রাজস্ব তো সিগারেটেই আটকা,” বলেন এক শুল্ক কর্মকর্তা।
এতে আইনের ব্যত্যয় ঘটছে কি না- চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কর্মরত পাঁচজন শুল্ক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তারা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, সিগারেট নিয়ে তারা সেভাবে চিন্তাই করেননি। তারা সব সময় সোনা বা সোনার বার আটকেই মনোযোগী থাকেন।
শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আইনের চোখে দেখলে হয়ত বিষয়টি আইন লঙ্ঘন হিসেবে ধরা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনা করে আমরা বিষয়টিতে ছাড় দিই এবং দিয়ে আসছি।
“সেজন্য সিগারেট আমরা পরিত্যক্ত হিসেবে আটক দেখাই। কারণ সামান্য পণ্যের জন্য চোরাচালান মামলা হলে দেখা যাবে সেটি আদালতে টেকে না।”
বিমানবন্দরে কর্মরত কাস্টমস রাজস্ব কর্মকর্তা বিজন কুমার বলেন, “বিমানবন্দর কাস্টমস মামলা করে না, এমনটিও বলা যাবে না। সিগারেট বেশি ধরা পড়লে হয়ত মামলা করে। পরিমাণে কম আনলে মামলা দিই না। তবে সিগারেট আটক করে রাখি।”
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বিমানবন্দরে কর্মরত সহকারী কাস্টমস কমিশনার অলক হাজরার মোবাইল নম্বরে শনিবারের পর বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
আইনে কী আছে
আমদানি নীতি অনুযায়ী বাণিজ্যিকভাবে সিগারেট আমদানি নিষিদ্ধ নয়। শর্তসাপেক্ষে উচ্চ শুল্কে আমদানি করা যায়। কিন্তু ব্যাগের রুলসে অর্থ্যাৎ যাত্রীর লাগেজে বেশি পরিমাণ সিগারেট আনা নিষিদ্ধ।
ব্যাগের রুলস ২০১৬ এ তফসিল-৩ এ শুল্ক-করমুক্ত ২৫টি পণ্যের একটি তালিকা দেওয়া আছে। এরমধ্যে ১৯ নম্বরে লেখা আছে, একজন যাত্রী এক কার্টন বা ২০০ শলাকা সিগারেট শুল্ক ছাড়াই আনতে পারবেন।
ফলে একজন যাত্রীর বৈধভাবে এক কার্টনের বেশি সিগারেট আনার সুযোগ নেই। তবে এর বেশি আনলে চোরাচালান মামলা হবে কি না, তার সুস্পষ্ট নেই কাস্টমস আইনে।
এই কারণেই কাস্টমস কর্মকর্তারা রেওয়াজের কথা বলে সিগারেট ধরে নিয়মিতই ছেড়ে দিচ্ছেন যাত্রীদের। ফলে আইনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না তাদের।
আমদানি নীতি ২০১৬ এর বাণিজ্যিক আমদানি ধারার ৫৬ পৃষ্ঠায় বলা আছে, বাণিজ্যিকভাবে সিগারেট আমদানির ক্ষেত্রে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ এমন কথা বাংলায় লেখা থাকতে হবে। তবে বন্ডেড অয়্যারহাউসের আওতায় যেসব সিগারেট আমদানি হবে, সেগুলোতে বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় এই ধরনের সতর্ক বার্তা লেখা থাকা বাধ্যতামূলক।
কাস্টমস আইন ১৯৬৯ এ ৩৭ পৃষ্ঠায় চোরাচালান বলতে নিষিদ্ধ, নিয়ন্ত্রিত বা শুল্ক-কর ফাঁকি দিয়ে আনা পণ্যকে বোঝানো হয়েছে। কোনও যানবাহনের বা কোনও পণ্যের মধ্যে বা কোনও ব্যক্তির দেহে লুকিয়ে আনা সেই নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত পণ্যকেই চোরাচালান হিসেবে গণ্য করা হবে।
কেন ব্যাগে আসে সিগারেট
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সিগারেট খুব বেশি আমদানি হয় না। কারণ সিগারেট আমদানিতে শুল্কহার অনেক বেশি। প্রতি বছর বাজেটে সেই শুল্কহার বাড়ানো হয়। ফলে আমদানিকারকরা সিগারেট তেমন আমদানি করেন না।
তাই ব্যবসায়ীদের নজর অবৈধভাবে বা লাগেজে কিংবা বিমানবন্দরের ফ্রেইট বিভাগের মাধ্যমে অবৈধভাবে আনা সিগারেটের দিকে থাকে।
কেননা অবৈধভাবে আসলে খরচ পড়ে অনেক কম বলে জানান চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজারের এক ব্যবসায়ী।
এই বাজারের হরহামেশাই বিদেশি ব্রান্ডের চোরাই সিগারেট পাওয়া যায়।
কাস্টমস কর্মকর্তা বিজন কুমার বলেন, “শনিবার যে যাত্রীর কাছ থেকে সিগারেট জব্দ করা হয়, তারা ছিলেন প্রবাসী। তিন বছর পর দেশে এসেছেন। আমরা চেহারা দেখে বুঝি, তারা চোরাকারবারি নন। চোরাকারবারি হলে আমরা মামলা না করে ছাড় দিই না।”
চেহারা দেখে কীভাবে চোরাকারবারি বোঝেন- সেই প্রশ্নের উত্তর তার কাছ থেকে মেলেনি।
ভোক্তা সংগঠন ক্যাবের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আইনের ব্যতয় মানেই ব্যতয়। এটিকে ছোট-বড় ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।
“আমার মনে হয় চোরাচালানিরা জানেন কত কার্টন সিগারেট আনলে ধরা পড়ার সুযোগ নেই। ফলে সেই সুযোগটি তারা বারবার নিতে চান।”
সিগারেটের ক্ষেত্রে চোরাচালানে আইনে ব্যাখ্যা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন বলেও মত দেন তিনি।
আটক সিগারেট কী করা হয়
শুল্ক কর্মকর্তারা জানান, বিমানবন্দর, বন্দর বা যে কোনও স্থান থেকে আটক সিগারেট জব্দের পর প্রথমে কাস্টমসের গুদামে পাঠানো হয়। পরে সেগুলো পর্যটন কর্পােরেশনের মাধ্যমে নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়। বিক্রির টাকা জমা হয় সরকারি কোষাগারে।